পেলে থেকে বেকহাম by রাহেনুর ইসলাম

৬ বছর আগে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলেকে দিয়ে শুরু হয়েছিল ফুটবলকে যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, জন নিসকেন্স, কার্লোস আলবার্তো তরেস, জর্জ বেস্ট, ইয়োহান ক্রুইফের মতো ফুটবলারদের নিয়ে গিয়েও চেষ্টাটা চলেছে। এখনো চলছে সেই চেষ্টা। তবে পেলেকে দিয়ে শুরু হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ফুটবলে যোগ দেওয়া সর্বশেষ সবচেয়ে বড় নাম সম্ভবত ডেভিড বেকহাম। ইংলিশ এ তারকা কদিন আগে লস অ্যাঞ্জেলেস গ্যালাঙ্রি সঙ্গে তাঁর চুক্তির মেয়াদ শেষ করেছেন শিরোপা জিতে! লিখেছেন রাহেনুর ইসলাম


পেলেকে জাতীয় সম্পদই ভাবত ব্রাজিল। তাই সে দেশের সরকার জানিয়েছিল পেলেকে রক্ষা করার স্বার্থে তাঁকে ইউরোপ বা অন্য কোথাও ক্লাব ফুটবল খেলতে দেওয়া হবে না। 'ফুটবলের রাজা' সে কারণেই ক্যারিয়ারটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন নিজের দেশে খেলে। শত প্রলোভনেও ছেড়ে যাননি শৈশবের ক্লাব সান্তোসকে। নিউইয়র্ক কসমসও নাছোড়বান্দা। ১৯৭১ সালে জন্মের পর আমেরিকার এই ক্লাবের প্রধান লক্ষ্যই ছিল, যেকোনো মূল্যে পেলেকে আনা। উদ্দেশ্যটা মহৎ। যুক্তি ছিল পেলের মতো তারকা এলে বদলে যাবে আমেরিকার ফুটবল অঙ্গন। ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়বে। খেলাটারও উন্নতি হবে।
অবশেষে পেলেকে টলানো গেল এই উদ্দেশ্যটার কথা বলেই। ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক ও ১৯৭৪ সালে ক্লাব ফুটবল থেকে বিদায় নিলেও সর্বকালের অন্যতম সেরা এ ফুটবলার অবসর ভেঙে ফেরেন আবারও। ১৯৭৫ সালের ১০ জুন চুক্তিবদ্ধ হন কসমসের সঙ্গে। দুই বছরে সেই চুক্তিটা ছিল ২.৮ মিলিয়ন ডলারের, যা সে সময়ের হিসেবে রূপকথার মতো অবিশ্বাস্য। বয়স ৩৫ হলেও পেলের নামটা চুম্বকের মতোই টানে আমেরিকানদের। আট মাস খেলার বাইরে থাকার পরও কসমসে পেলের প্রথম ম্যাচটা দেখতে তাই ভরে গিয়েছিল গ্যালারি। ম্যাচটা সরাসরি সম্প্রচার করা হয় ২২টি দেশে, আর ম্যাচটা কভার করতে গিয়েছিলেন বিভিন্ন দেশের ৩০০ জনের মতো সাংবাদিক। ৩৬ বছর আগে হয়েছিল এ অবস্থা। এরই নাম পেলে মাদকতা!
তিনবারের বিশ্বজয়ী পেলের পথ ধরে কসমসে নাম লেখান আরো অনেক তারকাই। জার্মান কিংবদন্তি ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ার, ইতালির জর্জিও চিনালিয়া, ইংল্যান্ডের কিথ এডি, নেদারল্যান্ডসের জন নিসকেন্স, ব্রাজিলের কার্লোস আলবার্তো তরেসদের নিয়ে চাঁদের হাটই বসিয়েছিল কসমস। ফুটবল ইতিহাসের প্রথম গ্যালাকটিও বলা হয় ১৪ দেশের ফুটবলার নিয়ে গড়া ওই দলটিকেই। তবে এও ঠিক, পেলের মতো বেকেনবাওয়ার, তরেসরা কসমসে এসেছিলেন ক্যারিয়ারের সোনালি সময় পেছনে ফেলে আসার পর। 'বুড়ো' এই তারকাদের দিয়ে ফুটবলে তারুণ্যের জোয়ার তৈরি করা কঠিন। সেই জোয়ারে ভেসে যায়নি যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলও। বেসবল, অ্যাথলেটিঙ্, সাঁতার নিয়েই মেতে ছিল তারা। তবে দূরের বাতিঘরের দিকে যাত্রার শুরুটা যে পেলেদের দিয়ে, সেটা অস্বীকারের উপায় নেই।
১৯৭৭ সালে ক্যারিয়ারের শেষ মৌসুমে পেলে নর্দার্ন আমেরিকান সকার লিগের (এনএএসএল) শিরোপা জিতিয়েছিলেন কসমসকে। ওখানে খেলা ৬৪ ম্যাচে তাঁর গোল ৩৭। ১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবর সান্তোস-কসমসের প্রদর্শনী ম্যাচটাই ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের বিদায়ী ম্যাচও। বঙ্ংি কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলী, ১৯৬৬-এর ফুটবল বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ড দলের অধিনায়ক ববি মুরসহ আরো অনেক তারকাই ম্যাচটি দেখেছিলেন কানায় কানায় ভরে যাওয়া জায়ান্ট স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে। পেলে দুই অর্ধে খেলেছিলেন দুই দলের হয়ে। ফ্রি-কিক থেকে শেষ গোলটা করেন অবশ্য কসমসের হয়েই। ম্যাচ শেষে বাঁ হাতে যুক্তরাষ্ট্র আর ডান হাতে ব্রাজিলের পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করেন 'ফুটবলের রাজা'।
১৯৭৭ সালে ৩২ বছর বয়সে যোগ দিয়ে বেকেনবাওয়ার কসমসে খেলেছেন ১৯৮০ পর্যন্ত। ১৯৭৪ বিশ্বকাপজয়ী জার্মান অধিনায়ক ১৯৮০-৮২ মৌসুমে খেলেছিলেন আবার হামবুর্গের হয়ে। তবে ১৯৮৩ সালে সেখানে খেলেই যান অবসরে। কসমসকে এনএএসএল জিতিয়েছেন ১৯৭৭, ১৯৭৮ ও ১৯৮০ সালে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত ১০৫ ও ১৯৮৩ সালে ফিরে বেকেনবাওয়ার খেলেন ২৭ ম্যাচ। সেখানে খেলার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেছিলেন ভক্তের ভিড় না থাকায় সময়টা আরো বেশি উপভোগ্য হয়েছিল, 'ড্রেসিংরুমে থাকলে মনে হতো হলিউডে চলে এসেছি। জার্মানিতে তো না থেমে দুই কদমও চলতে পারতাম না। অথচ কসমসে ছিলাম একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট, স্বর্গে থাকার মতো।'
ব্রাজিলের ১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো ১৯৭৭ থেকে ৮০ পর্যন্ত ছিলেন কসমসে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এ রাইটব্যাক খেলেছিলেন ৮০ ম্যাচ। ১৯৭৪ বিশ্বকাপে ইতালির হয়ে দুই ম্যাচ খেলা স্ট্রাইকার জর্জিও চিনালিয়া কসমসে যোগ দিয়েছিলেন ২৯ বছর বয়সে ১৯৭৬ সালে। '৮৩ পর্যন্ত খেলে ২১৩ ম্যাচে করেছিলেন ১৯৩ গোল। টোটাল ফুটবলের ঝড় তুলে ১৯৭৪ ও ১৯৭৮ বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছিল নেদারল্যান্ডস। সেই দলের তারকা মিডফিল্ডার জন নিসকেন্স ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত ছিলেন কসমসে। এ সময়ে ৯৪ ম্যাচে করেছিলেন ১৭ গোল। প্যারাগুয়ের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার রবার্তো কাবানাস অবশ্য ক্যারিয়ারের সোনালি সময়টা কাটিয়েছেন কসমসেই। প্যারাগুয়ের হয়ে ২৮ ম্যাচে ১১ গোল করা কাবানাস ২১ বছর বয়সে ১৯৮০ সালে যোগ দিয়েছিলেন সেখানে। ১৯৮৪ পর্যন্ত ৯৭ ম্যাচে করেছিলেন ৬৩ গোল।
যুক্ররাষ্ট্রেরই আরেক ক্লাব লস অ্যাঞ্জেলেস অ্যাজটেকে খেলেছেন আবার ইয়োহান ক্রুইফ, জর্জ বেস্টের মতো তারকারা। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা নর্দার্ন আয়ারলান্ডের কিংবদন্তি বেস্ট কাটান ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। ১৯৬৮-এর ইউরোপের বর্ষসেরা এ ফুটবলার ১৯৭৬-এ নাম লেখান লস অ্যাঞ্জেলেস অ্যাজটেকে। একটা মৌসুম খেলে ফুলহামে যোগ দেওয়ার পর '৭৭-এ আবারও ফিরে আসেন লস অ্যাঞ্জেলেসে। তবে এবারও ক্লাব ছাড়েন এক মৌসুম খেলেই। ৪৫ ম্যাচে বেস্ট লস অ্যাঞ্জেলেসের হয়ে করেছেন ২৭ গোল। ১৯৭৮ বিশ্বকাপ শেষে ডাচ কিংবদন্তি ক্রুইফ বার্সেলোনা ছাড়ার পর '৭৯-তে নাম লেখান লস অ্যাঞ্জেলসে। সেই মৌসুমে ২৭ ম্যাচে ১৪ গোল করে ছেড়ে যান ক্লাব। পরের মৌসুমটাও তিনি কাটান আমেরিকান লিগে, তবে সেবার নাম লেখান ওয়াশিংটন ডিপ্লোম্যাটসে।
খেলোয়াড়ের চেয়ে কোচ হিসেবেই বেশি বিখ্যাত নেদারল্যান্ডসের গাস হিডিংক। খেলোয়াড়ি জীবনে সেই তিনিও ১৯৭৮ সালে একটা মৌসুম খেলেছিলেন ওয়াশিংটন ডিপ্লোম্যাটসে।
বুঝতেই পারছেন নামি অনেক তারকা যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ফুটবলে খেললেও প্রায় সবাই গিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলায়। ১৯৯৬ সালে মেজর লিগ সকার (এমএলএস) শুরুর পরও খুব বেশি বদলায়নি ছবিটা। আন্তর্জাতিক বা ক্লাব ফুটবলে নিজেদের সেরা সময় পেছনে ফেলে আসা কোনো তারকা অথবা ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো দেশের অখ্যাত তরুণরাই যুগে যুগে খেলে গেছেন সেখানে। কিছুটা ব্যতিক্রম ডেভিড বেকহাম। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ৬টি প্রিমিয়ার লিগ আর রিয়াল মাদ্রিদের পক্ষে ১টি লা লিগা জেতা এ ইংলিশ সুপার স্টার ২০০৭ সালে নাম লেখান লস অ্যাঞ্জেলেস গ্যালাঙ্েিত। বেকহামের মিডিয়া ম্যানেজার জানিয়েছিলেন পাঁচ বছরের চুক্তিতে ২৫০ মিলিয়ন ডলার পাবেন তিনি! আসলে এটা ছিল ক্লাবের বেতন ও ব্যক্তিগত স্পনসর থেকে সম্ভাব্য আয়ের হিসাব। বেকহামের চুক্তিটা ছিল ৩২.৫ মিলিয়ন ডলারের যেখানে তাঁর বার্ষিক বেতন ৬.৫ মিলিয়ন ডলার। এই টাকার একটা অংশ নেওয়া হয় আবার এমএলএস লিগের অন্য দলের কাছ থেকেও, কেননা লিগ কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস ছিল, বেকহামের মতো তারকা এলে নতুন জাগরণ হবে আমেরিকার ক্লাব ফুটবলে।
সেটা যে হয়নি তা একদিক থেকে বলাই যায়। বেকহামের পর এই পাঁচ বছরে তেমন কোনো বড় তারকা নাম লেখাননি যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ফুটবলে। গত বছর বার্সেলোনা থেকে ফ্রান্সের সাবেক অধিনায়ক থিয়েরি অঁরি নিউ ইয়র্ক রেড বুলসে গেলেও, সেরা সময়টা অনেক পেছনে ফেলে এসেছেন তিনি। তা ছাড়া তেমন একটা সফল ছিলেন না ইংল্যান্ডের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১৫ ম্যাচ খেলা বেকহাম নিজেও। জাতীয় দলে খেলতে হলে ইউরোপিয়ান লিগে তাঁকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে বলেন ইংলিশ কোচ ফ্যাবিও ক্যাপেলো। এ কারণে ধারে খেলতে হয়েছে এসি মিলানে।
লস অ্যাঞ্জেলেসের হয়ে ৭৪ ম্যাচে বেকহাম গোল করেছেন ১১টি। গত পাঁচ বছরে দলকে একটা মাত্র এমএলএস কাপ জিতিয়েছেন, তা-ও একেবারে শেষ মৌসুমে। বিদায়টা তাই 'হলিউড' স্টাইলেই হলো। তবে আমেরিকান ফুটবলে হলিউডের মতো গ্ল্যামার আনতে না পারার বেদনাটা নিশ্চয়ই পোড়াবে বেকহামকে।

No comments

Powered by Blogger.