জেলহত্যা দিবস-বিশ্ব বিবেক যেখানে পরাস্ত by বাঙালী শামসুর রহমান

১ বছর ধরে জেলহত্যা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটি জেলখানার আইজি প্রিজনের কক্ষে ফাইলচাপা পড়ে ছিল। ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ তারিখে তা বহু খোঁজাখুঁজির পর উদ্ধার করা হয়। এতে দেখা যায়, খন্দকার মোশতাক এবং মেজর রশীদ জাতীয় চার নেতাকে হত্যার জন্য সরাসরি নির্দেশ প্রদান করেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতাযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার সমতুল্য এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড


৩ নভেম্বর ১৯৭৫ গভীর রাতে সবার অজ্ঞাতে সংঘটিত হলো ইতিহাসের এক জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। সেই দিনটিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতির জনক ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এইচএম কামরুজ্জামানসহ জাতির চার নেতা কতিপয় বিপথগামী সশস্ত্র সেনা সদস্য কর্তৃক পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ঘটনাটি ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যয়। প্রথমটি ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা আর দ্বিতীয়টি হলো জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা। ১৯৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের প্রহসন শেষে মীরজাফরের নির্দেশে মোহাম্মদ আলী বেগ কর্তৃক বন্দি নবাব সিরাজউদ্দৌলার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বাংলার ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতা এবং নৃশংসতার এমন নজির আর নেই।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নানা কারণ নির্দেশ করা হয়। প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে নয় মাসের সফল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, প্রবাসে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ও এক লাখ মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয়, জনগণের চাহিদা সুষ্ঠুভাবে মেটানো এবং স্বাধীনতার পর ভারত থেকে প্রায় এক কোটি ও পাকিস্তান থেকে প্রায় পাঁচ লাখ বাঙালিকে ফিরিয়ে আনা হয়। সেই প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠন, স্বল্পতম সময়ে মাত্র নয় মাসের মধ্যেই সংবিধান প্রণয়ন, সাধারণ নির্বাচন, কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ, ওআইসির সদস্যপদ লাভ, চীন ও সৌদি আরব ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন প্রভৃতি কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধু সরকার সম্পন্ন করেছিল মাত্র সাড়ে তিন বছরে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মূল কারণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্বদান ও পরিচালনার প্রতিশোধ। স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষের মতে, সে অপরাধেই তাদের মধ্যযুগীয় বর্বরতায় হত্যা করা হয়েছিল। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক এবং দেশীয় শত্রুদের সম্মিলিত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের নীলনকশার বাস্তবায়ন ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড।
বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমদের নির্দেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পুনর্বহাল বন্ধ করতে জেলে আটক চার নেতাকে হত্যা করা হয়। কর্নেল মতিউর রহমানের মতে (মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যাকারী), জিয়াউর রহমানই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নেপথ্য নায়ক। রেকর্ডে দেখা যায়, বঙ্গভবনের নির্দেশে তারা রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ, এলডি আবুল হাশেম মৃধাকে বঙ্গভবন থেকে মেজর রশীদের নির্দেশে জেলে প্রবেশ করতে দেন। তারা ৩ নভেম্বর ভোর ৪টায় জেলগেটে স্বাক্ষর করে প্রবেশ করে। জেলে প্রবেশ করে তারা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামানকে একটি কক্ষে একত্র করার কথা জানিয়ে বলে, তারা তাদের গুলি করবে। ভীতসন্ত্রস্ত আইজি, ডিআইজি রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে কথা বলতে চান। মেজর রশীদ তাকে ফোনে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। আইজি প্রিজনকে প্রতিবাদ জানাতে দেওয়া হয়নি। তাদের সবাইকে তাজউদ্দীনের সেলে আনা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ তাড়াতাড়ি অজু করে নামাজ পড়ে নেন এবং অন্য তিন নেতাও নামাজ পড়েন। এরপর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অত্যন্ত কাছ থেকে অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয় সবাইকে। তিনজনের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়। মোসলেহ উদ্দিন এবং তার দল যাওয়ার আগে সেলে তালা দিয়ে যায়। খুনিরা ৪টা ৪৫ মিনিটে জেলগেট ত্যাগ করে। এরপর ৫টা ২৫ মিনিটে বঙ্গভবন থেকে নায়েক এ আলীর নেতৃত্বে জেলে এসে নেতাদের মৃত্যু হয়েছে কি-না তা নিশ্চিত করে চলে যায়। জনশ্রুতি আছে, তাদের বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। কামরুজ্জামানের লাশ হেলিকপ্টারে রাজশাহী নিয়ে কবর দেওয়া হয়। অন্য তিন জাতীয় নেতার লাশ বনানী গোরস্তানে সমাহিত করা হয়।
কী তাদের অপরাধ আজও জানা হলো না। বিশ্ব বিবেক পরাস্ত হলো। যে নেতারা জীবনের বেশিরভাগ সময় দেশ ও জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল খেটেছেন বারবার; দখলদার বাহিনী যাদের হত্যা করার সাহস পায়নি অথচ দেশীয় শত্রুরা ক্ষমতা ও অর্থের মোহে দখলদার বাহিনীর হয়ে স্বাধীনতার নায়কদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। জাতি তাদের বিচার চায়। তাদের উপযুক্ত বিচার করেই দেশ অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারে। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার, এই কাজটি করা তাদের পবিত্র দায়িত্ব। অন্য দলগুলো কৌশলে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কথা বলে কেবলই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সত্যিকার অর্থে তাদের কর্মকাণ্ড স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরুদ্ধ।
২১ বছর ধরে জেলহত্যা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটি জেলখানার আইজি প্রিজনের কক্ষে ফাইলচাপা পড়ে ছিল। ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ তারিখে তা বহু খোঁজাখুঁজির পর উদ্ধার করা হয়। এতে দেখা যায়, খন্দকার মোশতাক এবং মেজর রশীদ জাতীয় চার নেতাকে হত্যার জন্য সরাসরি নির্দেশ প্রদান করেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতাযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার সমতুল্য এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। প্রতিবছর বাংলাদেশে শহীদদের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। কিন্তু চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ড জাতির কাছে অস্পষ্ট অবস্থায় আছে। তাই আমাদের উচিত জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে তাদের প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন।

বাঙালী শামসুর রহমান : মহাপরিচালক নায়েম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়
 

No comments

Powered by Blogger.