ছায়ানটের ৫০ বছর-আলোর মিছিলের এগিয়ে চলা

সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালে। শুরু থেকেই বাংলা সংস্কৃতির পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে আসছে সংগঠনটি। চলতি নভেম্বরে ৫০ বছর পূর্তি হলো ছায়ানটের। এ পথপরিক্রমা নিয়েই নন্দনের বিশেষ আয়োজন। লিখেছেন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক ও শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল'সংস্কৃতি জন্ম দেয় জাতীয়তা, দেশ, রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং পরম গুরুত্বের সমাজ-সুনীতির।' এ কথাটি ছিল ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হকের।


এ রকমই চিন্তা-চেতনায় ১৯৬১ সালে একত্র হয়েছিলেন মোখলেসুর রহমান, শামসুন্নাহার রহমান, সুফিয়া কামাল, ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, মীজানুর রহমান, সাইফউদ্দীন আহমেদ। সে বছর ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শততম জয়ন্তী। তখনই এ রকম একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ঐকমত্যে পেঁৗছান তারা। সময়টা ছিল পাকিস্তানের শাসনকাল। হিন্দু কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গায়ে ধর্মান্ধতার লেবাস সেঁটে দেওয়া হয়েছে। তাই প্রকাশ্যে রবীন্দ্রনাথের গান বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালানো ছিল আন্দোলন করে গান গাওয়ার মতো। এরই মধ্যে জয়দেবপুরে এক বনভোজনে আরও কিছু কর্মী মিলে সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য সমিতি গঠন করা হয়। সাইদুল হাসানের প্রস্তাবে নাম দেওয়া হয় 'ছায়ানট'।
পথচলা : ঘরোয়া পরিবেশে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান করার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় উন্মুক্ত অঙ্গনে প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে বসন্ত ঋতু বরণ করার। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিপরীত দিকে সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্টের বাড়ির ধারঘেঁষে তৈরি করা হলো মঞ্চ। মঞ্চ পরিকল্পনায় আনা হলো বৈচিত্র্য। ঘরোয়া থেকে রমনার সবুজ প্রকৃতি, সেখান থেকে মানুষের মধ্যে মিশে যেতে থাকে ছায়ানট। অনুষ্ঠান শেষে ঘরে তৈরি সাধারণ খাবার পরিবেশন দাঁড়িয়েছিল ছায়ানটের বৈশিষ্ট্য। চিড়ার মোয়া, নারিকেলের নাড়ূ আর মুড়ি-মুড়কি, এগুলো ছিল খাবারের তালিকায়।
এরপর গণঅভুত্থানের '৬৯ পার করে এলো '৭১-এর স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। বাঙালিরা চোয়াল ঠেকিয়ে লড়ে যাচ্ছে। আমাদের পরিবার কুমিল্লা হয়ে কলকাতা গেল। ওখানে গঠন করা হলো 'সংস্কৃতি স্কোয়াড' নামে একটি দল। যেখানে 'মুক্তির গান' করা হতো। আমি দু'একবার মহড়া দেখতে গিয়েছিলাম। দেখতাম সন্জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, মাহমুদুর রহমান মুক্তির গানের এ দলটিকে গান শেখাচ্ছেন, পরিচালনা করছেন।
বাঙালিয়ানার সম্ভার : বাংলার রঙে-ঢঙে নেই কেতাদুরস্ত ভাব; কিন্তু আছে বৈশাখীর লাল টিপ, ফাগুনের আগুন রাঙানো শিমুলের ডাল, শরতের আকাশে সাদা ধবধবে পেজা তুলার আনাগোনা, বর্ষার ছিটেফোঁটা আর অতিস্বাভাবিক কিন্তু গাঢ় আন্তরিকতা। বাংলা ঋতুর পরতে পরতে রয়েছে বৈচিত্র্যের স্বাদ। ছায়ানট সব সময় চেষ্টা করেছে সে স্বাদের ঢেকুর তুলতে। প্রতিটি ঋতু উদযাপন করে চলেছে ছায়ানট। ঋতুকেন্দ্রিক বসন্ত উৎসব, বর্ষামঙ্গল উৎসব, এগুলোর আসর বাঁধা ছিল। ঋতু উৎসব হিসেবে শারদোৎসবের জায়গা ছিল বলধা গার্ডেনে। বসন্ত উৎসব হতো মাঠে। পহেলা বৈশাখের জন্য ছিল রমনার বটমূল। এটি আসলে ছিল পাকুড় গাছ, আমরা বটমূল বলি ভালোবেসে।
২০০১ সালে পহেলা বৈশাখ ছিল জাতির জন্য ভয়াবহ আঘাতের দিন। মঞ্চে ছেলেমেয়েরা বসে 'এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী' গান করছিল। এ সময় মঞ্চের দক্ষিণ দিকে আমাদের বেষ্টনীর খানিক দূরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনাস্থলেই ৭টি দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। পরে আরও তিনজন মারা যায়। সেদিন আমরা শোকগ্রস্ত হয়েছিলাম; কিন্তু ভীত হইনি। সেই ঘটনার পর আজ পর্যন্ত সন্জীদা আপা সব সময় মঞ্চে আগে ওঠেন, যাতে অন্যরা কেউ ভয় না পায়। এমন মানুষ আমরা আর পাব কোথায়?
ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন : শংকর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা লাল রঙের ভবনটি দেখলেই মনটা ভরে যায়। এই আমাদের ছায়ানট ভবন। কত সংগ্রাম, আন্দোলন, প্রতিকূলতা মোকাবেলার মূর্ত প্রতীক। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন ছায়ানট ছিল আজিমপুর স্কুলে। স্বাধীনতার আগে ছিল বর্তমানের উদয়ন বিদ্যালয়ের পরে এ প্রতিষ্ঠানকে যেতে হয় কলাবাগানের লেকসার্কাস হাইস্কুলে। স্বাধীনতার পর তিন দশকের জন্য ঠাঁই পায় ঢাবি ল্যাবরেটরি স্কুলে। ১৯৯৯ সালে সরকারের পক্ষ থেকে ১ বিঘা জমি পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে ২০০৬ সাল নাগাদ গড়ে ওঠে বর্তমানের ছায়ানট ভবন। এর প্রতিটি ইটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত অগ্রজ-অনুজ মুক্তচিন্তার কর্মীর মমতা মাখানো শ্রম। মানুষের ভালোবাসার গাঁথুনিতে তৈরি এ ভবনে আমি যেন স্পন্দন শুনতে পাই।
কার্যক্রম : ছায়ানট শুরু থেকেই সঙ্গীত চর্চা ও শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। ঋতুভিত্তিক উৎসব, জাতীয় উৎসব, শ্রোতার আসর, শুদ্ধ সঙ্গীত উৎসব, দেশঘরের গান, রবীন্দ্র ও নজরুলজয়ন্তী এবং প্রয়াণ উৎসবের পাশাপাশি এ কার্যক্রম শিল্পীদের মনন ও শিক্ষায় শুদ্ধতার বিকাশ ঘটিয়েছে। বর্তমানে সাড়ে তিন হাজারের ওপর শিক্ষার্থী এখানে সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় পড়াশোনা করছে। মিলনায়তন, গবেষণা কেন্দ্র, ছায়ানট আর্কাইভ_ সব কিছু গড়ে তোলা হয়েছে নির্মল সাধনার জন্য। এখানে শিকড় ও নালন্দা কাজ করে যাচ্ছে শিশু-কিশোরের মন ও মননের প্রয়োজনীয় রসদ জোগানো এবং শিশুকে আরও উদ্ভাবন-বিচারবোধ বাড়ানোর কাজে। শিশুদের মানসিক বৃদ্ধিতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। 'ওয়াহিদুল হক সঙ্গীত প্রব্রজ্যা' দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে সঙ্গীতের প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে। অটিস্টিক শিশুদের জন্য 'সাপ্তাহিক গান ও আঁকাজোকার ক্লাস'-এর মতো কার্যক্রম। এ ছাড়া ৪ বছর ৫ বছর মেয়াদি সঙ্গীত শিক্ষা কার্যক্রম নিয়মিতভাবে চলে আসছে।
একজন ছায়াবৃক্ষ : ওয়াহিদুল হক ছিলেন একজন রবীন্দ্র বোদ্ধা; কিন্তু তিনি নিজেকে এক জায়গায় বেঁধে রাখেননি। নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়। আর সব বাধা থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন আমাদের এ সংস্কৃতিকে। নজরুলসঙ্গীতে আমার গান করার পেছনে তার উৎসাহের কমতি ছিল না। তিনি নজরুলকে অন্য চোখে দেখতেন। তার কাছে নজরুল ছিলেন সব সম্প্রদায়ের কবি। কাজী নজরুল ইসলামের জীবনবোধ, দর্শন তিনি প্রচারের কাজে হাত দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন 'কাজী নজরুলকে আমাদের মুক্ত করতে হবে।' শুধু নজরুল বা রবীন্দ্রই নয়, তিনি সব সময় বলতেন পুরনো গান, শেকড়ের গান বেশি বেশি করে চর্চা করতেন লালন সাঁই, লোকগান, পল্লীগান, যে গানগুলো আমাদের বাঙালি ইতিহাস বহন করে চলে সে গানগুলোর চর্চা বা সংরক্ষণে তিনি কাজ করে গেছেন। ওয়াহিদুল হকের মতো গুণীজনের সানি্নধ্য পাওয়ার সুযোগ হয় ছোটবেলায় ছায়ানটে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে। আমার মামা ছিলেন মাহমুদুর রহমান বেনু। বাড়ির ছেলেমেয়েদের তিনি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতেন। উদ্দেশ্য একটাই_ ছায়ানটে ভর্তি করানো। সে সময় মামার মুখেই বারবার শুনতাম ওয়াহিদুল ভাই ও সন্জীদা আপার কথা। ওয়াহিদুল ভাইকে প্রথম
সামনাসামনি দেখি ছায়ানটে ভর্তি হওয়ার পর। ওয়াহিদুল হক মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্লাস নিতেন। তবে প্রথম বর্ষের পর ছায়ানটের ছাত্রছাত্রীরা বিষয় পছন্দ করত তারা কোন গানের শিল্পী হবে। ওয়াহিদুল ভাই নিজেও ছাত্রছাত্রীদের গান শুনে উপদেশ দিতেন কার কণ্ঠে কোন গানটি ভালো হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে গানের অনুশীলন করার সময় তার ক্লাসগুলো পেতাম। সে সময় তিনি গানের সুর-তাল-লয় কেমন হবে তা ধরিয়ে দিতেন। এ ছাড়া ক্লাসে বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিতেন। ফলে আমাদের কাছে তার ক্লাস মানেই ছিল আনন্দ ও উপভোগের। এখন যখন আমি শিক্ষক হিসেবে ক্লাসে যাই, চেষ্টা করি তার মতো ক্লাসটা উপভোগ্য করে তোলার। আজ যারা বাংলাদেশে সঙ্গীতের ঝাণ্ডা হাতে দাঁড়িয়ে আছে তারা সবাই ছায়ানটের মমতার ছায়া পেয়েছেন। ছায়ানটের ছায়াবৃক্ষ আমাদের সবার প্রিয় ওয়াহিদুল হক ভাই। আর এখন সেই ছায়া বিছিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন সন্জীদা আপা। ১৯৬১ সালে সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠার সঙ্গে মোখলেসুর রহমান, শামসুন্নাহার, সুফিয়া কামাল, ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুনের নাম জড়িয়ে আছেন; কিন্তু সারাটি জীবন ছায়ানটের আষ্টেপৃষ্ঠে থেকে গেছেন ওয়াহিদুল ভাই ও সন্জীদা আপা। ধানমণ্ডির শংকর বাসস্ট্যান্ডের ধারঘেঁষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ছায়ানট ভবন। নানা বাধ-বিপত্তি পাড়ি দিয়ে ছায়ানট একটি স্থায়ী ঠিকানা পেয়েছে। তবে আমার মনে আছে, এ বিল্ডিং নির্মাণের পর ওয়াহিদুল ভাই খুব খুশি হয়েছিলেন, আবার মন খারাপও করেছিলেন। বললেন_ 'দেখিস, ছায়ানট যেন এ ইট-পাথরের মধ্যে আটকা না পড়ে। ছায়ানটের ঠিকানা যেন এই ভবনটি না হয়। ছায়ানটের আসল ঠিকানা বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে।' এখনও আমি লাল রঙের এ ভবনটির দিকে তাকাই। ঝরা পাতার শব্দ পাই না, পাই সবুজের ঘ্রাণ। আমি জানি, অগ্রজরা যে পথ দেখিয়ে গেছেন, আমরা সেদিকেই চলছি। আমাদের সঙ্গে আছে নবীনরাও, এ দেশের সব বাঙালি আর ছায়াবৃক্ষের আশীর্বাদের ছায়া।
আমি ও আমাদের ছায়ানট : আমার সঙ্গে ছায়ানটের সম্পর্ক ছোটবেলা থেকেই। আমি যখন শিশু শ্রেণীর পাশ দিয়ে হেঁটে যাই, ওদের গান শুনে আন্দোলিত হই। ফিরে যাই সেই ছোটবেলায়। মনে পড়ে সন্জীদা আপার ক্লাস। এখনও তার শেখানো গান_'হারে রে রে রে
আমায় ছেড়ে দেরে দেরে'
ভুলতে পারি না। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই উঁকিঝুঁকি দিতাম বিভিন্ন ক্লাসে। দেখতাম বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান হাত নেড়ে নেড়ে রাগের বিস্তার দেখাচ্ছেন। মাঝে কিছু সময় আমি লন্ডনে যাই উচ্চশিক্ষার জন্য। দেশে ফিরলাম ১৯৮৭ সালে। ছায়ানটের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা প্রবাসেও কষ্ট দিত।
কী যে এক অদৃশ্য বন্ধন। এটা ছিন্ন হওয়ার নয় বলে দেশে ফিরে এলাম। যুক্ত হলাম ছায়ানটের কর্মী ও শিক্ষক হিসেবে। ওয়াহিদ ভাই-সন্জীদা আপার স্বপ্নগুলোকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।

No comments

Powered by Blogger.