স্মরণ-নূজহাত জাহান : একজন কীর্তিমানের মুখচ্ছবি

নভেম্বর, ২০১১ মুন্নী ভাবির পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। আমার মেজভাই অধ্যাপক ও সাহিত্যিক ড. বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের স্ত্রী তিনি। দেখতে দেখতে পাঁচ বছর পার হয়ে গেল; কিন্তু মুন্নী ভাবির স্মৃতি আমাদের মধ্যে অমলিন। আমরা আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতিগোষ্ঠী ও পরিবারের কেউই মুন্নী ভাবিকে ভুলতে পারিনি। তাঁর অকৃত্রিম আচার-আচরণ, চালচলন, কথাবার্তা আমাদের ঘিরে রেখেছে। আমাদের সুখ-দুঃখের ছিলেন তিনি সাথি।


এই আপন মানুষটির অকস্মাৎ মৃত্যুতে আমরা শূন্যতায় ভুগছি। মৃত্যুবার্ষিকী এলেই তাঁর বিচ্ছেদ আমাদের বিশেষ করে মনে পড়ে। মুন্নী ভাবির নাম নূজহাত জাহান, খুব ভালো ছাত্রী ছিলেন তিনি। সমাজবিজ্ঞানে অনার্স ও এমএ করেছিলেন ১৯৬২ সালে। পরে আবার পরিসংখ্যানেও এমএ করেন। স্কুলজীবনে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করেছিলেন। সে জন্য ইংরেজিতে ছিলেন খুব দক্ষ। প্রথমে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এবং পরে বিদেশি ওষুধ কম্পানিতে উচ্চপদে চাকরি করতেন। দেখতে অত্যন্ত সুশ্রী ছিলেন। বড় ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁদের পরিবারে শিক্ষার ঐতিহ্য ছিল। বাবা মরহুম আবদুল হমিদ ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। শিক্ষা-দীক্ষা ও পারিবারিক নাম-ডাক বা অন্যান্য দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন ধীরস্থির, শান্ত ও নিরহংকার। আমাদের পরিবার থেকে আভিজাত্যের দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও আমাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন নিজ গুণে। আমরা পরিবারের সবাই তাঁর সঙ্গে কমবেশি একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর আচার-ব্যবহারে মুগ্ধ ছিলাম আমরা। প্রায় ৪০ বছরেও তাঁকে উঁচু স্বরে রাগতভাবে কথা বলতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে ছিল তাঁর একাত্মতা। আমাদের বাবাকে অত্যন্ত যত্ন ও সম্মান করতেন। তা ছাড়া দেবর, ননদ, ননাস, ভাসুর_সবার সঙ্গে ছিল তাঁর অন্তরঙ্গতা, যেটা আজকালকার দিনে প্রায় অকল্পনীয়। মনে পড়ে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ভাবি চাকরি করতেন আর প্রায়ই আমাকে তখনকার দিনের বৈচিত্র্যময় শাড়ি কিনে দিতেন। আমার ছেলেদের দিতেন সুন্দর সুন্দর পোশাক। ভাবি বিদেশে বা ট্যুরে যাওয়ার সময় একমাত্র ছেলে সন্তানকে রেখে যেতেন আমার কাছে। আমার দুই ছেলে ওর চেয়ে কিছুটা বড়। একসঙ্গে ওরা খেলত। একই ধরনের পোশাক পরলে প্রতিবেশীরা মনে করতেন, তিনজন আমারই ছেলে। ২০০৪ সালে আমি ছেলেদেরসহ হজে যাচ্ছি শুনে ভাবিও আমাদের সঙ্গে যাবেন বলে স্থির করলেন। হজের সময় ভাবির হাত ধরে আমি চলাফেরা করেছি। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া ও শোয়াবসা ছিল। এতে আরো নিবিড়ভাবে ভাবিকে পেয়েছি। হজ থেকে ফিরে ভাবি আমাকে একটি ওয়াশিং মেশিন কিনে দিলেন। আমি কিছুতেই নিতে চাইনি। আমার ছোট ছেলে তামিম বলল, 'মামি গিফ্ট দিতে চায় দিক না, আমার দরকার, কাপড় ধুতে আমার ভালো লাগে না, তুমি না করছ কেন?' ভাবির দেওয়া সেই ওয়াশিং মেশিন দিয়ে এখনো আমরা কাপড় ধুই। ভাবির কথা মনে করি। ভাবি হঠাৎ করে ৩ নভেম্বর, ২০০৬ সালে ভোরে মারা গেলেন কথা বলতে বলতে। ২ নভেম্বর রাতে বিয়ের দাওয়াত খেয়েছেন। টেলিফোনে যুক্তরাজ্যে তাঁর দুলাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। আগের দিন আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন একাধিকবার। আমরা ভাই-বোন, ভাগনে-ভাগি্ন, ভাইপো_সবাই তাঁর বাসায় বেড়িয়েছি, প্রয়োজনে থেকেছি_কখনো ঝামেলা মনে করেননি; এত বড় মাপের মানুষ ছিলেন আমাদের মুন্নী ভাবি। আজ সেসব কথা মনে করে শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় চোখে পানি আসে। তাঁর মতো পরিমিতিবোধসম্পন্ন ও উদার মনের মানুষের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ লেখার ইতি টানছি।
নীলুফার বেগম

No comments

Powered by Blogger.