মুক্তমঞ্চে মুক্তগদ্য by রণজিৎ বিশ্বাস

দন্তকারী কর্মকর্তা একজন 'মানবসন্তান' ছিলেন বলে সে মামলায় আমি রক্ষা পেয়েছিলাম। তবে শুধু কাগজপত্রে, ওদের অন্তর থেকে নয়। মুক্তি পাওয়ার পরও ওরা বারবার আমাকে প্রাপ্য থেকে 'মাহরুম' করেছে। ভাবটা এমন_ তোকে এভাবে না পারিসবচেয়ে গলদবিচারে আমি পড়েছিলাম 'জোটকদলী' লিখে। একটি গল্প। প্রথমে এটি ঢাকার একটি কাগজের সাহিত্যসংখ্যায় ছাপা হয়। পরে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত আমার একটি গল্পের বইয়ে (চারকোণে চারজন) এটি ঢোকে। নাম ছিল তখন 'কদলীসমাচার'।


বিসিএস তথ্য সমিতির বার্ষিক প্রকাশনায় নতুন লেখার সময় পেয়ে গল্পটি আমি পরিবর্তিত নামে (জোটকদলী) ছাপতে দিই। মাথায়ও ছিল না যে এই নামের কারণে কিছু ইডিয়ট আমার দ্বাদশ ঘটিকা বাজানোর চেষ্টা করতে পারে।
গল্পের বিষয় ছিল ব্যঙ্গাত্মক। একটি কুসংস্কারকে আঘাত করার জন্য এটি লেখা। কোনো সন্তানসম্ভবা গায়েগায়ে লেগে থাকা কলা খেলেই তার যমজ বাচ্চা হবে_ এমন কোনো কথা নেই_ এই ছিল গল্পের বিষয়। তার নাম পালটে জোটকদলী দেওয়ার কারণ একটি ফ্ল্যাট শিরোনাম (কদলীসমাচার) বাদ দেওয়া এবং গল্পটিকে আরও নিবিড়ভাবে বিষয়সংশ্লিষ্ট করা। কারণ, যিনি এক দুপুরবেলায় পিয়নকে দিয়ে কলা আনিয়ে খেয়েছিলেন, তিনি 'জোড়কলা' খাননি; যুক্তাবস্থায় তিনটি কলা খেয়েছিলেন। কৌতুককর বিষয় হচ্ছে, তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর কোনো সমস্যা হয়নি, বরং একসঙ্গে তিন বাচ্চার জন্ম হয়েছিল পিয়নের বাড়িতে এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল।
এই গল্পটি আর এমন কী গল্প। এটি নিয়েই তোলপাড় বাধিয়ে ফেলল কিছু অতি বিদ্বিষ্ট ও অসূয়াদগ্ধ নষ্টলোক। তারা বলল, জোটকদলী লিখে 'বাংলা নামের এই কালপ্রিট' জোট সরকারকে ব্যঙ্গ করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। এক অফিসার, যিনি দেয়ালে টাঙিয়ে রাখতেন 'ইনজাস্টিস অ্যানি হোয়্যার ইজ অ্যা থ্রেট টু জাস্টিস এভরি হোয়্যার', তিনি মেরুদণ্ডে সব জ্যামজেলি নিয়ে আত্যন্তিক উৎসাহে মেতে উঠলেন 'জোটকদলী' লিখে জোট সরকারকে ব্যঙ্গ করার দুঃসাহস দেখানো 'কালপ্রিট'কে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করায়। যথাস্থানের উৎসাহে যথানিয়মে ও যথাসময়ে রুজু হয়ে গেল 'বিভাগীয় মামলা'।
তদন্তকারী কর্মকর্তা একজন 'মানবসন্তান' ছিলেন বলে সে মামলায় আমি রক্ষা পেয়েছিলাম। তবে শুধু কাগজপত্রে, ওদের অন্তর থেকে নয়। মুক্তি পাওয়ার পরও ওরা বারবার আমাকে প্রাপ্য থেকে 'মাহরুম' করেছে। ভাবটা এমন_ তোকে এভাবে না পারি, ওভাবে আটকাব। তোকে পিষে ফেলার জন্য মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী সাম্প্রদায়িক ও ছদ্মসাম্প্রদায়িক লোকদের বুলডোজারের কোনো অভাব নেই!
: আপনার এই দীর্ঘ গল্পের তিনটি অধ্যায় শুনলাম। এ জন্য কি আপনার মনে এখনও কোনো ক্রন্দন আছে?
: না। নেই। বরং, ওই কানাচোখ মানুষগুলোর প্রতি আমার মনে পর্যাপ্ত ও প্রভূত কৃতজ্ঞতাবোধ আছে। ওরা আমাকে বারবার বুঝিয়ে দিয়েছে_ জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা। ওরা আমার সঙ্গে অমন আচরণ করেছে বলেই তো নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে ওদের মাথার ওপর বিরূপ প্রকৃতি আশীর্বাণী আমি বর্ষাতে পারছি। মনের সুখে ওদের আমি শাপবিদ্ধ ও অভিশাপদগ্ধ করতে পারছি এবং লেখায় লেখায় ও বলায় বলায় মানুষ ও মনুষ্যাবয়ব প্রাণীর মধ্যে বিশাল এক ভেদরেখা টেনে বুঝিয়ে দিতে পারছি_ এরা মানুষ, ওরা কীট শুধু নয়, কীটাণুকীট, পাশবাতিপাশব। এরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক, ওরা একই আদর্শের ঘোরবিরোধী; এরা মানবতাবাদী ওরা যুদ্ধাপরাধী। যুদ্ধাপরাধী বলেই ওদের সঙ্গে শিক্ষা, সততা, সাধুতা, সুরুচি, উদারতা, নিরপেক্ষতা, মানবতা, ধর্মভীরুতা ও অসাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক নেই। ওরা ওদের মতো, মানুষ মানুষের মতো।

রণজিৎ বিশ্বাস : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.