প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি-প্রত্যাশার বেলুন ফুটো

রাস্তা না কইরা আর আসবো ন। এমপি সাব ভোটের আগে এমন কতাই কইছিল। রাস্তা করার জন্যই নৌকায় ভোট দিছি। পাস কইরা এই যে এমপি গেল, আর আইল না। রাস্তা তো অয়ই নাই, অহন পাহাড় থাইক্যা আত্তি (হাতি) আইয়া ক্ষেতের ধান খাইতাছে, মানুষ মারতাছে, তাও দেকপার আয়ে না।'_সীমান্ত জনপদ শ্রীবরদীর বালিজুরি গ্রামের সিদ্দিক মিয়া (৫০) এভাবেই তাঁর আশাভঙ্গের বেদনার কথা বলেছেন।
নির্বাচনের আগে শ্রীবরদীর বালিজুরি ও ভায়াডাঙ্গা বাজারে নির্বাচনী পথসভায় শেরপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য প্রকৌশলী ফজলুল হক চাঁন ভায়াডাঙ্গা-বালিজুড়ি সড়কটি পাকা করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। হালুয়াহাটি গ্রামের পল্লী চিকিৎসক আবদুল হামিদ জানান, মাত্র আড়াই কিলোমিটার কাঁচা সড়কটি পাকা করলেই এখানকার মানুষের দুর্ভোগের অবসান ঘটে। অথচ বর্ষা মৌসুমে এই রাস্তায় কাদাপানিতে একাকার হয়ে যায়।
বালিজুড়ি-ভায়াভাঙ্গা সড়কের মতোই ভায়াভাঙ্গা-ধানশাইল সড়কের দুপুরিয়া সেতু এবং দুই কিলোমিটার ভাঙা রাস্তা নির্মাণের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতীর মধ্যে এটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়ক। ধানশাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ওবায়দুল ইসলাম বলেন, 'অনেক আশা করে প্রকৌশলী ফজলুল হক চাঁন সাহেবকে এমপি বানিয়েছিলাম। কিন্তু এখন তিনি এলাকায়ই আসেন না। দুপুরিয়ার ব্রিজটি ভেঙে পড়ে আছে। যেন দেখার কেউ নেই। সোমেশ্বরী নদীর উজানে বাঁধ দেওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে ভাটিতে পানি না পাওয়ায় সেচ সংকট চলছে। আবার বর্ষার সময় বন্যা সবকিছু ভাসিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু নদীটি খনন করে সেই বালি দিয়ে নদীর দুই পাশে বাঁধ দিলে এলাকাটি বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেত, আবার শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানিও থাকত। নদী থেকে পাম্প দিয়ে পানি তুলে জমি সেচ করে বোরোর আবাদ করা যেত। কিন্তু কোথায়, এমপিও আসেন না, কোনো নেতাও দেখেন না।' ঝিনাইগাতীর তেঁতুলতলা ব্রিজটি ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও অদ্যাবধি নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। শেরপুর-শ্রীবরদীর সড়ক সংস্কার এবং কুড়ি কাহনিয়া ব্রিজ নির্মাণের নির্বাচনী অঙ্গীকার অদ্যাবধি পূরণ হয়নি। পাহাড়ি জনপদের মানুষ বন্য হাতির তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মানুষ মরছে, আহত হচ্ছে, ঘরবাড়ি ধ্বংস হচ্ছে, ক্ষেতের ফসল-গোলার ধান বন্য হাতি খেয়ে ফেলছে। কিন্তু তাদের দেখার জন্য, খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য সংসদ সদস্য ফজলুল হক চাঁন একটি বারও ওই এলাকায় যাননি, তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াননি। বরং হাতি তাড়ানোর জন্য সরকারের তরফ থেকে জেনারেটরের বাবদ যে কেরোসিন তেল ও ডিজেল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, দলীয় নেতা-কর্মীরা সেই অর্থ লুটেপুটে খেয়েছেন বলে হাতিদুর্গত এলাকার মানুষের অভিযোগ। বন্য হাতির অত্যাচার ও তাণ্ডব থেকে রক্ষায় সীমান্তে পাহাড়ি জনপদের বাসিন্দারা বিদ্যুতায়নের দাবি জানিয়েছেন।
রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হবে। সবকিছু নিয়মমতো চলবে, দুর্নীতি কমবে_এমন প্রত্যাশা নিয়ে সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দিলেও আড়াই বছরের মাথায় শ্রীবরদী-ঝিনাইগাতী এলাকার মানুষের প্রত্যাশার বেলুন ফুটো হয়ে গেছে। টিআর-কাবিখা-কাবিটায় চলছে লুটপাটের মহোৎসব। এমপির স্পেশাল বরাদ্দ কোথায় যায়, কী হয়, সাধারণ মানুষ কিছুই জানে না। ভিজিডি, ভিজিএফ, অতিদরিদ্রদের কর্মসৃজন কর্মসূচির অর্থ এবং মাদ্রাসা-মক্তবের নামে বরাদ্দকৃত গম-চালও তুলে খেয়ে ফেলা হচ্ছে। চাকরি-নিয়োগ, থানা-পুলিশের তদবিরবাণিজ্য আর দালালদের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। এমপির নাম ভাঙিয়ে এগুলো করছে তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতা-কর্মীরা। হাসপাতালে ডাক্তার সংকট, মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না_এসব দিকেও কারো নজর নেই। এমপি হওয়ার পর ফজলুল হক চাঁন এলাকায়ই আসেন না। তিনি ঢাকায় থাকেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে আড়াই বছরে মাত্র চারবার তিনি এলাকায় এলেও তাঁর পছন্দের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দেখা করে চলে গেছেন।
শ্রীবরদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, 'দুঃখের কথা কী বলব। আমি উপজেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক সম্পাদক। অথচ গত আড়াই বছরে এমপি সাহেব মুক্তিযোদ্ধা সংসদে একবারও আসেননি। কমান্ডঘরটি ভাঙাচুরা, আশপাশে ময়লা-আবর্জনা, সামনের মাঠে পানি জমে। বসার ব্যবস্থা নেই। কয়েকবার এমপির কাছে বরাদ্দের দাবি জানিয়েছি। কিন্তু কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। অথচ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির ছেলেকে এমপি সাহেব কাজী হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে ডিও লেটার দিয়েছেন। পৌর মেয়র এবং উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল হাকিমও আমাদের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডে আসেননি।'
দুঃখবোধ আছে পাহাড়ি জনপদের আদিবাসীদের মধ্যেও। ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার ৩০টি সীমান্তবর্তী গ্রামে গারো, কোচ, হাজং ও বর্মণসহ প্রায় ১৫ হাজার নৃতাত্তি্বক জাতিগোষ্ঠীর বাস। গারোদের ওয়ানগালা, বড়দিন মাতৃভাষায় শিক্ষা কারিকুলাম এবং জীবনযাত্রা মেলায় সংসদ সদস্য ফজলুল হক চাঁনকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হলেও আদিবাসীরা তাঁকে নিজেদের মাঝে একবারও পাননি। মরিয়মনগর গ্রামের আদিবাসী নেতা আজিম রাকশাম (৪০) ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'নির্বাচনের আগে মরিয়মনগর মিশন স্কুলকে এমপিওভুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বর্তমান এমপি। তিনি পাস করার পর কয়েকবার আমাদের অনুষ্ঠানে তাঁকে অতিথি করে দাওয়াত দিয়েছি। কিন্তু তিনি আসেননি। মরিয়মনগর মিশন স্কুলও এমপিওভুক্ত হয়নি।' তিনি ক্ষোভের সঙ্গে আরো জানান, তাঁর এমপি হওয়ার আশা ছিল, হয়েছেন। জনগণের কথা আর কে মনে রাখে?
ঝিনাইগাতী উপজেলার চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাদশা জানান, এমপি কোনো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়ন করেননি। তিনি আরো জানান, বরাদ্দ শুধু কাগজে আছে, বাস্তবে নেই। বরং এমপির দলের কিছু লোক মোটাতাজা হওয়া ছাড়া এলাকার মানুষের কোনো উন্নয়ন হয়নি। তিনি ঝিনাইগাতীর নাগরিক হিসেবে বিভিন্ন খাল-বিল, নালা-ঝোরা, নদ-নদী ড্রেজিং বা খনন করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ সৃষ্টির অনুরোধ জানান। এতে জমিতে সেচের ব্যবস্থা হবে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে, মৎস্যসম্পদের জোগান হবে। তা না হলে পানির জন্য সামনে কারবালা হয়ে যাবে। অথচ এসব দিকে তাঁদের নজর নেই। পাহাড়ি জনপদে বন্য হাতির সমস্যা নিরসনে তিনি বিদ্যুতায়নের দাবি জানান। গ্রামীণ রাস্তাঘাট এবং অবকাঠামো সংস্কার ও নির্মাণের দাবি জানিয়ে সেসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করার আহ্বান জানান।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম এ ওয়ারেজ নাঈম জানান, অসুস্থ থাকায় সংসদ সদস্য এলাকায় আসতে না পারায় ঠিকমতো সবকিছু মনিটরিং হচ্ছে না। এতে কাজের কিছুটা ত্রুটি হচ্ছে ঠিক, তবে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ফিফটি-ফিফটি বাস্তবায়িত হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.