সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য by মারযিয়া তাসমিন

শ্বরিয়া রাই বচ্চন কন্যাসন্তানের মা হয়েছেন। বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোয় তার জোর খবর। আমি এত উন্নাসিক নই যে, 'ভারতীয় একজন নায়িকার কন্যা হওয়ার খবর কেন বাংলাদেশের মিডিয়ায়'_ একে পুঁজি করে বিশাল জ্বালাও-পোড়াও কোনো লেখা লিখতে শুরু করব কিংবা 'ভারতীয় আগ্রাসন-ভারতীয় আগ্রসন' বলে গলা ফাটাব বা মুণ্ডুপাত করব বাংলাদেশের সুশীল সমাজের। আমি জানি, ঐশ্বরিয়া একজন সাধারণ ভারতীয় নায়িকা নন, তিনি


বিশ্বসুন্দরী খেতাব বিজয়ী, তার শাশুড়ি একজন বিখ্যাত বাঙালি নায়িকা, শ্বশুর একসময়ের রাজনৈতিক নেতা এবং বিশ্বখ্যাত অভিনেতাও বটে। এ পরিবারে নতুন মুখ আসার খবরটি এশিয়ার কোনো দেশের চ্যানেলগুলোয় গুরুত্ব পেতেই পারে। বাঙালি এত সংকীর্ণমনা নয় যে, গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে গুরুত্ব না দিয়ে আত্মকেন্দ্রিকতায় ডুবে থাকবে। ওই একই দিনে খবরের কাগজে আরেকটি খবর পড়লাম। আজ এ লেখাটি লিখতে বসার মুখ্য কারণ এটিই।
যেদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ঐশ্বরিয়ার মেয়েটির খবর দেখলাম, সেদিনই কাগজের শেষের পাতায় পড়লাম আমাদেরই দেশের একটি খবর। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের রাস্তায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে দুটি যমজ পুত্রসন্তান। রাস্তার আবর্জনায় শিশু দুটি পড়ে ছিল মৃত্যুর শঙ্কা নিয়ে। সে অবস্থা থেকে উদ্ধার করে দুই ভাইকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরদিন পড়লাম একটি ছেলে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা গেছে। অন্যটির অবস্থাও তেমন ভালো নয়। দুর্ভাগ্য, সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, তাকেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এই শিশু দুটির দুর্ভাগ্য, তাদের মা বিশ্বসুন্দরী নন। তাদের চোখের রঙ হালকা নীল হয়নি, তাদের দাদা তাদের জন্মের পর টুইটারে লেখেননি_ আমি উল্লসিত। এই শিশু দুটির জন্ম বচ্চন পরিবারে হয়নি, তাদের জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র একটি দেশের এক নিরুপায় মায়ের ঘরে। এই শিশুদের জন্মের সময় আলিশান কোনো হাসপাতালের গোটা ফ্লোর ভাড়া নেওয়া হয়নি, রাখা হয়নি শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক। তাদের দেখতে আসেননি শাহরুখ খান, হাসপাতাল ঢেকে ফেলা হয়নি কঠোর নিরাপত্তার চাদরে। তাদের ঢেকে দেওয়া হয়েছিল লুঙ্গির ছেঁড়া টুকরায়। তাদের দেখতে আসেনি কেউ। একই দিনে জন্ম নেওয়া এই তিন শিশুর মধ্যে মিল শুধু একটি ক্ষেত্রে। তিনটি শিশুই পেয়েছে বাংলাদেশের মিডিয়া কভারেজ। হয়তো কমবেশি। একই দিনে জন্ম অথচ দু'জন পড়ে রইল ডাস্টবিনে আর একজন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুযোগ-সুবিধা সংবলিত হাসপাতালে। কী বিচিত্র পৃথিবী। আমি বলব না, ঐশ্বরিয়ার মেয়েটি অতি সৌভাগ্যবতী। সে মেয়েটির সৌভাগ্যে আমি ঈর্ষান্বিত সেটিও বলব না। তার প্রতি আমার শুভ কামনা রইল। পৃথিবীতে আগমনকারী প্রতিটি শিশুর বেলায়ই এমন হোক সে আশা করি। আমি শুধু বলব, বাংলাদেশের এ দুটি ছেলে খুব দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে।
তাদের দুর্ভাগ্য যে, মিডিয়ার লোকজন তাদের ছবিও তুলতে এসেছে; কিন্তু সে ছবিতে তাদের পাশে তাদের হাস্যোজ্জ্বল মা ও গর্বিত বাবার মুুখ নেই। তাদের দুর্ভাগ্য, তাদের মায়ের নাম ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন নয়; তারা এত মানুষের ভালোবাসা পায়নি। তাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য, আমাদের রাষ্ট্র সবার কথা ভাবতে পারছে না।

No comments

Powered by Blogger.