স্বাধীনতার ঘোষণা আবার জাতীয় ঐক্যের দলিল হোক by ফরহাদ মজহার

রাজনীতির ওপর মহলে কী ঘটছে তা দেখে বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বোঝা যাবে কি? আমি সন্দেহ করি। পত্রপত্রিকা যেভাবে বিভিন্ন বিষয়কে দৃশ্যমান করে তোলে তার পেছনে তাদের নিজেদের রাজনীতি আছে। অধিকাংশ গণমাধ্যমই সরকারপক্ষীয়। ফলে তারা তাদের রাজনৈতিক পক্ষপাত বহাল রেখে খবর ছাপায়, খবর সাজায়। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু আদর্শগত পক্ষপাতের যে প্রভাব ও ফল, তার সঙ্গে দলীয় পক্ষপাত ও প্রোপাগান্ডার ফল একরকম নয়। গণমাধ্যমগুলো দলীয় পক্ষপাতে দুষ্ট। তাদের সাফল্য সাময়িক, কারণ এই সাফল্যের কারণ বিরোধী পক্ষের সাংগঠনিক ও মতাদর্শিক দুর্বলতা। এটা বিস্ময়ের উদ্রেক করে যে, দীর্ঘ সময় ক্ষমতার থাকার পরও বিএনপি এমন কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাংস্কৃতিক শক্তি সংগঠিত করতে পারেনি, যাদের স্বাধীন তৎপরতা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারাকে বিকশিত করতে পারে এবং এখনকার সঠিক কর্মসূচি ও কৌশল নির্ণয়ে সহায়ক হয়। বিএনপিতে কেউ নাই, এটা বলা উন্নাসিকতা হবে। একেবারেই নাই বলা ভুল। অবশ্যই। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মতাদর্শের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি প্রবল। তুলনায় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ অতিশয় দুর্বল। যে দুর্বলতা একটি জাতীয় রাজনৈতিক দলের জন্য একদমই মানানসই নয়।
আমি বিমূর্ত জাতিবাদী আত্মপরিচয়ের রাজনীতি করি না- সেটা বাঙালি কী বাংলাদেশী কিংবা সাম্প্রদায়িক মুসলমানিত্ব- কোনোটাই না। যিনি আমাকে শৈশবে কোরআন পড়িয়েছিলেন, তিনি ছিলেন অতিশয় মধুর চরিত্রের একজন মানুষ। তার কোরআন তেলাওয়াত আমি এখনও চোখ বন্ধ করলে শুনতে পাই। আমার প্রিয় শিক্ষকদের প্রায় সবাই ছিলেন ধর্ম বিশ্বাসে হিন্দু। মুসলমানদের জীবনাচার আমি জন্মসূত্রে পারিবারিক কারণেই জানি। ইসলামী আদব-কায়দা, সহবত মা-বাবার তিরস্কার ও ওস্তাদজির বেত খেয়ে শিখেছি। কিন্তু ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে যারা কৈশোরে আমাকে সহায়তা করেছেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু শিক্ষক। সবার কাছ থেকে যে সারকথাটা আমি শিখেছি সেটা হল, বাপ-দাদার চৌদ্দগুষ্টির ধর্ম ও সংস্কৃতিকে নির্বিচার গ্রহণ যেমন সজ্ঞানতা নয়, তেমনি তাদের নির্বিচারে অস্বীকার করার মধ্যেও কোনো গৌরব নাই; সমাজ তার অতীতকে ধারণ ও পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই অগ্রসর হয়। জ্বি, আমার মধ্যে সবাই আছেন, কারণ আমি ব্যক্তি নই- সামাজিক ও ঐতিহাসিক সত্তা। শুধু বুদ্ধি দিয়ে নয়, নিজের জীবনকে পর্যালোচনার অধীনে আনলে অনেক কিছুই কাণ্ডজ্ঞানে সহজে ধরা পড়ে। মাঝে মাঝে আশংকা হয় আমরা কাণ্ডজ্ঞান হারিয়েছি। নিজেদের সমাজ ও ইতিহাসের বাইরে ভাবার যে কাল্পনিক ও ভুতুড়ে চর্চা চলছে, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি তারই পরিণতি।
দুই
নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিপীড়ক নিজেদের সংগঠিত করার জন্য একটা মতাদর্শিক বয়ান খাড়া করে, নইলে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুম লড়তে পারে না। যে কোনো রাজনৈতিক বয়ানকে এ দিক থেকে দেখলে আমরা অনায়াসেই বুঝব যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ জালিমের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে নিজেদের পরিচয়ের যে বয়ান হাজির করেছিল, তার শক্তি নিপীড়নের ঐতিহাসিক বাস্তবতার মধ্যে নিহিত। তার ন্যায্যতা নিপীড়কের বিরুদ্ধে নিপীড়িতের বয়ান হিসেবে- এর বাইরে তথাকথিত চিরায়ত বাঙালি বা আবহমান বাঙালি সে ফ কল্পনা মাত্র। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইতিবাচক মূহূর্তগুলো সেই বিশেষ ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিচার করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা যখন একাত্তরের মধ্য দিয়ে বিশ্বসভায় হাজির হওয়া নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীকে চিরায়ত বাঙালি সত্তার খাপের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলতে চাইল, সেটা ব্যাকফায়ার করতে শুরু করে। কারণ বাঙালি নামক খাপটা ছিল ঔপনিবেশিক কলকাতার উচ্চবর্ণের হিন্দুদের খাপ। বাংলাদেশের কৃষকদের হাত থেকে জমি হরণ করা কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে গড়ে উঠেছে কলকাতা। কলকাতার বাঙালিত্ব বাংলাদেশের বাঙালির পরিচয় নয়, তার ইতিহাসও নয়। সেই ইতিহাসের মধ্যে জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে বাঙালির লড়াইয়ের ইতিহাস আছে। সেখানে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ আছে, ইংরেজের বিরুদ্ধে দেওবন্দিদের মরণপণ লড়াই আছে, ওসমানিয়া খেলাফতের পক্ষে লড়ার ইতিহাস আছে, হাজী শরীয়তউল্লাহ, তিতুমীরসহ বহু বিদ্রোহী ও বিপ্লবীর রক্তাক্ত স্মৃতি রয়েছে। এরা সব সময় বাঙালি হয়ে লড়েননি, বরং অধিকাংশ সময় তারা ইসলামের পতাকা নিয়েই লড়েছিলেন। বর্তমানের আলোকে সেই ইতিহাসের ভালো-মন্দ বিচার হতেই পারে। কিন্তু সেই সমৃদ্ধ ইতিহাস গড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঙালিত্বের যে বয়ান হাজির করেছিল তার মতাদর্শিক মৃত্যু ছিল অবধারিত। সেটা ত্বরান্বিত হয়েছে চেতনাবাদীদের দ্বারা। শাহবাগ তার মৃত্যঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। দেশের গরিব, নিপীড়িত সাধারণ মানুষ বুঝে গেছে, এই মতাদর্শ ইতিহাসকে নয় মাসের যুদ্ধে বেঁধে ফেলতে চায়। যেন বাঙালির আগে-পিছে আর কোনো ইতিহাস নাই। বাঙালির এই আÍপরিচয়ের বয়ানে কলকাতার বর্ণবাদী উচ্চবর্ণের হিন্দুর বয়ানের মতোই যেমন আদিবাসী ও মুসলমান অনুপস্থিত, তেমনি চেতনাবাদীদের বয়ানেও আদিবাসী আর মুসলমান খারিজ হয়ে আছে। আমি কে তুমি কে? বাঙালি বাঙালি এই উচ্চৈঃস্বরে স্লোগান ও ফাঁসির মঞ্চ বানিয়ে দড়ি সাজিয়ে মোমবাতি জ্বালানো দেখেছে মানুষ। মানুষের ফাঁসির দাবি নিয়ে মোমবাতি! যেখানে সারা পৃথিবীতে মানবাধিকার আন্দোলনে শাস্তি হিসেবে ফাঁসি বিলুপ্তির আন্দোলন চলছে, সেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে চায়। মতাদর্শ হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই চরম অধঃপতন তার ন্যায্যতার শেষ তলানিটুকুও শুকিয়ে ফেলেছে।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এই সংকট থেকে মুক্তির সম্ভাবনা হিসেবে হাজির হয়েছিল। কিন্তু তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক দৈন্য বাংলাদেশকে আরও গভীর গহ্বরে নিক্ষেপ করেছে। সেটা এমনই যে বিএনপির দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তুলনায় তুচ্ছ, কিন্তু তারপরও বিএনপি যে একটি দুর্নীতিবাজ দল এই ভাবমূর্তিই মানুষের মনে কালো দাগ হয়ে রয়েছে। এর বিপরীতে বিএনপির কোনো সাফল্যের কথা জনগণ মনে রাখতে পারে না। বিএনপির এমন কোনো মতাদর্শিক বয়ান নাই, যার ওপর বাংলাদেশের জনগণ আস্থা রাখতে পারে। মানবাধিকার লংঘনের কথা উঠলে সেই পুরনো কথাই শুনতে হয় যে, র‌্যাব তো আওয়ামী লীগ গঠন করেনি, করেছে বিএনপি। জাতীয় অর্থনীতি বিকাশের প্রশ্ন উঠলেই পুরনো তর্কটাই শুনতে হয় যে, জিয়াউর রহমান সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ ও আমলাদের লুটপাট বন্ধ করতে একটি অনুন্নত দেশের জন্য বাজার ব্যবস্থার ইতিবাচক ফলটুকু নিতে চেয়েছেন, কিন্তু তার পরে বিএনপি নীতিহীন কাছাখোলা অবাধ বাজার ব্যবস্থার চর্চা করেছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কার্যত শুরুতেই নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে বহুজাতিক কোম্পানি ও মাফিয়া পুঁজির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। অর্থাৎ দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে বিএনপি। শেখ হাসিনা, তার পরিবার ও পরিকরবৃন্দ বিএনপির চষা ক্ষেত থেকে টাটকা ফলটুকু ভোগ করছে এখন।
এই পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর জন্য যারা তৃতীয় শক্তি বা তথাকথিত বিকল্প ধারার কথা বলছেন, তারা আরও হাস্যকর। সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চরিত্র সব সময়ই পরস্পরবিরোধী দুটি রাজনৈতিক ধারায় হাজির হয়। এটা সামাজিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। নৈর্ব্যক্তিক। সেই দৃশ্যমান দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে মতাদর্শিকভাবে মোকাবেলার অর্থ হচ্ছে দ্বন্দ্বের মতাদর্শিক চরিত্র সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন থাকা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রেণীর বিরোধ কীভাবে সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে, তা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। এই প্রক্রিয়ার বাইরে তৃতীয় কিছু করার চিন্তা হয় বালখিল্যতা অথবা ষড়যন্ত্র।
এদিক থেকে বাংলাদেশে যে রাজনীতি গড়ে উঠবে বা উঠতে বাধ্য, তার প্রধান ক্ষেত্র বিদ্যমান বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মোকাবেলা করার মতাদর্শিক হিম্মত গড়ে তোলা। এটা পরিষ্কার, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সেই হিম্মত নাই। কিন্তু সে হিম্মত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সমাজে যে রাজনৈতিক উপলব্ধি জারি রয়েছে তাকে একটি বিকশিত রূপ দেয়া। সেই উপলব্ধি কী সে সম্পর্কে আমরা আলোচনা করতে পারি। কয়েকটি পয়েন্ট আমি এখানে হাজির করব যাতে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া যায়।
তিন
রাজনৈতিক আত্মপরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে বর্ণবাদী বাঙালিত্ব পরিহার করে বাঙালি বলতে সাধারণ মানুষ তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে যেভাবে নিজের ঐতিহাসিক সত্তাকে উপলব্ধি করে, তাকে বোঝার চেষ্টা করা। সেই উপলব্ধির মধ্যে ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী তারতম্য থাকতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ নিজেদের যেভাবে মুসলমান মনে করে এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অন্তর্গত গণ্য করে, ঠিক সেভাবে ও সমান মাত্রায় সে নিজেকে বাংলাভাষী এবং বাংলা সংস্কৃতিকে তার নিজের গণ্য করে। ইসলামের মধ্য দিয়ে সে যদি আরব, ইরান, তুরান ও অন্যান্য ইসলামপ্রধান দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ঐক্য বোধ করে, একইভাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে সে সিন্ধু নদের এই পারের সব জনগোষ্ঠীর সঙ্গেও সাংস্কৃতিক আত্মীয়তা অনুভব করে। এই দুয়ের সম্পর্ক ছেদ করার রাজনীতি বাংলাদেশে সফল হবে বলে মনে হয় না। এ দেশের জনগোষ্ঠীকে শুধু বাঙালি বানানোর রাজনীতি যেমন ব্যর্থ হবে এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী করবে, একইভাবে তাকে শুধু মুসলমান বানানোর রাজনীতিও সংঘাত তৈরি করবে। জনগণকে তাদের নিজ নিজ উপলব্ধির জায়গা থেকে নিজের পরিচয়ের সারবত্তা নির্ণয় করতে সহায়তা করার রাজনীতিই এখন আমাদের দরকার।
আমাদের বুঝতে হবে, বাংলাদেশের সংকট ও সংঘাত বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিকতা (polity) নির্ণয়ের ক্ষেত্র থেকে জাত। রাজনৈতিকতা নির্ণয় বা পলিটিকাল হয়ে ওঠা আর রাজনীতি বলতে আমরা যা বুঝি, দলীয় বা মতাদর্শিক/সাংস্কৃতিক বিচার- এই দুই সমার্থক নয়। অর্থাৎ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উপলব্ধি এবং সেই অনুযায়ী শত্র“মিত্র নির্ধারণের প্রশ্নের মীমাংসাই এখন প্রধান রাজনীতি। বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ রাজনৈতিকতার প্রশ্নে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ উপলব্ধি নির্মাণ এবং তাকে সম্মতিতে রূপান্তর। এক্ষেত্রে আংশিক বা জোড়াতালি সমাধানের আর কোনো সুযোগ নাই।
দ্বিতীয়ত, জনগণ বিদ্যমান সংবিধান ও রাষ্ট্রের পরিবর্তন ও সংস্কার চায়। এটা খুশির কথা ডক্টর কামাল হোসেন, যিনি বাংলাদেশের সংবিধান লিখেছেন বলে পরিচয় দেয়া হয়, তিনি নিজেও এখন সংবিধান সংস্কারের কথা বলছেন। তবে তিনি যদি ইতিবাচক কোনো ফল পেতে চান তাহলে তার পুরনো আওয়ামী বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তার খোপ থেকে বেরিয়ে এসে, রাষ্ট্র ও নাগরিকতা সম্পর্কে খোলা মনে ভাবতে হবে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ধারা বা ইসলামপন্থীদের বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের ন্যূনতম সংস্কারও অসম্ভব। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের নামে যে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না শিখলে উদার রাজনৈতিক আদর্শের কোনো ভবিষ্যৎ নাই। যদিও আমি মনে করি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতার কারণে উদার রাজনীতিকে সুযোগ দেয়া উচিত। বিশেষত সমাজের মতাদর্শিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা দুই-এক বছরের কাজ নয়।
তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের আবির্ভাব ঘটেছে। রাজনৈতিকতার পরিগঠনের এখান থেকেই শুরু। অতএব মুক্তিযুদ্ধের নীতি ও আদর্শই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের জাতীয় ঐক্যের সন্ধিস্থল ও প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। এক্ষেত্রে বিতর্ক তৈরি হলে দ্বন্দ্বের সমাধান হবে না। বর্তমান রাজনৈতিক বিভাজন ও সংঘাত আশু নিরসনের কেন্দ্রবিন্দু মুক্তিযুদ্ধ, এতে কোনো সন্দেহ নাই।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র ছিল না। স্বাধীনতার ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এবং বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এই নিশ্চিতকরণের প্রতিশ্র“তি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের শপথ বা প্রতিশ্র“তি। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা যে শপথ ভঙ্গ করে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, ডক্টর কামাল হোসেনসহ যারা এখন ভিন্ন কথা বলছেন, শপথ ভঙ্গের দায় তাদেরই নিতে হবে।
কিন্তু অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ হতে পারে না। বর্তমান ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সন্ধির ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে হবে এবং প্রত্যেক পক্ষকেই তার নীতিগত অবস্থান ঠিক রেখে উদার ও সহনশীল থাকতে হবে।
স্বাধীনতার ঘোষণা জাতীয় ঐক্যের দলিল হয়ে উঠুক আবার। এই আশা করি।
৩১ অক্টোবর, ২০১৪/১৬ কার্তিক, ১৪২১, শ্যামলী, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.