হাসপাতালে ভুতুড়ে অবস্থা

দিনভর অপেক্ষার পর রাতেও বিদ্যুৎ না আসায় হাসপাতালগুলোতে ছিল এক ভুতুড়ে পরিবেশ। মারাত্মক বিঘ্ন ঘটে চিকিৎসা সেবার। বন্ধ থাকে অস্ত্রোপচারসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক সেবা। ঢাকাসহ সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে একই দৃশ্য দেখা যায়। রাতে মোমবাতি, টর্চ লাইট জ্বালিয়ে কাজকর্ম চলে হাসপাতালগুলোতে। দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় হাসপাতালের নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জরুরি বিভাগ, সিসিইউ, আইসিইউ অপারেশন থিয়েটার চলছিল জেনারেটর সার্ভিসের মাধ্যমে। কোথাও কোথাও পানির সংকটও দেখা দেয়। এদিকে হঠাৎ এ বিপর্যয় হওয়ায় পূর্ব থেকে কোন প্রস্তুতিও নেয়নি কর্তৃপক্ষ। বিদ্যুৎ আসবে কিনা সে ব্যাপারেও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যেই ছিলেন কর্তব্যরত সেবাদাতারা। দুপুর ২টরি দিকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, জরুরি বিভাগ ও ক্যান্টিন ছাড়া সবই ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। ৪নং মহিলা ওয়ার্ডে ১০৫ জন রোগী ছিলেন। এর অনেকেই ছিলেন ফ্লোরে। সেখানে কর্তব্যরত দু’জন নার্স চার্জার লাইট জ্বেলে কাজ করছিলেন। কর্তব্যরত এক নার্স জানালেন, আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর থেকে জেনারেটর চলছিল। কিন্তু দু’ঘণ্টা সার্ভিস দেয়ার পর সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে খুবই অসুবিধা হচ্ছে। গরমে অনেকেই বাইরে বেরিয়ে আসেন। কর্তব্যরত কর্মকর্তারাও বাইরে বারান্দায় ছিলেন। অনেক রোগীর স্বজনরা জানান, মোবাইল ফোনে চার্জ না থাকায় তারা পরিবারের সঙ্গেও অনেক প্রয়োজনীয় বিষয়ে যোগাযোগ করতে পারছেন না। ওই হাসপাতালের ৫নং পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন ৭০ জন রোগী। রোগী ও স্বজনের ভিড়ে গিজগিজ করছে। অন্ধকারে চলাফেরা করতে ধাক্কাধাক্কি অবস্থা। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর থেকেই অন্ধকার সেখানে। হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগটিও বন্ধ ছিল। সেখানে কর্তব্যরতরা অপেক্ষায় ছিলেন কখন বিদ্যুৎ আসবে। ইন্টার্ন টেকনোলজিস্ট আল আমীন বলেন, সকাল থেকেই তিনি বসে আছেন কখন বিদ্যুৎ আসবে। বেশ কিছু জরুরি পরীক্ষা নিরীক্ষা রয়েছে তার হাতে। অল্প সময়ের জন্য জেনারেটর সার্ভিস চালু হলেও কাজ হয়নি। এমনকি ইমারর্জেন্সি কোন পরীক্ষাও করাতে পারছেন না তারা। পার্শ্ববর্তী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটেও একই অবস্থা দেখা গেছে। সেখানেও চালু রয়েছে শুধুমাত্র জরুরি বিভাগ, সিসিইউ, আইসিইউ এবং অপারেশন থিয়েটার। এ বিভাগগুলো চলছিল জেনারেটর সার্ভিসের মাধ্যমে। বিদ্যুৎ না থাকায় অন্যান্য বিভাগগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে দেখা যায় পুরো অন্ধকার। সেখানে কর্তব্যরত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হিমাংশু জানান, বিদ্যুৎ যাওয়ার পর ২ ঘণ্টা জেনারেটরের মাধ্যমে সার্ভিস দেয়া হয়েছে। এরপর থেকেই অন্ধকারে। কোন টেস্টই এখন আর হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন এটা খুবই জরুরি বিভাগ কিন্তু বিদ্যুতের অভাবে সেবা থেমে গেছে। এমনকি আইসিইউ, সিসিউই বিভাগের রোগীদেরও জরুরি ব্লাড টেস্ট বন্ধ রয়েছে। বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে দেখা যায় ভুতুড়ে অন্ধকারে মিটমিট করে জ্বলছে মোমবাতির আলো। ওই আলোতে যতটুকু সম্ভব টেস্ট করা হচ্ছে। কিন্তু মুশকিল হলো রিপোটগুলো ডেলিভারি দেয়া নিয়ে। একটি কম্পিউটার কোন রকমে সচল আছে। তাও যে কোন সময়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইউপিএসের ব্যাকআপ নিয়ে চলছে সেটি। বন্ধের পথে সেটিও। সেখানে দেখা গেল বেশ কয়েকজন রোগীর স্বজন জরুরি টেস্ট করানোর জন্য অপেক্ষমাণ। বন্ধ রয়েছে এক্সরে, ইসিজি’র মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষাও। ওই হাসপাতালের পিসিইউ বিভাগে হাপিত্যেশ করছিলেন বেশ কয়েকজন রোগী। কেউ কেউ বাইরে থেকে হাতপাখা কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেবাদানকারী একজনকে দেখা গেল তিনি মোবাইলের আলোয় সেবা দিচ্ছেন।
এদিকে দিনভর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে বিদ্যুৎহীন হাসপতালের দুর্ভোগের করুণ চিত্র। হাসপতালের চিকিৎসক, সেবিকা, কর্মকর্তা, কর্মচারী রোগী ও তাদের স্বজনরা দিনভর হাপিত্যেশ করেছেন কখন বিদ্যুৎ আসবে। তবে একাধিক জেনারটের দিয়ে হাসপতালে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা কিছুটা সচল থাকলেও তা ছিল চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ভূক্তভোগীরা বলেছেন হাসপাতালের এমন দুর্ভোগ স্মরণাতীতকালের মধ্যে আর আসেনি। সংশ্লিষ্টরা জানায়, সকাল সাড়ে ১১টা থেকে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের শুরু। বিকাল ৩টা পর্যন্ত তা চলে। ৩টার পরে বিকল্প ব্যবস্থায় ঢামেকে বিদ্যুৎ চালু হলেও কিছুক্ষণ পরেই আবার বিদ্যুৎ চলে যায়। বিশাল এ হাসপাতালের নির্ভর করতে হয় মাত্র ৫টি জেনারেটরের ওপর। হাসপাতাল ঘুরে ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এখানে জেনারেল ওটি রয়েছে মোট ১৬টি। তবে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সময় চলেছে মাত্র সাতটি। নাক, কান, গলা বিভাগ, অর্থোপেডিক্স বিভাগ, সিজারিয়ান বিভাগ চালু থাকলেও এসব বিভাগে অস্ত্রোপচার হয়েছে অন্যান্য দিনের তুলনায় খুবই কম। হাসপাতালের আইসিইউ, সিসিইউ চলেছে জেনারেটরের সাহায্যে। বিদ্যুৎ না থাকার কারণে বন্ধ রয়েছে রেডিওলজি বিভাগ। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে আলট্রাসনোগ্রাম, এমআরআই, সিটিস্ক্যান ছিল বন্ধ। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েন এসব বিভাগে পরীক্ষা করাতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা। এদের মধ্যে অনেকেই হাসপাতাল ত্যাগ করে বিকল্প ব্যবস্থার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকেন। বাড্ডা থেকে সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য স্ত্রী সেলিনা আক্তারকে ঢামেকে নিয়ে এসেছিলেন তার স্বামী নজরুল ইসলাম। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারা হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন। নজরুল ইসলাম জানান, বেলা ১১টার সময় স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। চার ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বিদ্যুতের দেখা নেই। তাই হাসপাতাল ত্যাগ করছেন। চলে যাবেন কোন বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। একই কথা শোনালেন রাজধানীর মিরপুর থেকে আসা বিল্লাল হোসেন। ছোট ভাই ইমনের পা ভেঙেছে। তাকে নিয়ে তিনি এসেছিলেন ভাঙা পায়ের এক্স-রে করাতে। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করেও এক্স-রে করাতে পারেননি তিনি। ব্যথায় কাতর ইমনকে নিয়ে বিল্লাল হোসেন যান পাশের কোন বেসরকারি ক্লিনিকে। দুপুর ২টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিচতলার ১১৩ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় ওয়ার্ডজুড়ে অন্ধকার। রোগীরা এই অন্ধকারের মধেই কেউ বসে আছেন কেউবা শুয়ে আছেন। আবার কেউবা ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। তবে কারও কারও বেডের পাশেই দেখা গেছে মোমবাতি জ্বলছে। কেউ জ্বালিয়ে রেখেছেন মোবাইলের বাতি। রোগী জাকির হোসেন জানান, তার পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। কিন্তু সকাল থেকে তিনি ওষুধ পথ্য কিছুই খেতে পারেননি। বিদ্যুৎ নেই, তাই চিকিৎসক নার্সরা আসেননি। অনেক ওয়ার্ডের বাথরুমেও পানি নেই। তাই বাইরে থেকে পানি কিনে এনে বাথরুমের কাজ সারছেন অনেকে। তীব্র গরম থেকে রেহাই পেতে হাত পাখা দিয়ে রোগীদের বাতাস করছেন কেউ কেউ। অস্ত্রোপচার করা রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হন। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের পাশেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বার। দুপুরে একাধিক চেম্বারে গিয়ে দেখা যায় তা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। চিকিৎসকদের সহকারীরা জানান, বিদ্যুৎ নেই তাই স্যারেরাও (চিকিৎসক) নেই। জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায় বিদ্যুতের বিকল্প জেনারেটর দিয়ে কোনমতে কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। জরুরি ও ক্যাজুয়ালিটি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. কে এম রিয়াজ মোর্শেদ বলেন, জেনারেটর জরুরি বিভাগের কাজ চলছে কোনমতে। মেজর অপোরেশনগুলো এভাবেই চালিয়ে নিতে হচ্ছে। তবে কতক্ষণ তা চালু রাখা যাবে সেটাই প্রশ্ন। জরুরি বিভাগের এক্সরে রুমের সামনে গিয়ে দেখা যায় প্রচ- ভিড়। এক্স-রে মেশিন চলছে জেনারেটরে। ফলে স্বাভাবিক সময় লাগছে দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেশি। আশঙ্কা প্রকাশ করে হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, হাসপাতালের ৫টি জেনারেটরের ৫টিই সচল রয়েছে। যেকোন একটি জেনারেটর অচল হলেই দুর্ভোগের মাত্রা বেড়ে যাবে। তাই জেনারেটর যাতে অচল না হয়ে পড়ে সে দুশ্চিন্তাও করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, হাসপাতালের রোগীদের খাবার সরবরাহে যাতে বিঘ্ন না ঘটে এজন্য দুই ট্রাক পানি অগ্রিম কিনে রাখা হয়েছে। আর জেনারেটর চালানোর মতো জ্বালানিও রিজার্ভ রেখে কাজ চালিয়ে নিতে হচ্ছে। তবে হাসপাতালের ইতিহাসে এমন বিপর্যয় ও দুর্ভোগ অতীতে হয়নি বলেও তিনি জানান। এদিকে বিকালে একবার ঢাকা মেডিকেল ও বিএসএমএমইউতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হলেও সন্ধ্যায় তা আবার চলে যায়।

No comments

Powered by Blogger.