আমরা কোন পথে এগোচ্ছি? by সজল চৌধুরী

প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, আমাদের দেশে পর্যাপ্ত উচ্চশিক্ষার অবকাঠামোগত অভাব আর গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় প্রতিবছর দেশের মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থীদের দেশের বাইরে আসতে হয় উচ্চশিক্ষার জন্য। আমিও ব্যতিক্রম নই। এ কথা হলফ করে বলতে পারি, উপযুক্ত অর্থায়ন আর উচ্চশিক্ষার পরিবেশ থাকলে হয়তো দেশেই এসব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী থাকত।
এখানে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ বলতে শুধু শ্রেণিকক্ষ আর পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় গবেষণাগারের অভাব, উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব, যা আমাদের উচ্চশিক্ষার পরিবেশকে ব্যাহত করছে সব সময়। সংগত কারণেই উচ্চশিক্ষার জন্য আমাকে বর্তমানে জাপানের সাপ্পোরো শহরে অবস্থিত হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হয়েছে, যার অর্থায়ন করছে জাপান সরকার।
এখানে এসে প্রথমেই মনে হয়েছে, আমাদের বাংলাদেশ আজ কোন পথে এগোচ্ছে? এমনটা মনে হওয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি! প্রথম দিন থেকেই জাপানে আমাদের যে বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, সেটি হলো এখানকার ময়লা-আবর্জনার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ওপর। বিষয়টি এমন, আমরা ঘরে-বাইরে যে ময়লা-আবর্জনা সৃষ্টি করে থাকি, সেগুলো যেখানে-সেখানে না ফেলে নিজ থেকেই বিভিন্ন ধরনের ব্যাগে পচনশীল আর অপচনশীল দ্রব্য আলাদা করে ফেলা। যেমন রান্নাঘর থেকে যে উচ্ছিষ্ট পচনশীল দ্রব্যাদি সৃষ্টি হয়, সেগুলো নির্দিষ্ট হলুদ রঙের ব্যাগে রাখতে হবে। তা ছাড়া প্লাস্টিকজাত বোতল, কাগজ, বিভিন্ন ধরনের ক্যান, কাচজাতীয় দ্রব্য ইত্যাদি আলাদা আলাদা ব্যাগে (সাদা রং) সংরক্ষণ করতে হবে। পরে সেগুলো নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে ÿ(প্রতিস্থাপনার সামনে অবস্থানরত) দিয়ে আসতে হবে।
উল্লেখ্য, কেউ যদি কোনো কারণে ভুল জায়গায় রাখে কিংবা ভুলভাবে সংরক্ষণ করে, তাহলে সেখানে অবস্থানরত সিসি ক্যামেরায় সেটি ধরা পড়বে এবং নির্ঘাত আপনার নামে রিপোর্ট হবে, এমনকি পুলিশও চলে আসতে পারে বাড়ির দরজায়। এখন প্রশ্ন হলো ময়লা-আবর্জনা সংরক্ষণে এমন কঠোর ব্যবস্থাপনা থাকার কারণ কী?
এ প্রসঙ্গে হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মাতসুতোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। প্রথম উদ্দেশ্য পুরো শহরটাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং প্রতিদিন যে পরিমাণ ময়লা-আবর্জনা নির্গমন হয় পুরো শহর থেকে, সেগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপে পরিশোধনের পরিকল্পনা থেকেই এমন ব্যবস্থাপনা। তাই কেউ যদি তার বাসা থেকেই ময়লাগুলো ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী শুরুতেই আলাদা করে ফেলে, তাহলে খুব সহজেই উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় সেগুলো কাঙ্ক্ষিতরূপে পরিশোধন, পরিমার্জন আর পরিবর্ধন করা সম্ভব। আর এ থেকে জাপান সরকার একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে, অন্যদিকে ঠিক তেমনি পর্যাপ্ত ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট পলিসি থাকার দরুন শহরের কোথাও এতটুকু আবর্জনা দেখা যায় না। তা ছাড়া সঠিক পরিকল্পনার দরুন তারা তাদের অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তুলছে, এতে করে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
অথচ আমাদের বাংলাদেশে হচ্ছে ঠিক তার উল্টো। যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলছি আমরাই। এমনকি ডাস্টবিন থাকলেও সেখানে আবর্জনা না ফেলে ফেলছি ঠিক এর বাইরে, পরিবেশ দূষণ করছি দিনের পর দিন। আমাদের কারও কোনো মাথাব্যথা নেই ময়লা-আবর্জনাকে কীভাবে সম্পদে পরিণত করা যায়, এ সম্পর্কে। অথচ খুব সহজেই এ বিষয়ে আমাদের দেশে সুপরিকল্পিত একটি পলিসি (ব্যবস্থাপনা) কার্যকর করা যেতে পারে এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনা করা যেতে পারে। এ কথা অনস্বীকার্য, আমাদের দেশ আয়তনের দিক থেকে ছোট হলেও মানবসম্পদ আর প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে আমরা বড় বড় দেশকে হার মানাতে সক্ষম—শুধু আমাদের মনোভাব পরিবর্তন আর দেশ সম্পর্কে মূল্যবোধ ধরে রাখার মাধ্যমে।
জাপানের সাপ্পোরো শহরের লোকসংখ্যা অনেক কম হলেও এত বড় শহরকে এতটা পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব হয়েছে তাদের উন্নত নাগরিক মনোভাব আর সচেতনতার মাধ্যমে। ‘নিজের কাজ নিজে করি’—এই স্লোগানে এখানে সবাই এক এবং একতাবদ্ধ। আর এ কারণে আমাদের দেশে যখন উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তার অধীনে থাকেন দু-চারজন কর্মচারী, ঠিক সেখানেই জাপানে দেখছি একজন প্রফেসরকে পাবলিক যানবাহনে, কখনো বা সাইকেল চালিয়ে আর হেঁটে যাতায়াত করতে, নিজের কফি নিজে বানিয়ে খেতে, নিজেই নিজের সব কাজ গুছিয়ে রাখতে। যার দরুন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার প্রভাব নেই বললেই চলে। যেকোনো অফিস-আদালতে গেলে এই সত্য সহজেই চোখে পড়ে। কোনো ঝামেলা ছাড়াই সচেতনভাবে হাস্যোজ্জ্বল মুখে জনগণের সেবা করার জন্য সরকারি কর্মকর্তারা দৌড়ে এগিয়ে আসছেন। কোথাও কোনো সংঘাত, হানাহানি আর ক্ষমতার দাপট নেই। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই। সকাল থেকে রাত অবধি সবাই নিজের কাজ করে যাচ্ছেন।
আর আমাদের দেশে সরকারি অফিস–আদালতের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। নেহাত খুব বেশি প্রয়োজন না হলে আমাদের কেউ সরকারি অফিস-আদালতের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়তে চায় না। অন্যদিকে, সাপ্পোরো শহরের পুরো বিন্যাস করা হয়েছে মূলত পাবলিক ট্রান্সপোর্টকে (সাবওয়ে) মাথায় রেখে। এই অল্প কয়েক দিনে যতটুকু দেখা হয়েছে, কোথাও বড় ধরনের কোনো উড়ালসেতু নেই। শহরের মধ্যে যাতায়াতের পরিকল্পনা করা হয়েছে ভূগর্ভস্থ ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে। যার দরুন শহরের অভ্যন্তরে সড়কপথে কোনো যানজট চোখে পড়ে না।
পৃথিবীর এক প্রান্ত যখন এগোচ্ছে সামনের দিকে, ঠিক তখনই আমরা এগোচ্ছি তার উল্টো দিকে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মোটেও কাম্য নয়। অথচ রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজস্ব অবস্থান থেকে একটু সদিচ্ছা আর দেশাত্মবোধই এনে দিতে পারে সুপরিকল্পিত একটি শহর ও উন্নত নাগরিক জীবন।
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিউম্যান এনভায়রনমেন্টাল সিস্টেম’-এর ওপর গবেষণারত)।
sajal_c@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.