সমকালীন প্রসঙ্গ-ধর্ষণসহ অন্য অপরাধের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মূলত হতে হবে রাজনৈতিক সংগ্রাম by বদরুদ্দীন উমর

বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক রোগের যেমন একটা সামাজিক ভিত্তি থাকে, অপরাধের ক্ষেত্রেও তেমনি। ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশে যেসব রোগ সাধারণভাবে দেখা যায় তার সঙ্গে এশিয়া-আফ্রিকায় যেসব রোগ বেশি দেখা যায় তার পার্থক্য আছে।
সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার ওপরই এটা নির্ভর করে। এ কারণে আমাদের দেশেও শহর ও গ্রামাঞ্চলে যেসব রোগের দেখা সাধারণভাবে পাওয়া যায় তার মধ্যেও পার্থক্য থাকে।
অপরাধের যে সামাজিক ভিত্তি আছে, এর সঙ্গে যে দেশের আর্থসামাজিক বন্ধনের সম্পর্ক আছে, এটা সহজেই বোঝা যাবে যদি আমরা আমাদের দেশে ব্রিটিশ, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশ আমলের তুলনা করি। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমান বাংলাদেশে অপরাধের যে আধিক্য ও বৈচিত্র্য দেখা যায়, সেটা পূর্ববর্তী দুই আমলে দেখা যেত না। অপরাধ থাকলেও তার সংখ্যা সামান্যই ছিল। এর তাৎপর্য বোঝার জন্য পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে এ অঞ্চলে আর্থসামাজিক ভিত্তিভূমি ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটেছে তার হিসাব নিতে হবে।
অপরাধপ্রবণতা একটা মানসিক বিকার। এই বিকার সৃষ্টির ক্ষেত্রে সামাজিক পরিস্থিতির প্রভাবই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যৌন অপরাধ এদিক থেকে কোনো ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে এবং অন্যান্য দেশেও এখন যেভাবে যৌন অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে ধর্ষণের মতো পাশবিকতা যেখানে হয়ে দাঁড়িয়েছে নিত্যদিনের ঘটনা, সেখানে একে শুধু কিছু সংখ্যক অপরাধীর বিচ্ছিন্ন ব্যাপার মনে করা এক অবৈজ্ঞানিক চিন্তা। এর কারণ প্রত্যেক দেশেই তার সমাজভূমির মধ্যে সন্ধান করতে হবে।
মানুষের প্রকৃতির মধ্যে কিছু আদিম প্রকৃতি আছে। এই প্রকৃতিগুলো মাথাচাড়া দিলেই অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ যদি না হতো, তাহলে মানুষের পক্ষে সমাজে বসবাস করা, সভ্যতা সৃষ্টি করা, সভ্য জীবনযাপন করা সম্ভব হতো না। এই নিয়ন্ত্রণ মোটামুটি তিনভাবে হয়ে থাকে। প্রথমত, সামাজিক পর্যবেক্ষণ ও সতর্কতা। সমাজ ও সামাজিক জীবন রক্ষা ও যথাসাধ্য মসৃণ রাখার তাগিদে সমাজ একটি যৌথ ব্যবস্থা হিসেবে তার মধ্যে বসবাসকারীদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে এবং সমাজবিরোধী কাজ যাতে হতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। এই পর্যবেক্ষণ ও সতর্ক দৃষ্টির অভাব ঘটলে অপরাধ বৃদ্ধি পায়। অন্য দেশের কথা বাদ দিয়ে আমাদের দেশের কথা ভাবলে দেখা যায় যে, এখানে শহরাঞ্চলে অপরাধ বৃদ্ধি অনেক হয়েছে, যার মধ্যে যৌন অপরাধ অন্যতম। গ্রাম থেকে একজন যখন শহরে চলে আসে তখন গ্রামে সে যে সামাজিক পর্যবেক্ষণের মধ্যে থাকত সেটা আর থাকে না। সে শহরে এক ধরনের পরিচয়হীন জীবনযাপন করে। এটা তার মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি করে এবং তাকে অপরাধের প্ররোচনা জোগায়। গ্রামে তার মধ্যে অপরাধপ্রবণতা না থাকলেও শহরে সে প্রবণতা তার মধ্যে সৃষ্টি হয়। লজ্জা বা সামাজিক সমালোচনার কোনো ব্যাপার না থাকায় অনেকখানি নিশ্চিন্তে সে যৌন অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধ করতে নিযুক্ত হয়। সকলের ক্ষেত্রেই যে এটা ঘটে তা নয়, সেটা হতে পারে না। কিন্তু যারা গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে এসে অপরাধকর্মে লিপ্ত হয় তাদের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। এর অর্থ এই নয় যে, গ্রামে কোনো অপরাধ হয় না। অবশ্যই হয়, কিন্তু আনুপাতিকভাবে তার সংখ্যা গ্রামাঞ্চলে কম, যদিও দেশে সাধারণভাবে অপরাধের একটা 'সংস্কৃতি' গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আজকাল গ্রামাঞ্চলেও অপরাধের সংখ্যা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
দ্বিতীয় যে কারণে অপরাধ বৃদ্ধি হয় তা হলো, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না থাকা। এটা প্রধানত ঘটে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশি ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতি বৃদ্ধির কারণে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে দুর্নীতিপরায়ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের তৎপরতা। মাত্র কয়েকদিন আগে ঢাকার এক কারাগার থেকে বিকাশ নামে এক বিপজ্জনক ও বড়মাপের অপরাধীকে বেআইনিভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদারকিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে! স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মালিকদের চরম দুর্নীতির সঙ্গে এ কাজ যে যুক্ত এতে কারও কোনো সন্দেহ নেই! এমনকি আদালতেরও এ সন্দেহ নেই। এ জন্য এই অপরাধীকে কেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে গোপনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এর কারণ দর্শানোর জন্য তারা তাদের ওপর নোটিশ জারি করেছেন! এই যখন অবস্থা তখন বোঝার অসুবিধা নেই যে, বাংলাদেশে এখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কী ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। অপরাধীর শাস্তির সম্ভাবনা এখানে দিন দিন কমে আসছে। ক্ষমতাধর রাজনৈতিক ব্যক্তি ও পুলিশের যৌথ দুর্নীতির কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় অপরাধ সাধারণভাবে এবং তার সঙ্গে যৌন অপরাধ, যৌন পাশবিকতা অস্বাভাবিকভাবে সারাদেশে, বিশেষত শহরাঞ্চলে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তৃতীয় যে কারণে অপরাধ বৃদ্ধি হচ্ছে তা হলো, এ ক্ষেত্রে শিক্ষার অভাব। আগে স্কুলশিক্ষার সঙ্গে গৃহশিক্ষা বলে একটা ব্যবস্থা ছিল। এ শিক্ষা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সকলেই পেত। সুশিক্ষার ব্যবস্থা যেমন থাকত স্কুলে, তেমনি থাকত পারিবারিক জীবনে। এখন সেই শিক্ষা ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। স্কুলে শিক্ষার নামে ব্যবসার প্রাধান্য স্থাপিত হয়েছে। তার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি এখন রাজত্ব করছে। শিক্ষকদের আগেকার মর্যাদা আর ছাত্রদের কাছে নেই। ছাত্ররা শিক্ষকদের থেকে পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষা যাই পাক সুশিক্ষা বলতে যা বোঝায় তার কিছুই পায় না। কাজেই গৃহশিক্ষক ও স্কুলশিক্ষক আগে একজনের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা যেভাবে রোধ করতেন বা দমিয়ে রাখতেন এখন সেটা আর হচ্ছে না। উপরন্তু অল্প বয়সেই মানুষ নিজের পরিবার এবং স্কুল থেকেই নানা ধরনের অপরাধের তালিম নিচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন প্রতিদিনই যৌন অপরাধ শহর ও গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ঘটছে। হাজার হাজার যৌন অপরাধ এমনকি ধর্ষণের মামলা আদালতে ঝুলছে। কিন্তু তার কোনো বিচার হচ্ছে না। বিচার না হওয়ায় অপরাধী শাস্তির বাইরে থাকছে। এটা যে অপরাধপ্রবণতা এবং কার্যক্ষেত্রে অপরাধ বৃদ্ধি হতে থাকার প্রধান কারণ, এতে সন্দেহ নেই। যৌন অপরাধের প্রসঙ্গে প্রায় সবসময়ই পুরুষতান্ত্রিকতার কথা বলা হয়ে থাকে। নারী ধর্ষণ পুরুষের কৃত একটা বড়মাপের অপরাধ। কিন্তু একে পুরুষতান্ত্রিকতা বলে অভিহিত করা ঠিক নয়। বাংলাদেশে আগের থেকে এখন পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাব কমেছে। নারীর ক্ষমতায়ন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই নারী ধর্ষণকে পুরুষতান্ত্রিকতা মনে করে তার প্রতিকার চেষ্টা করলে তাতে কোনো সুফল নেই। আসলে এটা এক অপরাধ এবং বাংলাদেশে সাধারণভাবে অপরাধ বৃদ্ধির সঙ্গেই এর সম্পর্ক।
আগেই বলা হয়েছে যে, সাধারণ রোগের মতো অপরাধেরও সামাজিক ভিত্তি আছে। কাজেই অপরাধ সমাজ থেকে নির্মূল করার জন্য মূলত প্রয়োজন সমাজের ভিত্তিভূমির মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো। এই পরিবর্তন ঘটলে তার স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে অপরাধপ্রবণতা এবং অপরাধের সংখ্যা কমবে। কাজেই যারা সত্যি অর্থে দেশ থেকে ধর্ষণের মতো যৌন অপরাধ থেকে অন্য নানা অপরাধ একেবারে নির্মূল করতে না পারলেও তা প্রায় নির্মূল করতে চান, তাদের সংগ্রাম করতে হবে সমাজের ভিত্তিভূমি, সমাজে বিদ্যমান আর্থসামাজিক সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের জন্য। তবে যে পর্যন্ত সে পরিবর্তন না হয়, সে পর্যন্ত অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা যাতে হয় তার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। এ সংগ্রামকে নৈতিক সংগ্রাম মনে করা এক চরম বিভ্রান্তি। এটা মূলত রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই হতে হবে এই সংগ্রামের অনিবার্য লক্ষ্য।
১৪.১.২০১৩

বদরুদ্দীন উমর :সভাপতি
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.