বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করার চেষ্টা চলছে- একুশের বইমেলা উদ্বোধনীতে প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা হাজার বছরের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও বিভিন্ন ভাষণে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ঐতিহ্যের কথা বলেছেন।
বাঙালী জাতীয়তাবাদে অহমিকা নেই বরং আছে পরমতসহিষ্ণুতা ও বিভিন্ন ধর্ম সমপ্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশের অঙ্গীকার। এই জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের রাষ্ট্রের অসত্মিত্বই হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে। তিনি ৰুদ্র জাতিসত্তার মাতৃভাষা সংরৰণে তাঁর সদিচ্ছা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, এ কথা মনে রেখেই সরকারের পৰ থেকে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কাজ শুরম্ন করা হয়। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ৰমতায় এসে এই ইনস্টিটিউটের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। বর্তমান সরকার আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের নির্মাণকাজ নতুন করে শুরম্ন করেছে বলে তিনি উলেস্ন-খ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের বিশ্ব স্বীকৃতির সূত্রপাত হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকেই। বঙ্গবন্ধু এর সূচনা করেছিলেন। তিনি ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে তাঁর প্রথম ভাষণ বাংলায় দিয়ে বাংলা ভাষাকে আনত্মর্জাতিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তারই ফলে প্রবাসীদের সহযোগিতা এবং বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় একুশ ফেব্রম্নয়ারি আনত্মর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি লাভ করে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাঁর বাংলায় ভাষণ দেয়ার কথা উলেস্ন-খ করেন।
প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রকাশকদের প্রতি প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি নতুন লেখকদের বই প্রকাশ করে তাদের উৎসাহিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি সোমবার বিকেলে বাংলা একাডেমীর রবীন্দ্র চত্বরে মহান একুশে বইমেলা-২০১০ এর উদ্বোধনকালে এই আহ্বান জানান।খবর বাসসর।
জাতির প্রত্যাশা পূরণে বাংলা সাহিত্যের গবেষণা, অনুবাদ, প্রকাশনা ও সংশিস্ন-ষ্ট কাজে আনত্মরিক হওয়ার জন্যে বাংলা একাডেমীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে সরকারের পৰ থেকে বাংলা একাডেমীকে সকল প্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
শেখ হাসিনা একুশের বইমেলাকে লেখক, প্রকাশকদের মিলনমেলা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, "বই প্রকাশের পাশাপাশি এখানে আপনাদের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে।" একটি ভাল মানের বই প্রকাশে লেখক ও প্রকাশকদের যৌথ ভূমিকার ওপর গুরম্নত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, লেখকদের উৎসাহিত না করলে যেমন একটি ভাল মানের বই পাওয়া যায় না, তেমনি প্রকাশকও বই প্রকাশ করে আর্থিকভাবে লাভবান না হলে নতুন বই প্রকাশে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বাংলা একাডেমীর চেয়ারম্যান জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিন, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মহিউদ্দিন আহমেদ এবং বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান । উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা, শিৰাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশকসহ সর্বসত্মরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাংলা একাডেমীর কর্মকা- তুলে ধরে বলেন, এই একাডেমীকে জাতির অহঙ্কার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য চাই নিষ্ঠাবান কমর্ী গবেষক কর্মকর্তা_ যারা জাতির আকাঙ্ৰাকে ধারণ করে কাজ করে যাবেন।
শিৰা ৰেত্রে বর্তমান সরকারের দেয়া বিশেষ গুরম্নত্বের কথা উলে-খ করে তিনি বলেন, বাজেটেও শিৰার জন্য বিপুল ব্যয় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। শিৰার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগও বিশেষ জরম্নরী। কারণ মনুষ্যত্বের বিকাশ এবং মানবিক চেতনার প্রসারের জন্য শিৰা ও সংস্কৃতি সংযোগ অপরিহার্য।
প্রধানমন্ত্রী বাংলা একাডেমীর আয়োজিত একুশের বইমেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করে মেলার সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর প্রধানমন্ত্রী বইমেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে ঘুরে দেখেন। এবারের বইমেলায় ৩৫৬টি প্রকাশনা সংস্থার ৫০৫টি স্টল রয়েছে। গত ২০০৯ সালের বইমেলায় ২৯৭টি প্রকাশনা সংস্থার ৪৬০টি স্টল ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে গিয়ে ঝরেছে অনেক রক্ত। খালি হয়েছে অনেক মায়ের কোল। পাকিসত্মান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে শাসক গোষ্ঠী উদর্ুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য উঠেপড়ে লাগে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রম্নয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন আইন পরিষদে ঘোষণা দেন যে, পূর্ব পাকিসত্মানের জনগণ উদর্ুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে। তার এই ঘোষণার বিরম্নদ্ধে ছাত্রলীগসহ গোটা ছাত্রসমাজ বিৰোভে ফেটে পড়ে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসত্মাবের প্রেৰিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
তিনি বলেন, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ জনগণকে সজাগ করতে প্রচারাভিযান শুরম্ন করে। অফিস-আদালত-শিৰা প্রতিষ্ঠানে গণসংযোগ করতে থাকে। ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়। ছাত্রদের বিৰোভের সময় ওইদিন বঙ্গবন্ধুসহ অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। সাধারণ ছাত্র-জনতা রাসত্মায় নেমে আসে এবং প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। তারই ফলশ্রম্নতিতে মুসলিম লীগ সরকার ১৫ মার্চ বন্দীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এরপর থেকে ১১ মার্চ ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে।
তিনি বলেন, ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ভাষার দাবিতে একটি ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। এক পর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ এবং টিয়ারগ্যাস নিৰেপ করে সভা বানচালের চেষ্টা করে। প্রতিবাদে ছাত্ররা পরের দিন সারাদেশে শিৰা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে এক জনসভায় ঘোষণা দেন, 'উর্দুই হবে পাকিসত্মানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।' জনসভায় উপস্থিত ছাত্ররা সঙ্গে সঙ্গে এই ঘোষণার প্রতিবাদ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আবারও একই ঘোষণা দিলে উপস্থিত ছাত্ররা তারও প্রতিবাদ জানায়।
তিনি ভাষা আন্দোলনের প্রেৰাপট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ ভূমিকার তুলে ধরে বলেন, ১১ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান। ভাষার দাবি এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবি আদায়ের জন্য অবস্থান ধর্মঘট করার সময় ১৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। জুলাই মাসের শেষে তিনি মুক্তি পান। তিনি বলেন, ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর খাদ্য সঙ্কটের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ঢাকায় ভুখা মিছিল বের করে। মিছিল থেকে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে অন্যদের ছেড়ে দেয়া হলেও বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া হয়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই আবারও ঘোষণা দিলেন পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা হবে উদর্ু। এ সময় বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে তিনি ছাত্রদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন এবং আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারই প্রেৰিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি দাবি দিবস পালনের সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়। এ সময় তাঁকে ফরিদপুর জেলে স্থানানত্মর করা হয়। সেখানে তিনি ১৪ ফেব্রম্নয়ারি অনশন শুরম্ন করলে ১৬ ফেব্রম্নয়ারি তাকে আবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধু ২১ ফেব্রম্নয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, ২১ ফেব্রম্নয়ারি পুলিশের গুলিতে রফিক, জব্বার, বরকত, সালামসহ অনেক নাম না জানা ছাত্র-জনতা শহীদ হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগ সদস্যগণ শাসনতন্ত্রে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সংসদে সংগ্রাম শুরম্ন করেন। তারই ফলশ্রম্নতিতে ১৯৫৬ সালে শাসনতন্ত্রে উদর্ুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং ওই দিনকে সরকারী ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার। তখন থেকেই ২১ ফেব্রম্নয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

No comments

Powered by Blogger.