গোলটেবিল বৈঠক- মানব পাচার প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি

মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে দেশে যুগান্তকারী আইন আছে। তিন বছর মেয়াদি (২০১২-১৪) একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনাও আছে। বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও পাচার প্রতিরোধ ও দমনে কাজ করছে। কিন্তু তার পরও মানব পাচার কমেনি।
এ ক্ষেত্রে সরকারের আন্তমন্ত্রণালয়সহ সব ক্ষেত্রেই সমন্বয় জরুরি।
অন্যদিকে শুধু ভালো আইন বা কর্মপরিকল্পনা থাকলেই হবে না, সঠিক প্রয়োগ এবং বাস্তবায়নও জরুরি। আর আইনের সঠিক প্রয়োগের জন্যই গত বছর থেকে কার্যকর হওয়া মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনটির বিধিমালা দ্রুত তৈরি করতে হবে। সরকারকে আইনটির প্রচার এবং আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে।
গতকাল সোমবার ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন: বর্তমান পরিস্থিতি ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। মানব পাচারসংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দ্বিতীয় সারির (ওয়াচলিস্ট ২) পর্যবেক্ষণ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তৃতীয় স্তরে যাতে দেশটি না পৌঁছায়, সেদিকে নজর দেওয়ার জন্যও আহ্বান জানান আলোচকেরা।
কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। এতে সহযোগিতা করে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
বৈঠকে প্রধান অতিথি আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, সরকার মানব পাচার প্রতিরোধে বেশি নজর দিচ্ছে। তবে কেউ যদি পাচারের শিকার হয়েই যায়, তাহলে আইনের প্রয়োগ করে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতেও সরকার বদ্ধপরিকর। বর্তমানে আইনটি নতুন। নতুন আইন হিসেবে এতে ঘাটতি আছে। আইনের আওতায় তদন্তের ক্ষেত্রেও ঘাটতি আছে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত ও কার্যকর করতে আইনটির বিধিমালা তৈরি করা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাইন উদ্দিন খন্দকার বলেন, মানব পাচারের পেছনে বেকারত্ব, আর্থিক অসচ্ছলতাসহ একাধিক বিষয় সম্পৃক্ত। তিনি অতীতে ফৌজদারি আদালতে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, পাচারের মতো মামলাগুলোতে রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা পাওয়া যায় না। উল্টো এরা চাপ সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, দেশে পাচারের ঘটনা কমেনি, বরং বেড়েছে। দেশের একাধিক এনজিও পাচার প্রতিরোধের চেয়ে পাচারের শিকার ব্যক্তিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে। এতে পাচারের শিকার একই রহিমাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য তিন-চারটি এনজিও আবেদন করছে। ফলে ফিরিয়ে আনা আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। তাই একই ধরনের কাজ সবাই না করে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
মানব পাচার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক কাজী জিয়া উদ্দিন। তিনি বলেন, পাচার মাদকের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। অন্যদিকে পাচারের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধার করা হলেও সমাজ তাদের গ্রহণ করতে চায় না। ফলে এদের পুনর্বাসনের দিকেও নজর বাড়াতে হবে। সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের নির্বাহী পরিচালক এম এহছানুর রহমান বলেন, পাচারকারীরা সংঘবদ্ধ চক্র। এরা দেশে এবং দেশের বাইরে সক্রিয়। পাচারের শিকার ব্যক্তিদের দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আন্তদেশীয় যোগাযোগকে শক্তিশালী করতে হবে।
বিজিবি সদর দপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) আবু বকর সীমান্তে পাচার প্রতিরোধে সভা, সেমিনার, কর্মশালাসহ বিভিন্ন উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে বলেন, গত বছর পাচারের শিকার ৩০১ জন নারী ও ১০৪ জন শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। পাচারকারী ১০ জনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম আবু বকরের কাছে এ পর্যন্ত কতজন পাচারকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর হয়েছে, তা জানতে চান। এ প্রশ্নের উত্তরে আবু বকর বলেন, ‘নিজের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় বলতে পারব না যে কোনো পাচারকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে।’
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বলেন, পাচার প্রতিরোধে নতুন আইনটি একটি চমৎকার, সমন্বিত আইন। আইনে তদন্তের জন্য ৩০ দিন এবং শর্ত সাপেক্ষে ট্রাইব্যুনাল নির্দিষ্ট সময় বাড়াতে পারবে বলে বলা হয়েছে। তবে এ সময় মানা হচ্ছে না। কেন নির্দিষ্ট সময় মানা হলো না, তার জন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষাবিষয়ক প্রকল্প পরিচালক প্রভাস চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনবিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনাটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। পাচারের বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তের কথা থাকলেও তা হয়নি। পাচারের ওপর একটি ভিত্তি জরিপ (বেসলাইন সার্ভে) করার কথা ছিল, তা-ও হয়নি। পাচারবিরোধী জেলা বা উপজেলাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি সক্রিয় নয়। এ ছাড়া সরকার এবং এনজিও অনেকেই বিষয়টিতে কাজ করছে, কিন্তু কাজের মধ্যে সমন্বয়ও নেই।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার নিশাত চৌধুরী বলেন, পাচার প্রতিরোধে যে আইনটি করা হয়েছে, তাতে শ্রম শোষণকে পাচারের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। এতে করে অনেকেই ভাবেন, শ্রমবাজার সংকুচিত হবে। আসলে আইনটির মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে অভিবাসনকে নিরাপদ করা।
ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমের দেশীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত এ বি এম কামরুল আহসান আইনটির প্রচার বাড়ানোর জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি পরিচালক চন্দন গোমেজ আইনের প্রায়োগিক ব্যাখ্যাকে স্পষ্ট করে আইনটি বাস্তবায়নে জোর দেন।
উইনরক ইন্টারন্যাশনালের জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম ম্যানেজার সুরাইয়া বানু বলেন, গত বছর পাচারবিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এখনো মনে করে, এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের বিভাগীয় পরিচালক শৈবাল সাংমা পাচার প্রতিরোধে প্রচার বাড়ানোর পাশাপাশি যুব সমাজকে সচেতন করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।

No comments

Powered by Blogger.