ফুটপাত- পথচারী ও বাইকওয়ালা by নাইর ইকবাল

এমনিতেই চলাচলের অনুপযোগী রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে বিরক্তিকর ও ক্ষুব্ধ হওয়ার মতো দৃশ্যের অবতারণা করেন মোটরবাইকচালকেরা। তাঁরা নির্দ্বিধায় ফুটপাতে তুলে দেন তাঁদের মোটরবাইক। ফুটপাতে উঠে এই বাইকচালক ভাইয়েরা পথচারীদের যেন রীতিমতো তাড়িয়ে নিয়ে চলেন।
পথচারীরা পথ করে না দিলে অত্যন্ত আপত্তিকরভাবে বাজাতে থাকেন হর্ন। অনেক সময় দেখা গেছে, পথচারীরা এই বাইক ভাইদের শ্লেষেরও শিকার হন। পথচারীদের দোষ, তারা কেন ‘তাড়ায় থাকা’ এসব বাইকচালকের জন্য তাদের চলাচলের ‘সবেধন নীলমণি’ ফুটপাতের অংশটুকু ছেড়ে দিতে দেরি করছে!
এ এক অদ্ভুত মানসিকতা। রাস্তা ছেড়ে মোটরবাইক নিয়ে ফুটপাতে চলে আসা। আমরা পথচলার সময় প্রায়ই এই বিড়ম্বনার শিকার হই। ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি; পেছনে চলে এসেছে একটি মোটরবাইক। রাগে-ক্ষোভে অনেক সময় মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, যতই হর্ন দিক, রাস্তা ছাড়ব না। কিন্তু একপর্যায়ে হর্নের ঠেলায় অতিষ্ঠ হয়ে বাইকওয়ালাকে রাস্তা ছেড়ে দিতে হয়। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় বাইকচালকের ‘দৃষ্টি’ থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরোয়। ভাবতে থাকি, এই দেশে কোনটি সঠিক? ফুটপাত দিয়ে পথচারীদের হাঁটা, নাকি বাইকচালকের বীরদর্পে ছুটে চলা।
অনেক সময় ক্ষোভের সঙ্গেই বাইকচালককে থামিয়ে জিজ্ঞেস করেছি তাঁর ফুটপাত আরোহণের নেপথ্য কারণ। নির্বিকার বাইকচালকের উত্তর, ‘হাতে একটু তাড়া আছে ভাই। তাই ফুটপাত দিয়ে শর্টকাট মারছি।’ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই তখন করতে পারি না। সভ্য সমাজে বাস করার অসুবিধাগুলোর একটি এটা। অনেক সময় ভব্যতার বেশ ধরে থাকতে হয়।
মহামান্য হাইকোর্ট বেশ কিছুদিন আগে ফুটপাতে মোটরবাইকের অবাধ প্রবেশ নিয়ে একটি রুল জারি করেছিলেন। ফুটপাত দিয়ে পথচারীদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। কিছুদিন এ ব্যাপারে পুলিশকে তৎপর দেখা গেলেও এখন নীরব দর্শক। মোটরবাইকওয়ালাদের ফুটপাতে তাঁদের বাইক তুলে দেওয়ার ব্যাপারে পুলিশের চোখরাঙানি খেতে হয় না; দিতে হয় না জরিমানা।
একশ্রেণীর বাইকওয়ালা যখন ফুটপাতের ওপর উঠে শাঁ করে চলে যান, আমরা প্রমাদ গুনি গাড়িওয়ালারাও না আবার এ ধরনেরই কিছু করা শুরু করেন। একটি বড় পাজেরো গাড়ি তার এক পাশের মোটা চাকা ফুটপাতে তুলে দিয়ে জায়গা বের করে খুব সহজেই চলে যেতে পারে।
ফুটপাত পথচারীদের হাঁটার স্থান। সেখানে বাইক ওঠানোর দায়ে বাইকওয়ালাদের কঠোর শাস্তিই দেওয়া উচিত। মৃদু-মন্দ কথা বলে ৫০০ টাকার একটি মামলা করে ছেড়ে দেওয়ার মতো অপরাধ এটা নয়। এটা যেকোনো ধরনের শৃঙ্খলার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের অন্যতম নিদর্শন হওয়ার কারণে কিছুদিনের জন্য লাইসেন্স বাতিল কিংবা হাজতবাসই হতে পারে এর উপযুক্ত শাস্তি।
ফুটপাতে মোটরবাইক নিয়ে উঠে পড়া কেবল আইনের দৃষ্টিতে অন্যায় বললেও ভুল বলা হয়। ব্যাপারটি আরেকজন মানুষকে অপমান করার মাধ্যম। যে রাস্তাটি মানুষের হাঁটার জন্য বানানো হয়েছে, সেখানে আপনি একটি যান্ত্রিক বাহন নিয়ে উঠে পড়বেন, আর মানুষকে হর্ন বাজিয়ে সরতে বলবেন, ব্যাপারটি কি নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অন্যায় নয়? যে মোটরবাইকচালক ফুটপাতে বাইক নিয়ে উঠে পড়েন এবং পথচারীকে হর্ন বাজিয়ে বিরক্ত করেন, তিনি কি কখনো পথচারীর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ব্যাপারটি নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখেছেন?
যত দিন যাচ্ছে, আমাদের মধ্যে বিবেকহীনতার বিষয়টি এত নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ছে, যেকোনো অন্যায়কেই এখন আর আমরা অন্যায় বলে মনে করি না। পথচারীর চলাচলের জন্য তৈরি ফুটপাতে ‘হাতে সময় অল্প’ যুক্তি দিয়ে উঠে পড়াটাও তেমনই একটা ব্যাপার। এই দেশে কখনোই রাজপথে ট্রাফিক আইন ঠিকমতো মেনে চলা মানুষের অভ্যাসে পরিণত করা হয়নি বলে কিছু মানুষ রাজপথে যা খুশি তা-ই করার সাহস দেখাচ্ছেন। ফুটপাতে মানুষের পথ চলাকে অগ্রাহ্য করে মোটরবাইক তুলে দেওয়াও অনেকটা তাই-ই।
হতাশার বিষয়টি হলো, ফুটপাতে বাইক তুলে দেওয়া যে মহা অন্যায়, এটা বুঝতে পারছেন না অনেক বাইকচালকই। বুক ফুলিয়ে প্রতিনিয়ত তাঁদের ফুটপাতে উঠে মানুষকে অপদস্থ করা তা-ই প্রমাণ করে। এমনকি হাইকোর্টের নির্দেশও এসব বাইকচালককে নিবৃত্ত করতে পারেনি। কোনো কিছুতেই যখন কিছু হচ্ছে না, তখন এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। ফুটপাতে আপনার পেছনে যদি বাইক নিয়ে কাউকে আসতে দেখেন, তখন দাঁড়িয়ে তার প্রতিবাদ করাই সর্বোত্তম পন্থা। এভাবে জায়গায় জায়গায় প্রতিরোধ চলতে থাকলে দেখবেন, ফুটপাতে বাইক তোলার আগে অনেক বাইকচালকই কয়েকবার ভাববেন। জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধ হচ্ছে এ অনিয়ম ও অনাচার বন্ধের মোক্ষম উপায়।
প্রতিরোধের কথাটা বলে ফেলে একটু ভয়ই লাগছে। ‘প্রতিরোধ’ ও ‘প্রতিবাদ’—এ শব্দগুলো কেন যেন এখন আর অহিংসার অর্থে ব্যবহূত হয় না। প্রতিরোধ করার অর্থ এই নয় যে তাঁদের ওপর চড়াও হওয়া। তাঁদের আইন মানতে বাধ্য করতে হবে।
হিংসা-বিদ্বেষের কোনো ব্যাপার ঘটবে না, যদি আমরা সবাই নিজেদের বিবেককে পরিষ্কার করি। অন্যায় করব না, আইন মেনে চলব—এই প্রতিজ্ঞাগুলোই বিবেককে পরিষ্কার করে ফেলার জন্য যথেষ্ট। বাইকচালকেরাই বরং নিজেরা প্রতিজ্ঞা করুন, ফুটপাতে যান্ত্রিক বাহন তুলে দেওয়ার মতো অন্যায় কাজ তাঁরা করবেন না, তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
তার পরও যদি তাঁরা নিজেদের না শোধরান, তাহলে আইন প্রয়োগকারীদের বলতেই হবে এর বিরুদ্ধে কঠোর হতে। আর জনগণকে বলতে হবে, প্রতিরোধ করতে, প্রতিবাদ জানাতে। একটি সভ্য দেশের রাজধানীতে এই অনাচার চলতে থাকবে, সেটা সত্যিই মেনে নেওয়া যায় না।
নাইর ইকবাল: সাংবাদিক
nayirdhaka@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.