জনজীবন-যানজটের প্রতিকারযোগ্য কারণগুলো by ওয়াসেত সাহিন

রাজধানী ঢাকা সত্যিকার তিলোত্তমা হতে চলেছে। বিগত এক দশকে এর ফুটপাত এবং রাস্তাগুলোর যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে। চমৎকার ডিভাইডার নির্মাণ এবং এগুলো সবুজায়ন করা হয়েছে। লেক ও পার্কগুলো আধুনিকায়ন করা হয়েছে। কিছু ল্যান্ডস্কেপ নির্মাণ করা হয়েছে।
বেশ কয়েকটি ফুট ওভারব্রিজ হয়েছে। মনোরম হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে ১৮ কিলোমিটার সড়ক, ১৮ কিলোমিটার স্টর্ম স্যুয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। চারটি দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ নির্মিত হয়েছে। কিছু ল্যান্ডস্কেপ হয়েছে। রাতের বেলার জন্য হয়েছে চমৎকার আলোকায়ন ব্যবস্থা। স্বচ্ছ লেকে টলটল করে পানি। ঢাকা ওয়াসা সায়েদাবাদ সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট পল্গান্টের দুটি ফেজ চালু করেছে। এ দুটির দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ৪৫ কোটি লিটার। খিলগাঁও ও মহাখালীতে দুটি ফ্লাইওভার চালু হয়েছে। যাত্রাবাড়ী ও এয়ারপোর্ট রোডে ফ্লাইওভার নির্মাণাধীন। কিন্ত ঢাকাবাসী যানজটের কবল থেকে মুক্তি পায়নি। এটি বরং বেড়েছে। নিত্য যানজটে নাকাল হচ্ছে জনগণ। মূল্যবান কর্মসময়ের নিদারুণ অপচয় হচ্ছে। অপচয় হচ্ছে জ্বালানির। যানবাহনের তুলনায় রাস্তা কম, এটি সত্যি। তাহলে কি ঢাকাকে যানজটমুক্ত করতে পুরো নগরীকে ফ্লাইওভারে ছেয়ে ফেলতে হবে? তাহলে তো রাজধানীবাসীর যানজটে নাকাল হওয়া থেকে মুক্তি অলীক কল্পনা মাত্র!
অথচ একটু চেষ্টা করলেই প্রকট এই সমস্যাটিকে বহুলাংশে হ্রাস করা সম্ভব। কীভাবে?
নিম্নে উলি্লখিত বিষয়গুলো লক্ষ্য করা যাক_
ফুটপাত : বিগত দশক ধরেই নগরীর ফুটপাতগুলো উন্নত নির্মাণসামগ্রী দিয়ে বেশ সুদৃশ্য করে নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে কোটি কোটি টাকা। অথচ এগুলোতে পথচারী চলাচলের উপায় নেই। এসব ফুটপাত নানাবিধ দোকানপাট, বাস্তুহারাদের আবাসস্থল, রিকশা-ভ্যানের গ্যারেজ ইত্যাদিতে বেদখল হয়ে আছে। ফাঁকা যেটুকু আছে তাতে যখন-তখন ভোঁ ভোঁ করে মোটর বাইক উঠে পড়ে। সুতরাং ফুটপাতে পথচারীর ঠাঁই নেই। তারা তাই রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হয়। এতে পথচারীরা যেমন দুর্ঘটনার আশঙ্কায় পতিত হয়, যান চলাচলেও বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। ফুটপাতগুলোকে পথচারীদের চলাচলের জন্য অন্যায্য দখলমুক্ত রাখা ডিসিসি ও পুলিশের দায়িত্ব। অযাচিত বাহ্যিক হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ বন্ধ রেখে তাদের বাধাহীন দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দেওয়া জরুরি। এতে ফুটপাতগুলোতে পথচারীদের চলাচলের অবারিত সুযোগ করে দেওয়া খুবই সম্ভব, যা যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
রাস্তায় পার্কিং :বড় বড় বাণিজ্যিক এবং অফিস বিল্ডিংগুলোর কার পার্কিং সুবিধা নেই। এর কোনোটিতে পার্কিং সুবিধা থাকলেও তা অপ্রতুল। ফলে এসবের কর্মকর্তা ও দর্শনার্থীদের গাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। এতে করে বিদ্যমান অপ্রশস্ত রাস্তা আরও সরু হয়ে যায়। যা রাস্তায় স্বাভাবিক যান চলাচলে খুবই বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এ দৃশ্য কারওয়ান বাজার, মহাখালী, মতিঝিলসহ বহু এলাকায় দেখা যায়। যানজটের এটি একটি বড় কারণ। ডিসিসি কর্তৃক উপযুক্ত স্থানে বহুতল কার পার্কিং বিল্ডিং নির্মাণই প্রকৃত সমাধান। ভূগর্ভস্থ কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। তবে তাৎক্ষণিক সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোকে নিজস্ব পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে বিল্ডিংয়ের নিচতলাতে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ বিষয়ে ডিসিসি ও রাজউক প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এটি বাস্তবায়িত হলে রাস্তায় থেমে থাকা গাড়ির সংখ্যা হ্রাস পাবে। ফলে যানজট বেশ হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।
রাস্তায় বাজার-দোকানপাট :কিছু কিছু এলাকায় রাস্তায়ই বাজার বসে যায়। কারওয়ান বাজার সংলগ্ন রাস্তাগুলো তো অনেকটাই বাজার গিলে ফেলেছে। ফল, তরিতরকারির বাজার, কম্বল, মশারি, কাপড়ের দোকান রাস্তা ছেয়ে ফেলেছে। গ্রীন রোডের ফার্মগেটের কাছাকাছি অংশে রীতিমতো বাজারই বসে যায়। মাছ, মুরগি, সবজি সবই বিকোয়। তেজগাঁও কলেজের উত্তর পাশের বাজারটির তো দুই যুগের বেশিই বয়স হয়ে গেল। মিরপুর রোডে ঢাকা কলেজের বিপরীতে, মতিঝিলসহ বহু জায়গায় রাস্তায় বাজার বসে যায়, যা যান চলাচলের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে। এসব দোকান, বাজার উচ্ছেদ প্রয়োজন। ডিসিসি ও পুলিশ বিভাগ নিজস্ব দায়িত্বের আওতায় উদ্যোগ নিলে দু'চারদিনেই এটি করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রেও তাদের কাজে কোনো বাহ্যিক হস্তক্ষেপ করা চলবে না। বাহ্যিক প্রভাবমুক্ত হয়ে করতে পারলে এটি অত্যন্ত সহজ কাজ হবে। ডিসিসি ও পুলিশ অতি দ্রুত রাস্তা থেকে বাজার, দোকানপাট সরিয়ে দিতে পারবে। স্থানে স্থানে রাস্তার গলা চেপে ধরা এসব বাজার-হাট সরিয়ে দিতে পারলে রাস্তাগুলো চলমান যানবাহনের জন্য নিরাপদ হবে। এতে যানজটও বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
রোড ডিভাইডারে ওপেনিং : এটিও যানজটের একটি বড় কারণ। ডিভাইডারে ওপেনিং রাখার কথা শুধু রোড ক্রসিংগুলোতে। কম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা জংশনে মিললেও রাখা যেতে পারে। অথচ ঢাকা মহানগরীর রোড ডিভাইডারে কী দেখা যায়? কারণে-অকারণে ঘন ঘন ওপেনিং। একটু পরপরই চলমান গাড়িগুলোর ইউ টার্ন অথবা রাস্তা ক্রসিং। এসবই যান চলাচলের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে। সৃষ্টি করে যানজট। এসব ওপেনিংয়ের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। ডিসিসিকে ওপেনিং সিলেকশনে শুধু কারিগরি বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রেও বাহ্যিক হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। বাহ্যিক হস্তক্ষেপের কারণে ডিসিসি যেন অনুপযুক্ত স্থানে ওপেনিং রাখতে বাধ্য না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ডিভাইডারের ওপেনিং যানজটের একটি বড় কারণ। তাই এটি যত কম হয় তত ভালো। আমি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাই আমার বাড়ির সামনে ওপেনিং থাকতেই হবে কিংবা আমাদের মহল্লায় ওপেনিং রাখতে হবে_ জনগণেরও এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। ডিভাইডারের হ্রাসকৃত সংখ্যা যানজটকে উলেল্গখযোগ্য হারে হ্রাস করবে_ বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে।
দেখা যাচ্ছে নতুন কোনো প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ছাড়া এমনকি সরকারি কোষাগারে হাত না দিয়েই যানজট অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রয়োজন বিদ্যমান ব্যবস্থাপনাকে অবাধে কাজ করতে দেওয়া এবং প্রশাসনকে বাহ্যিক প্রভাবমুক্ত রাখা। এতে করে যানজটের মতো ভয়াবহ সমস্যা ও প্রাসঙ্গিক জনভোগান্তি অনেক হ্রাস পাবে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দেশ অনেক এগিয়ে যাবে।

ওয়াসেত সাহিন : প্রকৌশলী

No comments

Powered by Blogger.