৫ম সংশোধনী মামলা শুনানি শেষ, আজ আদেশ

 সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও তিন আইনজীবীর আবেদনের ওপর শুনানি সোমবার শেষ হয়েছে।
৬ দিন শুনানি শেষে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আজ মঙ্গলবার দেবে ঐতিহাসিক আদেশ। সরকার পৰ এবং বিএনপি মহাসচিবের আইনজীবী শুনানি শেষে পৃথক পৃথকভাবে প্রেস ব্রিফিং প্রদান করেন। শুনানিতে অংশ নিয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে জানান, পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল, এটা ঐতিহাসিক রায়। এ রায় যে কোন সভ্য দেশে সমাদৃত হবে। রায়ে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেৰতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য গর্ব। ধর্মনিরপেৰতা ধর্মহীনতা নয়। সংবিধানের খসড়া যখন পেশ করা হয়, তখন প্রারম্ভিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ধর্মনিরপেৰতার জন্য যুদ্ধ করেছি। তিনি আদালতকে বলেন, পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ে বিসমিলস্নাহর কথা বলা হয়নি। যারা বিসমিলস্নাহর কথা বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা মার্শাল ল এর দোসর। অন্যদিকে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের আইনজীবী টিএইচ খান আদালতকে জানান, আমরা ৬ দিন অরণ্যে রোদন করেছি। ক্রিকেটারদের আমরা আদর করে টাইগার ডাকি। কিন্তু ভাল খেলেও কুয়াশার কারণে বল দেখে না। আজ আমাদের বিবেক কুয়াশাচ্ছন্ন। সরকারের বিরম্নদ্ধে গেলে মহাপাপ। বিসমিলস্নাহ ওঠাতে গেলে গণভোট লাগবে। অন্যদিকে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আদালতকে জানান, এগুলো রাজনৈতিক ইসু্য, চূড়ানত্ম সিদ্ধানত্ম জনগণই নেবে। সুপ্রীমকোর্টের দায়িত্ব হলো যে কোন বিষয় লিভ চাওয়া চিরাচরিত বিষয়। তিনি আদালতের উদ্দেশে বলেন এমন কোন রায় দেবেন না যাতে দেশে অশানত্মি হয়। সংঘর্ষ বাধে। লিভ টু গ্রহণ করে দীর্ঘ শুনানি না করলে এ বিষয়ে আদালতের মর্যাদা ও নিরপেৰতা ৰুণ্ন হতে পারে। সোমবার সকাল সোয়া ৯টায় প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে বিচারপতি মোঃ ফজলুল করিম, বিচারপতি এমএ মতিন, বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি বিজন কুমার দাস, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার দাশের নেতৃত্বে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি শুরম্ন হয়। নির্ধারিত সময় শেষেও দুই পৰকে শুনানিতে সুযোগ দেয়া হয়। শুনানিতে সরকার পৰে অংশ নেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, ড. তৌফিক নেওয়াজ, সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম। অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ারের পৰে শুনানিতে অংশ নেন টিএইচ খান ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ। শুনানি শেষে উভয়পৰ সাংবাদিকদের ব্রিফিং প্রদান করে।
এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, দু'টি পিটিশনের শুনানি হয়েছে। শুনানিতে তাঁরা বলেছেন, ধর্মনিরপেৰতা মুক্তিযুদ্ধের কোন কমিটমেন্ট ছিল না। এটা সংবিধানের মূল সত্মম্ভও গণ্য করা যায় না। এর উত্তরে আমি বলেছি, '৭২ সালে যে এ্যাসেম্বলি বসে বঙ্গবন্ধু সেখানে তাঁর প্রারম্ভিক ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানে যে সমসত্ম সিদ্ধানত্ম নেয়া হয় তা আদালতে বলেছি। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেৰতার ভিত্তিতে সংবিধান রচিত হবে। সংবিধানের খসড়া যখন পেশ করা হয়, তখন বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছিলেন, ধর্ম নিরপেৰতার জন্য যুদ্ধ করেছি। পাকিসত্মানে যে ক'টি বছর ছিলাম ধর্ম নিয়ে তারা কিভাবে রাজনীতি করেছে তা আমরা দেখেছি। ধর্মনিরপেৰতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। যার যার ধর্ম সে তা পালন করবে। হিন্দু হিন্দুর ধর্ম, মুসলিম মুসলিমের ধর্ম, খ্রীস্টান খৃস্টানের ধর্ম আর বৌদ্ধ বৌদ্ধের ধর্ম পালন করবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন মসজিদ আক্রানত্ম হয়েছে, তেমনি মন্দিরও আক্রানত্ম হয়েছে। ধর্মনিরপেৰতা নিয়ে শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, তৎকালীন আইনমন্ত্রী থেকে শুরম্ন করে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরম্নল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম কামরম্নজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীও কথা বলেছেন।
মাহবুবে আলম বলেন, '৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু মারা যাবার পর সংবিধান অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি না থাকলে স্পীকার রাষ্ট্রপতি হবেন। তখন সংবিধান বহাল ছিল। খোন্দকার মোশতাক, আবু সাদাত মোঃ সায়েম ও জিয়াউর রহমান ৰমতা দখল করেন। হাইকোর্ট তাঁদেরকে অবৈধভাবে ৰমতা দখল করেছে বলে যে রায় দিয়েছে তা সঠিক।
সামরিক সরকারের বৈধতা দিয়ে ১৯৭৭ সালের ৭ নম্বর মার্শাল ল রেগুলেশন (এমএলআর) চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেৰিতে ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে বিচারপতি এবিএম খায়রম্নল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে তৎকালীন হাইকোর্ট বেঞ্চ পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। সে দিনই রায় স্থগিতের আবেদন জানায় তৎকালীন বিএনপি সরকার। বর্তমান মহাজোট সরকার ৰমতায় এসে আপীল আবেদন প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করে। ৩ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে আপীল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সরকারের আপীল আবেদন প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করে। এরপর ৫ জানুয়ারি পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে চেম্বার জজের কাছে আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। তিনি এ বিষয়ে কোন আদেশ না দিয়ে শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করে আবেদনটি আপীল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পাশাপাশি খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং জামায়াতে ইসলামী সমর্থক তিন আইনজীবীর দু'টি আপীল আবেদন (লিভ টু আপীল) শুনানির জন্য ১৮ জানুয়ারি দিন নির্ধারণ করেন।
হাইকোর্টের ঐ রায়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যনত্ম খোন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের শাসনকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। তবে আদালত ওই সময়ে 'জনস্বার্থে করা' সরকারের বেশ কিছু বেআইনী কাজকে মওকুফ করে দিয়েছিল। হাইকোর্ট কর্তৃক ঐ রায়ে বলা হয়েছিল, সামরিক আইন সামগ্রিকভাবে অবৈধ ও অসংবিধানিক এবং সামরিক আইনের অধীনে করা সব কার্যক্রম আইন ও বিধি অবৈধ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যনত্ম সরকারের পরিবর্তন সংবিধানসম্মতভাবে হয়নি বলে হাইকোর্টের ঐ রায়ের অভিমতে বলা হয়।

No comments

Powered by Blogger.