থেমে আছে শিবিরের হাতে নিহত রাবি শিৰক তাহের হত্যা মামলা- আজ তাঁর হত্যার চার বছর পূর্ণ হচ্ছে by ফজলে নোমানী

 দিনটা তাঁর কাছে স্মরণীয় একটি দিন। দুঃখে ভারাক্রানত্ম হবার আবার বাবার সাথে শেষ কথা বলার স্মৃতি রোমন্থনেরও দিন বটে। বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকরা এসে তাঁর বাবার সাথে শেষ আলাপ সম্পর্কে জানতে চাইলে এই দিনটিতে বেদানাসিক্ত অতীতকে টেনে আনতে হয় বার বার! এদিনে কিছু পত্রিকায় লেখালেখি আর স্মৃতিচারণ সভার মাঝেই বাবাকে কেবল উপস্থিত পান সাগুফতা।
কিন্তু, দেশসেরা একজন বিজ্ঞানী, বরেণ্য ব্যক্তিত্ব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহেরের হত্যাকা-ের ৪টি বছর পার হয়ে গেলেও অপরাধীদের সাজা কার্যকর হতে দেখতে পেলেন না। বিভাগীয় এক শিৰকসহ নিম্ন আদালতে চারজনের ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে বিগত দুই বছর যাবত স্থগিত হয়ে রয়েছে মামলাটি। ১৬৪ ধারায় আসামির স্বীকারোক্তির পরও অলৌকিকভাবে এই মামলা থেকে রেহাই পান রাজশাহীর শিবির নেতা সালেহী।
২০০৬ সালের ৩ ফেব্রম্নয়ারি হত্যাকা-ের দু'দিন পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিৰকদের বাসভবনের পাশে থাকা ডাস্টবিন থেকে ড. তাহেরের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল।
বছর পরিক্রমায় আবারও চলে এলো ১ ফেব্রম্নয়ারি। বাবার চতুর্থ মৃতু্যবার্ষিকীর দিনটি। যাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছে তিনি পেশায় একজন মহিলা আইনজীবী এবং ড. এস তাহেরের আদরের একমাত্র কন্যা সাগুফতা। সবে আইন পাস করে সিএমএম আদালতে প্র্যাকটিস শুরম্ন করেছেন। রবিবার দুপুরে ঢাকা বারের তিনতলার কমনরম্নমে বসেই কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। মানুষকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দেবার জন্য সত্যের পথে লড়ার দৃঢ় অঙ্গীকারের কারণেই এই পেশায় যোগ দিলেও তিনি নিজেই কিন্তু আজও পিতার হনত্মারকের বিচারে শাসত্মি হবার প্রত্যাশায় সকলের অলৰ্যেই দিন গুণে চলেছেন। বাবার হত্যাকারীদের মধ্যে চারজনের ফাঁসির রায় হলেও অন্যতম প্রধান আসামি ছাত্রশিবিরের সালেহী কিন্তু নিম্ন আদালতের রায়েই মুক্তি পেয়ে যায়। হনত্মারকরা খুবই শক্তিশালী হওয়ায় জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে আর উচ্চ আদালতে মামলা লড়ার সাহস যোগাড় করতে পারেননি। ফাঁসির আসামিরাই বরং আপীল করাতে নিম্ন আদালতের রায় স্থগিত হয়ে আছে।
২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহী বিভাগের দ্রম্নত বিচার আদালতে বিচারক এটিএম মেসবাউদ্দৌলা ভূতত্ত্ব বিভাগের এক শিৰক মহিউদ্দীনসহ ৪ জনের ফাঁসির আদেশ দেন এবং শিবির নেতা সালেহীসহ দু'জনকে বেকসুর খালাস দেন। এরপর থেকে অদ্যাবধি উচ্চ আদালতে মামলাটির একটি শুনানি পর্যনত্ম অনুষ্ঠিত হয়নি। মামলার দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে ড. তাহেরের অবর্তমানে তাঁর পরিবারটি প্রতি মুহূর্তে এখনও জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।
১ ফেব্রম্নয়ারি, আজই যে প্রিয় বাবার সাথে সকালে শেষ সাৰাত হয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাগুফতা আইন বিভাগে ভর্তি হওয়ার কারণেই বাবা-মা এবং ভাই হিমেলসহ সকলেরই রাজশাহী থেকে ঢাকা আগমন। এরপর মাঝে মাঝেই বাবা ঢাকাতে ক'দিন আবার রাজশাহীতে ক'দিন এভাবেই থাকতেন। সে দিনও ঢাকা থেকেই গিয়েছিলেন ড. তাহের। বিকালে রাজশাহী পেঁৗছানোর পরে ঠিকভাবে পেঁৗছানোর কথা জানিয়েছিলেন। তড়িঘড়ি সপরিবারে ঢাকা চলে আসায় প্রিয় কন্যার বানাতে দেয়া কয়েকটি পোশাক রাজশাহীর দর্জির দোকানেই রয়ে গিয়েছিল।সাগুফতার বাবা রাজশাহী পেঁৗছেই ড্রেস আনিয়ে রাখার কথাও মেয়েকে মোবাইলে জানিয়েছিলেন। রাত ৮টার দিকে তাঁর বাবা আবার ফোন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বাংলো থেকে বাবা মা'কে ফোন করে কথা বলছিল। এর মধ্যেই তিনি জানালেন বিদু্যত চলে গেছে। বাবা-মা'র ফোনালাপ চললেও সাগুফতার কান ছিল সেদিকে। বিদু্যত চলে যাবার খবরে একটু বিস্ময়ই জাগল। সেখানে তো আইপিএস আছে। তাহলে বিদু্যত গেল কিভাবে! এরপর দিন থেকে ড. তাহেরের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে ফোন করে তাঁর পরিবারের কেউই তাঁকে খুঁজে পাচ্ছিল না। রাতে বিটিসিতে চাকরিরত ছেলে হিমেলকে তাঁর মা এই তথ্য দেয়ার পর হিমেলও অন্য শিৰকদের কাছে টেলিফোন করে বাবার কোন খোঁজ না পেয়ে সে রাতেই রাজশাহী রওয়ানা হলেন। সকালে রাজশাহী পেঁৗছে হিমেলসহ বিভাগীয় শিৰকরা ড. তাহেরকে কোয়ার্টারসহ আশপাশের এলাকা খুঁজে দেখতে গিয়ে ম্যানহোলে তাঁর মৃতদেহ পেয়ে যান। বিভাগীয় শিৰক হত্যার অভিযোগে মৃতু্যদ-প্রাপ্ত শিৰক মহিউদ্দীনও সে সময় হিমেলের সঙ্গে ছিলেন। সেদিনই রাজশাহীর মতিহার থানায় হিমেল নিজে বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। রাজশাহীর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মামলাটির তদনত্ম করে ১৮ মার্চ রাজশাহী মহানগর মুখ্য হাকিমের আদালতে ৬ জনের বিরম্নদ্ধে চার্জশীট দাখিল করেন। মামলাটি প্রথমে রাজশাহীর জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন আদালত ও বিশেষ দায়রা জজের আদালতে বিচারাধীন ছিল। ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট বিচারক জাহাঙ্গীর আলম মোলস্না মামলাটি পরিচালনা করতে বিব্রত বোধ করেন এবং রাজশাহী জেলা ও দায়রা জজের আদালতে পাঠান। ১৭ সেপ্টেম্বর মামলাটির বিচার কার্যক্রম দ্রম্নত বিচার আদালতে পাঠাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে। ৬ জানুয়ারি ২০০৮ থেকে রাজশাহী বিভাগীয় দ্রম্নত বিচার আদালতে মামলার কার্যক্রমে মোট ৪৯ জনের সাৰ্য গ্রহণ করা হয়। ৪, ৫ এবং ৬ মে যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে বিচারক এটিএম মেসবাউদ্দৌলা ৪ জনকে ফাঁসি এবং দু'জনকে বেকসুর খালাস দিয়ে ২২ মে রায় ঘোষণা করেন। ফাঁসির দ-াদেশপ্রাপ্তরা হচ্ছেন, ড. তাহেরের এক সময়কার ছাত্র এবং পরবর্তীতে বিভাগীয় শিৰক ড. মিয়া মোঃ মহিউদ্দীন, বাসভবনের তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর এবং তাঁর ভাই শিবিরকমর্ী আব্দুস সালাম এবং সালামের আত্মীয় নজমুল। খালাসপ্রাপ্তরা হচ্ছেন, তৎকালীন মন্ত্রী আমিনুল হকের একনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছাত্রশিবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী এবং মুত্যদ-প্রাপ্ত জাহাঙ্গীরের বাবা আজিমুদ্দিন।
এই হত্যাকা-ের রায় ঘোষণার পর সারাদেশের সুধী সমাজ এবং শিৰকদের মাঝে এর তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। কথা শিল্পী হাসান আজিজুল হক এ প্রসঙ্গে মনত্মব্য করতে গিয়ে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিৰককে আরেক শিৰকের হত্যাকা-ের এটি নজিরবিহীন ঘটনা।
আসামিদের সংশিস্নষ্টতা
মৃতু্যদ-প্রাপ্ত জাহাঙ্গীর, নাজমুল এবং আব্দুস সালাম ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেন, মহিউদ্দীন এবং শিবির সভাপতি সালেহী তাদের কম্পিউটার, টাকা-পয়সা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ড. তাহেরকে হত্যার কাজে ব্যবহার করেন। সালেহীর খালাস পাবার বিষয়ে সরকারী কেঁৗসুলি এ্যাডভোকেট শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম সে সময় সাংবাদিকদের জানান, জাহাঙ্গীর, সালাম ও নাজমুল ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছিলো যে, ড. তাহেরের মুখে বালিশ চাপা দিয়ে সালেহীই তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। কিন্তু, ময়নাতদনত্মের প্রতিবেদনে ডা. এনামুল হক এবং এমদাদুর রহমান উলেস্নখ করেন, ড. তাহের শ্বাসরোধ করায় মারা যাননি। তিনি মাথার পেছনে ভারি কিছুর আঘাতের কারণে মারা গেছেন। ফলে সালেহীর বালিশ চাপার অভিযোগটি প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু, হত্যাকা-ে তার সংশিস্নষ্টতা এড়িয়ে যাবার কোন কার্যকারণ বের করতে পারেননি সেদিন রায় শুনতে আসা আইনজীবীদের অনেকেই। এই মামলার এজাহারে উলেস্নখ করা হয়েছে, ন্যায়পরায়ণ এবং আদর্শ শিৰক ড. তাহেরের কারণে একবার ড. মহিউদ্দীনের পদোন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হওয়াই দ্বন্দ্ব সৃষ্টির মূল কারণ। ড. মহিউদ্দীনের পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপক হবার জন্য বিভাগীয় প্রবীণ শিৰক ড. তাহেরের মতামত ছিল গুরম্নত্বপূর্ণ। চাকরির নিয়মানুযায়ী ড. তাহেরের চাকরির বয়স ১২ বছর এবং সহকারী অধ্যাপক পদে চাকরির মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ না হওয়াতে ড. তাহের ২০০৫ সালের আগস্টে পরিকল্পনা কমিটির ৪১৬তম সভায় ড. মহিউদ্দীনের পদোন্নতির ৰেত্রে তাঁর মতামত দেয়া থেকে বিরত থাকেন।
ড. তাহেরের পরিবারের আর্জি
জাতির জনকের হত্যাকা-ের রায় কার্যকর হবার মধ্য দিয়ে দেশে আবার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়েছে বলে মনে করেন ড. তাহেরের কন্যা সাগুফতা। তাঁর বাবা একজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব এবং রাষ্ট্রের ও সম্পদ ছিলেন। কাজেই তাঁর হত্যাকারীদের দৃষ্টানত্মমূলক শাসত্মির প্রত্যাশার পরিসমাপ্তি চান তাঁরা। মামলায় জড়িতদের নানা হুমকি মাথায় করেই তাদের কালাতিপাত করতে হয়। থানায় সাধারণ ডায়েরি করলেও জানাজানি হলে ৰতি হবার ভয় রয়েছে। কাজেই জাতির জনকের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই এই মামলাটি সচল করার উদ্যোগ গ্রহণ করে এর বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে পদৰেপ নেবেন এটাই তাদের একমাত্র আশা এবং শেষ ভরসা।

No comments

Powered by Blogger.