যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু না হলে রাজপথে নামব মিরপুর মুক্ত দিবসে বললেন by মুনতাসীর মামুন

চারপাশে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নৃশংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। শুধু লাশ আর লাশ। গলিত লাশের অসহনীয় দুর্গন্ধ। এর মধ্যেই রাস্তা দিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে চলেছে হতবিহ্বল ৬/৭ বছরের একটি ছেলে।
তার সামনেই বাবা-মাসহ পরিবারের অন্যদের কেটে টুকরো টুকরো করে ড্রেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বিহারীরা। প্রতিবেশী ভাল মানুষ ডাক্তারকেও শিকার হতে হয় পাশবিকতার। তাকে ড্রেনের পাশে শুইয়ে প্রথমে দু'চোখ রড দিয়ে গলে দেয়া হয়। এরপর ছুরি চালিয়ে হত্যা করা হয়। এলাকা হানাদারমুক্ত হলেও ওইসব ভয়াবহ দৃশ্য দেখার ভারে মিরপুর থেকে দূরে ছিলাম পুরো বিশটি বছর।' ৩১ জানুয়ারি মিরপুরমুক্ত দিবস পালন অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ভারাক্রানত্ম গলায় এ কথা বলেন ইতিহাসবিদ গবেষক অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। এদিকে মিরপুরমুক্ত দিবস উপলৰে পৃথক এক অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি, আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ থেকে রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের নিশ্চিহ্ন করা হবে।
রবিবার মিরপুর ১ নং গোলচত্বরে মিসকু সুপার মার্কেট প্রাঙ্গণে একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, একাত্তরে নির্বিচারে মানুষ হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার না হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। জাতি আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার। প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া মার্চের মধ্যে শুরম্ন না করলে রাজপথে আন্দোলন করা হবে। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে জাতিকে শহীদদের কাছে চির অপরাধী হয়ে থাকতে হবে।
মিরপুরমুক্ত দিবস পালন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটির উপদেষ্টা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারবিষয়ক নাগরিক কমিটির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি গোলাম রব্বানী, অধ্যৰ আব্দুল আহাদ চৌধুরী, শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী এবং দেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার শহীদ জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল। বক্তারা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রম্নত শেষ করাসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধান পুনর্প্রবর্তন, মিরপুরের ১০টি বধ্যভূমি সংরৰণ করার দাবি জানান।
বক্তব্য দিতে গিয়ে শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে জনগণ আজ এতটাই সোচ্চার যে, গত বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনী ফাঁসির দড়িতে ঝুলেও ধিক্কার ও ঘৃণা পেয়েছে। কারও এতটুক সহানুভূতি তারা পায়নি। তাদের মৃতু্যতে কেউ এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেনি। কেউ ইন্নালিলস্নাহি... পর্যনত্ম পড়েনি।
অধ্যৰ আব্দুল আহাদ চৌধুরী ৰোভ প্রকাশ করে বলেন, একাত্তরে ইতিহাসের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটলেও দেশের প্রশাসন এতই ব্যর্থ যে তারা এখনও হত্যার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে পারেনি। স্বাধীনতার ৩৮ বছর পরও মিরপুরে হানাদার বাহিনীর সহায়তাকারীদের চিহ্নিত করা যায়নি। তারা আজ সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। তিনি বলেন, ঢাকায় সরাসরি যুদ্ধ করেছিল মাত্র ১৯শ' মুক্তিযোদ্ধা। তবে এখন রাজধানীতে দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশ নেয়া ১৫ হাজারেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধা বসবাস করছেন। তাই মিরপুরের যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করার জন্য সরসরি যারা এখানে যুদ্ধ করেছিল তাঁদের সম্পৃক্ত করা দরকার। তাঁরা বলতে পারবেন সে সময় মিরপুরে কারা কারা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি গোলাম রব্বানী আৰেপ করে বলেন, এতদিনেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারিনি আমরা। সে ব্যর্থতার দায় নিয়েই বধ্যভূমিতে গিয়ে শহীদদের আত্মার কাছে আমাদের মাফ চাইতে হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্বাস দিয়েছেন তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন। আমরা তাঁর আশ্বাসে বিশ্বাস রাখছি। তবে মার্চের মধ্যে সরকার এ বিচার প্রক্রিয়া শুরম্ন করতে না পারলে আমরা কঠোর আন্দোলন করব। নেমে আসব রাজপথে। তিনি যুদ্ধের সময় ও পরবতর্ী সময়ে মিরপুরের বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বলেন, হানাদার বাহিনী ও তার সহযোগীদের বর্বরতার স্বাৰর হয়ে দাঁড়িয়েছিল মিরপুর। এলাকায় একটি বটগাছ ছিল (পরে তা কেটে ফেলা হয়), সেখানে ছুরি শান দিয়ে ধারাল করা হতো নির্বিচারে মানুষ হত্যার জন্য। তিনি বলেন, একাত্তর থেকেই পাকিসত্মানের তাঁবেদারা এ দেশে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে যাদের কোন ফ্রন্টে দেখা না গেলেও মুক্তিযোদ্ধা সেজে তারা প্রশাসন, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন ৰেত্রে ঢুকে পড়ে। এরাই পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। এ হত্যাকা-ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ঠিকই, তবে কখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করেননি।
অনুষ্ঠানের এক পযর্ায়ে উপস্থিত স্বতঃস্ফূর্ত বিপুলসংখ্যক এলাকাবাসীকে নিয়ে মিরপুর-১ নম্বরের রাইনখোলা বধ্যভূমিতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পুষ্পসত্মবক অর্পণ করা হয়। পরে অনুষ্ঠানস্থলে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক ছবি প্রদর্শন করা হয়।
এদিকে মিরপুরমুক্ত দিবস উপলৰে ৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, ওলামা ও মার্কেট ব্যবসায়ীরা ব্যান্ড পার্টি, হাতি ও ঘোড়া নিয়ে বণর্াঢ্য র্যালির আয়োজন করে।
দেশ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের নিশ্চিহ্ন করা হবে_ সাজেদা চৌধুরী
জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি, আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ থেকে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের নিশ্চিহ্ন করা হবে। বিগত সাধারণ নির্বাচনে দেশের তরম্নণ সমাজ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, ঠিক সেভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তারা আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সংসদ উপনেতা প্রতিটি মহলস্নায়, প্রতিটি এলাকায় যারা রাজাকারদের সহযোগিতা করেছিল তাদের তালিকা তৈরি করার জন্য দেশের তরম্নণ সমাজকে আহ্বান জানান। রবিবার মিরপুর হানাদারমুক্ত দিবস উপলৰে এক আলোচনাসভায় এ কথা বলেন। পলস্নবীর বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ডে আয়োজিত আলোচনাসভায় সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ ইলিয়াছ মোলস্না। সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং সংরৰিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য সাফিয়া খাতুন।
সংসদ উপনেতা বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে যারা সপরিবারে হত্যা করেছিল, তাদের বিচারের পথ বন্ধ করার জন্য তাদের সহযোগীরাই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে তারা হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করেছিল। হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন হওয়ায় সারাদেশে ঘরে ঘরে মানুষ শুকরিয়া আদায় করেছে। অথচ বিএনপি-জামায়াত একটি কথাও বলেননি। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরম্ন হলে তাদেরও বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। তাই তারা ভয়ে কথা বলছে না। মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের উচিত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি না করে রাজাকারদের তালিকা তৈরি করা। আমাদের অতীতের এ ভুল শুধরাতে হবে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ দেশে সকল হত্যার বিচার সম্পন্ন করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.