আলোচিত হয়ে উঠেছে ৫ম সংশোধনী মামলা- বিচারপতি অসুস্থ থাকায় শুনানি স্থগিত

বহুল আলোচিত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে বিএনপি মহাসচিব ও জামায়াতপন্থী তিন আইনজীবীর আবেদনের ওপর শুনানি চলছে।
রবিবার আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের বিচারপতি বিজন কুমার দাস অসুস্থ থাকায় শুনানি হয়নি। তিনি সুস্থ হলেই আজ পুনরায় শুনানি শুরম্ন হবে। শুনানি শেষে আদালত কি রায় দেয়, তার ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে। রায়ের ওপর পর্যালোচনা করে সরকার পরবতর্ী পদৰেপ গ্রহণ করবে। আপীল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখলে '৭২ সালের সংবিধানে ফিরতে আর বাধা থাকবে না।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিচারপতি এবিএম খায়রম্নল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। সেদিনই রায় স্থগিতের আবেদন জানায় তৎকালীন বিএনপি সরকার। বর্তমান মহাজোট সরকার ঐ আপীল আবেদন প্রত্যাহার করে। বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও জামায়াতের তিন আইনজীবী সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে। সেই আবেদনের শুনানি চলছে। সরকার পৰ শুনানি দ্রম্নত শেষ করার পৰে। অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিবের আইনজীবিগণ ধীরস্থিরভাবে শুনানির পৰে।
পঞ্চম সংশোধনী, রিট মোকদ্দমাটির রায় একটি ঐতিহাসিক রায়। বিচারপতি এবিএম খায়রম্নল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের দ্বৈত বেঞ্চ ঐ রায়ে বেশ কিছু প্রসত্মাব তুলে ধরেছেন। হাইকোর্টের রায়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যনত্ম খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের শাসনকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। ঐ রায়ে আরও বলা হয়, 'সামরিক আইন সামগ্রিকভাবে অবৈধ ও অসাংবিধানিক এবং সামরিক আইনের অধীনে করা সব কার্যক্রম, আইন ও বিধিও অবৈধ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যনত্ম সরকার পরিবর্তন সংবিধানসম্মতভাবে হয়নি বলে হাইকোর্টের ঐ রায়ের অভিমতে বলা হয়।
প্রসত্মাবনায় আরও বলা হয়, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদের প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেৰতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে। অনুচ্ছেদ ৮(১) জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেৰতা এই মূলনীতিসমূহ এবং তৎসহ এই মূলনীতি হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে। অনুচ্ছেদ ৯ ভাষাগত এবং সংস্কৃতগত একক সত্তা বিশিষ্ট যে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সঙ্কল্পবদ্ধ সংগ্রাম করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন। সেই বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।
অনুচ্ছেদ ১২ ধর্মনিরপেৰতা নীতি বাসত্মবায়নের জন্য সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধমর্ীয়, অপব্যবহার, কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। ইহা মনুষ্য দ্বারা পরিচালিত সরকার নয়_আইন দ্বারা পরিচালিত। বাংলাদেশে সামরিক আইন বলিয়া কোন আইন নেই। এবং সামরিক আইন কর্তৃপৰ বলিয়া কোন কর্তৃপৰও নেই। সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি সামরিক আইন ঘোষণা করে সে প্রজাতন্ত্রের বিরম্নদ্ধে চরম রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে দায়ী হইবে। শুধু উর্ধতন কর্তৃপৰের আদেশ মান্য। ইহার কোন অজুহাত হইবে না।
১৯৭৫ সালের ৬ নবেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মোঃ সায়েমকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়ন প্রদান এবং তাহার রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ এবং তৎকর্তৃক ১৯৭৫ সালের ৮ নবেম্বর ইশতেহার ঘোষণার মাধ্যমে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকবর্গ নিয়োগ সকল কার্যই সংবিধান লঙ্ঘন।
১৯৭৬ সালের ২৯ নবেম্বর তৃতীয় ইশতেহারের মাধ্যমে বিচারপতি আবু সাদাত মোঃ সায়েম সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বিইউ, পিএসসি বরাবরে ন্যসত্ম করিয়া উক্ত মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ৰমতাবান করা সংবিধান আওতা বহির্ভূত ছিল। রায়ে বলা হয়, সংবিধানের বিধান সাপেৰে সংসদ যে কোন আইন প্রণয়ন করিতে পারে। সংবিধান (৫ম সংশোধনী) আইন ১৯৭৯ ৰমতা বহির্ভূত।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল হইতে ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ পর্যনত্ম সংঘটিত সকল ঘটনাদি অতীত ও সমাপ্ত বিধায় তাহা মার্জনা করা হইল। কিন্তু উপরোক্ত মার্জনা আইনানুগ বলিয়া নয়। বরং প্রজাতন্ত্রের স্বার্থে, সুদূর ভবিষ্যতে সমাজে বিভ্রানত্মি এড়াইবার স্বার্থে, মার্জনা করা হইল। যদিও উক্ত কার্যাদি চিরকালই অবৈধ ও অসিদ্ধ রহিবে। যদিও ৪র্থ সংশোধনীর বিভিন্ন অনুচ্ছেদ বিলুপ্তিকরণ বিধান মার্জনা করা হইয়াছে, কিন্তু মূল সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ বাদ প্রদান সংক্রানত্ম বিধান মার্জনা করা হয় নাই। মূল সংবিধানের প্রসত্মাবনা ৬, ৮, ৯, ১০, ১২, ২৫, ৩৮ ও ১৪২ অনুচ্ছেদসমূহ অপরিবর্তিত থাকিবে। উক্ত অনুচ্ছেদগুলি সম্বন্ধে সংবিধানে অতীত পরিবর্তন আনয়নের ব্যাপারে কোন মার্জনা অনুমোদন করা হয় নাই।
বিচারপতি এবিএম খায়রম্নল হক ও বিচারপতি এবিএম ফজলে কবিরের ঐতিহাসিক রায় ঘোষণার পর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকর রায় স্থগিতের আবেদন জানায়। বর্তমান সরকার ঐ আপীল প্রত্যাহার করলে পুনরায় বিএনপি মহাসচিবসহ তিন আইনজীবী রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করেন। সেই আবেদনের ওপর শুনানি চলছে। শুনানি শেষে আপীল বিভাগ কি রায় দেয় তার ওপর সবার দৃষ্টি। আপীল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখলে আর কোন অসুবিধা থাকবে না। আপনা আপনিই ৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়া যাবে। প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম ৭ ফেব্রম্নয়ারিতে অবসরে যাচ্ছেন। সম্ভবত তার আগেই এ বিষয়ে সিদ্ধানত্ম হতে পারে। সংশিস্নষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.