মহান নেতার মহাপ্রয়াণ by

জ্যোতির্ময় জ্যোতিবাবু চলে গেলেন। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছিলেন। কয়েকদিন আগে এমন গুজবও রটেছিল যে, তিনি মারা গেছেন। কিন্তু তিনি সে ধাক্কা কাটিয়ে ওঠেন।
তা সত্ত্বেও এটা বোঝা গিয়েছিল যে তিনি মৃতু্যর সঙ্গে বেশিদিন যুদ্ধ চালাতে পারবেন না। বয়সের ভার তাঁকে কাবু করে ফেলেছিল। তিনি দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। সম্ভবত তাঁর মতো বয়সী কোন বিখ্যাত নেতা সারা ভারতে দু'একজনের বেশি নেই। অত্যনত্ম পরিণত বয়সেই তিনি প্রয়াত হলেন। কিন্তু তাঁর মৃতু্যতে সারা উপমহাদেশের রাজনীতিতে যে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হলো তা সহজে পূরণ হবার নয়।
জ্যোতি বসুর মৃতু্যতে দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষও যে শোকাহত তাতে সন্দেহ নেই। তিনি এই বাংলাদেশের মানুষ ছিলেন। শিশুকালে এই বাংলাদেশের এক গ্রামে এক মুসলিম মহিলার দুগ্ধ পান করে তিনি বড় হয়েছিলেন। সেই মাকে তিনি ভোলেননি। একবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি বাংলাদেশ সফরে এসে ঢাকার অদূরে তাঁর জন্মস্থানে গিয়েছিলেন এবং তাঁর দুধমাকে খুঁজে বের করেছিলেন। সেই মায়ের বুকে মাথা রেখে শিশুর মতো তাঁর আদর উপভোগ করেছেন। যদিও তিনি সর্বভারতীয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ছিল নাড়ির টান।
বাংলাদেশের স্বার্থ ও সুবিধার প্রতি তাঁর ছিল সমান দৃষ্টি। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ত্রিশ বছর মেয়াদী যে পানি চুক্তি হয়, সে চুক্তি সম্পাদনেও জ্যোতি বসুর ছিল বিরাট ভূমিকা। সম্ভবত তাঁর সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া দিলস্নীর অবাঙালীর শাসকেরা এত সহজে বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে রাজি হতেন না। জ্যোতি বসু বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিজের মেয়ের মত স্নেহ করতেন।
সম্ভবত ভারতের রাজনীতিতে জওহরলাল নেহরম্নর পর তাঁর মতো এত বর্ণাঢ্য চরিত্রের নেতার আবির্ভাব হয়নি। যদিও তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতির সঙ্গেই বেশি যুক্ত ছিলেন, কিন্তু তার প্রভাব ছিল সর্বভারতীয়। দিলস্নীতে বিজেপি কোয়ালিশন সরকারের প্রথমদফা পতনের পর যে বামঘেঁষা সরকার ৰমতা গ্রহণ করেছিল, তার প্রকৃত নিয়ামক শক্তি ছিলেন জ্যোতি বসু। তিনি তখনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের অদূরদশর্ী সিদ্ধানত্মের জন্য তিনি তা হতে পারেননি। তিনি দলের সিদ্ধানত্ম অমান্য করে অন্যান্য শরিক দলের সমর্থনে অতি সহজেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু তিনি ভারতের রাজনীতিতে দলের সিদ্ধানত্ম মান্য করার এক অভূতপূর্ব গণতান্ত্রিক দৃষ্টানত্ম স্থাপন করে গেছেন। তিনি কমিউনিস্ট রাজনীতির অনুসারী হয়েও কত বড় গণতান্ত্রিক চরিত্রের নেতা ছিলেন এটা ছিল তার অতুলনীয় উদাহরণ।
সর্বভারতীয় রাজনীতির চরিত্র ও কাঠামো নির্মাণে নেহরম্নর পর জ্যোতি বসুই সর্বাধিক প্রভাব বিসত্মার করেছেন। একথা বিনাদ্বিধায় বলা চলে। নেহরম্নর জীবিত থাকাকালেই যে স্বতন্ত্র ভারতীয় রাজনীতির ধারা তিনি গড়ে তোলেন তা এই দেশটিতে সাম্প্রদায়িক ও হিন্দুত্ববাদী শক্তির অভু্যত্থান ও স্থায়ীভাবে ৰমতা দখলকে প্রতিহত করেছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) যখন দিলস্নীর কংগ্রেস সরকারের নেজুড়বৃত্তি দ্বারা আত্মহননের পথ ধরেছে, তখন জ্যোতিবসু সাহসের সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে আত্ম বিলুপ্তির পথ থেকে রৰা করেন এবং মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএম) নামে বিরোধী ধারার কমিউনিস্ট দল গড়ে তোলেন। একাজে অবশ্য তিনি তাঁর সমমনা কয়েকজন কমিউনিস্ট নেতার সহযোগিতা ও সমর্থন পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কাকাবাবু নামে পরিচিত কমরেড মুজফ্্ফর আহমেদ।
মার্কসবাদী চিনত্মাধারায় তিনি এই সময় চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু চীনের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কাছে ভারতের জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দেননি। চীনের সঙ্গে তাঁর ছিল আদর্শের সম্পর্ক, আনুগত্যের সম্পর্ক নয়। তিনি কমিউনিজমের আনত্মর্জাতিক ভাবধারার সঙ্গে ভারতীয় জাতীয়তার আদর্শেও সংমিশ্রণ ঘটান এবং কংগ্রেসের সর্বভারতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে সিপিএমকে গড়ে তোলেন। এমনকি তাঁর এই দূরদৃষ্টির ফলে ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে সকল বামদলের সমন্বয়ে শক্তিশালী বামফ্রন্ট গড়ে ওঠে এবং পশ্চিমবঙ্গে ত্রিশ বছর যাবত এই ফ্রন্ট ৰমতা ধরে রাখতে এখনও সৰম রয়েছে। ভারতের তিনটি রাজ্যেই সিপিএম দীর্ঘকাল ধরে ৰমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে। একটি কমিউনিস্ট দল নির্বাচনের মাধ্যমে ৰমতায় গিয়ে গণতান্ত্রিক পন্থায় ত্রিশ বছর যাবত একটি পুঁজিবাদী দেশে ৰমতা এবং জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছে, এর দ্বিতীয় নজির পৃথিবীতে নেই। রাশিয়ার স্ট্যালিন দীর্ঘকাল ৰমতায় ছিলেন। কিন্তু তা একদলীয় ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা এবং নির্যাতন ও অত্যাচার দ্বারা সম্ভব হয়েছিল।
একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশে কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচনের মাধ্যমে ৰমতা লাভ এবং নির্যাতন ছাড়া দীর্ঘকাল ৰমতায় থাকা এক অভূতপূর্ব ব্যাপার। এৰেত্রে জ্যোতি বসুর নীতি ও নেতৃত্বের কোন দ্বিতীয় নজির নেই। তাঁর বাম মোর্চা কখনও এককভাবে ভারতের কেন্দ্রীয় ৰমতায় যেতে পারেনি কিন্তু সেখানে সাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী শক্তির অভু্যদয় এবং স্থায়ীভাবে ৰমতা দখল ঠেকিয়ে দিয়েছে। এদিক থেকে তিনি আধুনিক গণতান্ত্রিক ভারতের দ্বিতীয় জনক।
ভারতের মতো একটি বিশাল পুঁজিবাদী দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে একটিমাত্র রাজ্যে ৰমতা দখল করে তিনি পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে যে সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন তা ছিল এক বিরল এক্সপেরিমেন্ট। রাজনীতিতে তিনি কট্টর নীতিবাগিশ ছিলেন না। তিনি গণস্বার্থের প্রয়োজনে দিলস্নীর কংগ্রেস সরকারের বিভিন্ন নীতির বিরোধিতা করেছেন। আবার সেই দিলস্নীতেই যখন হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক দলগুলো ৰমতা দখল করেছে তখন তাদের হটানোর জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে বিনা দ্বিধায় হাত মিলিয়েছেন। একজন কমিউনিস্ট নেতা দলের ভেতর ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় ৰমতা ত্যাগ করেছেন এবং পরবতর্ী নেতার কাছে ৰমতা হসত্মানত্মর করেছেন এর কোন দৃষ্টানত্ম বিশ্বে নেই। ভারতের রাজনীতিতে সেই দৃষ্টানত্ম জ্যোতি বসু স্থাপন করেছেন।
পশ্চিম বঙ্গে আজ যে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট সরকারের পতনোন্মুখ অবস্থা তার একটি মূল কারণ নেতৃত্বে জ্যোতি বসুর অনুপস্থিতি এবং রাজ্যে তাঁর পরবতর্ী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অহমিকা ও অদূরদর্শিতা। জ্যোতি বসু রাজ্যের বাম রাজনীতিতে সৰম ও সক্রিয় নেতৃত্ব দিতে পারলে আজকের অবস্থার উদ্ভব হয়ত হতো না। সিন্ধুর ও নন্দীগ্রাম নিয়ে বামফ্রন্ট সরকার গণবিরোধী নীতি গ্রহণ করে জনপ্রিয়তা হারাত না এবং ফ্রন্টের ঐক্য নষ্ট হতো না। জ্যোতি বসু বার্ধক্যপীড়িত অবস্থাতেও দলের পতন ঠেকানো এবং দলের ঐক্য, সংহতি ও জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনার জন্য মৃতু্যর পূর্ব পর্যনত্ম অবিরাম চেষ্টা করেছেন এবং ফ্রন্ট সরকারকে বিভিন্ন ভুলভ্রানত্মি থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছেন। জ্যোতি বসুর মৃতু্যতে পশ্চিম বঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে গেল। তাঁর অশুভ ছায়া সারা ভারতের রাজনীতিতেই ছড়িয়ে পড়বে।
জ্যোতি বসু গণমানুষের নেতা ছিলেন। সেদিক থেকে তিনি বাংলাদেশের গণমানুষের আন্দোলন ও সংগ্রামে একজন সহমর্মী নেতাও ছিলেন। যদিও তাঁর মৃতু্য পরিণত বয়সে ঘটেছে, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ার ধাক্কা থেকে বাংলাদেশও রৰা পাবে না। সারা উপমহাদেশের রাজনীতি একজন জ্যোতির্ময়, গতিময় এবং বর্ণাঢ্য চরিত্রের নেতাকে হারাল। এই শূন্যতা, এই ৰতি অপূরণীয়। তাঁর রাজনীতিতে ভুলভ্রানত্মি ছিল না তা নয়, কিন্তু সব কিছুর উর্ধে তিনি ছিলেন গণমানুষের আত্মার আত্মীয়। আমরা সকলেই তাঁর মৃতু্যতে শোকাভিভূত। জ্যোতি বসু আজ মৃত। জ্যোতি বসু দীর্ঘজীবী হোন।
ঢাকা, ১৭.০১.২০১০
রবিবার

No comments

Powered by Blogger.