প্রতিমন্ত্রী অবিরুদ্ধ, হামলায় ইউএনও আহত- বাঘাইছড়ি থমথমে by জীতেন বড়ুয়া

গত শুক্র ও শনিবারের রক্তয়ী ঘটনার পর বাঘাইছড়ি পরিস্থিতি এখনও থমথমে অবস্থায় রয়েছে। বলবৎ রয়েছে শনিবার সকাল থেকে জারি করা ১৪৪ ধারা।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার ও তাঁর গাড়ির বহর অবরোধের শিকার হয়ে তোপের মুখে পড়েন। এ সময় বাঘাইছড়ির ইউএনওর ওপর হামলা চালায় উপজাতীয় যুবকরা। এতে তিনি ও তাঁর গাড়িচালক আহত হয়েছেন। রবিবারের সংঘর্ষ ও বসতবাড়ি এবং দোকানপাটে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তিগ্রসত্ম হয়েছেন কমপ্লেক্স এক হাজারেরও বেশি মানুষ। এদের অধিকাংশই পাহাড়ী জনগোষ্ঠী। রেড ক্রিসেন্টের প থেকে রবিবার স্বল্প পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করতে গিয়ে তা বিতরণ না করে ফিরে আসতে হয়েছে। সংঘটিত ঘটনায় এখনও কোন তদনত্ম কমিটি হয়নি। মেলেনি কোন সরকারী ত্রাণসামগ্রী। এছাড়া ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২-এর বেশি বলে বিভিন্ন প থেকে দাবি করা হলেও এর বেশি লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে পাহাড়ী ও বাঙালীদের প থেকে অনেকে নিখোঁজ থাকার দাবি করা হচ্ছে।
রবিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, পাহাড়ী-বাঙালী উভয় সমপ্রদায়ের মানুষের মাঝে বিরাজ করছে অজানা আতঙ্ক। রাসত্মায় রাসত্মায় সেনাবাহিনী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক টহল অব্যাহত রয়েছে। তবে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাসের যে ডালপালা বিসত্মার করেছে তার অবসান হচ্ছে না। ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে প্রশাসন ব্যাপক তৎপর রয়েছে। এদিকে, সংঘটিত ঘটনার প্রতিবাদে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) রবিবার খাগড়াছড়ি শহরে বিােভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে বিচার বিভাগীয় তদনত্ম দাবি করেছে। অপরদিকে চলমান এসএসসি পরীার কারণে ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট) আহূত সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচী আজকের পরিবর্তে আগামীকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে।
রবিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, রাসত্মার দু'ধারে সর্বত্র আগুনের লেলিহান শিখায় গ্রাস হওয়ার দৃশ্য। বসতবাড়ি ছাড়াও গাছপালাও রা পায়নি আগুন থেকে। আগুনে ভস্মীভূত গ্রামগুলোর তিগ্রসত্ম বাড়িঘর ও দোকানপাটের ধ্বংসসত্মূপ থেকে এখনও বেরম্নচ্ছে ধোঁয়া। উপজেলার বঙ্গালতলীর বটতলা এলাকা থেকে বিুব্ধ পাহাড়ীরা রবিবার নিহত হয়ে নিখোঁজ লক্ষ্মী বিজয় চাকমা (৩৭) নামের যুবকের লাশ নিয়ে বিােভ করে মন্ত্রীর গাড়িবহর অবরোধ করলে তিনি তোপের মুখে পড়েন। এ সময় উত্তেজিত পাহাড়ী বিুব্ধ যুবকরা বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করেছে। উপজাতীয় মহিলারা ইউএনওর গাড়ি ল্য করে জুতা ও আগুনে পোড়া কলার ছড়া নিপে করে। এ সময় ইউএনও এএসএম হুমায়ুন কবীর ও তার ড্রাইভার মিহির চৌধুরী আহত হন। সংঘটিত ঘটনায় এ পর্যনত্ম ২টি লাশ ছাড়া আর কোন লাশ পাওয়া যায়নি। তবে গ্রামবাসীদের অনেকের দাবি সামপ্রদায়িক এ ঘটনায় উপজাতীয়দের ৪ জনের লাশ স্থানীয় সেনা ক্যাম্পে গুম করা হয়েছে। অপরদিকে, স্থানীয় বাঙালীরা দাবি করেন, তাদের ১ জন গুলিবিদ্ধসহ অনত্মত ৮ জন আহত ও ৬ জন নিখোঁজ রয়েছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে আরও দেখা গেছে, শনিবারের ঘটনায় বাঘাইছড়ির সাজেকের কয়েকটি পাহাড়ী-বাঙালী গ্রামের দু'শতাধিক বাড়িঘর সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। অগি্নকা-ে তিনটি বৌদ্ধ বিহার, একটি গির্জা সম্পূর্ণরূপে পুড়ে যায়। তবে স্থানীয় প্রশাসন এখনও পর্যনত্ম তিগ্রসত্মদের তালিকা নিরূপণ করতে পারেনি। তবে কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, ঘটনায় বাঙালী ৫৩টি ও উপজাতীয় ৭৪টি বাড়ি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে। বনানী বৌদ্ধ বিহারের অধ্য জানান, এখনও পর্যনত্ম লোকবংশ ভিু নিখোঁজ রয়েছে।
অন্যদিকে সেনাবাহিনী সূত্রে জানা যায়, শনিবারের ঘটনায় আহত ২ সেনাসদস্য চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম সিএমএইচে চিকিৎসাধীন গুরম্নতর আহত সেনা সার্জেন্ট রেজাউল হকের আশঙ্কাজনক অবস্থা এখনও কাটেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার এমপি, প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় উপজাতীয় শরণাথর্ী ও অভ্যনত্মরীণ উদ্বাস্তু বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপিসহ উর্ধতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা রবিবার সকালে সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে পথে পথে দফায় দফায় তাঁরা অবরোধের মুখে পড়েন। একাধিক স্থানে মন্ত্রীর গাড়ির বহরকে তিগ্রসত্মরা দীর্ঘণ অবরোধ করে রাখে। একপর্যায়ে ুব্ধ উপজাতীয়রা মন্ত্রীকে লাশ দেখতে বাধ্য করে। পরে প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার উপজাতীয়দের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি আপনাদের কথা শুনতে এসেছি। ঘটনা সরেজমিন প্রত্য করছি। মন্ত্রী ঘটনাকে দুঃখজনক বলে উলেস্নখ করে ৭ দিনের মধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরম্নদ্ধে তদনত্মপূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন। গ্রামবাসীরা জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার, তিগ্রসত্মদের পুনর্বাসন, আহতদের চিকিৎসাসহ বাঙালী ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়ে তাদের বেদখলকৃত জায়গাজমি ফেরত দেয়ার দাবি জানান।
বঙ্গাতলী থেকে ফেরার পথে সাজেকের বাঘাইহাটে বাঙালীরা প্রতিমন্ত্রীর বহরকে অবরোধ করেন। এ সময় মন্ত্রী বাঙালী গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে সাজেক ইউনিয়ন পরিষদে এক সংপ্তি মতবিনিময় সভা করেন।
সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের কোন বিচ্ছিন্ন অংশ নয়। এখানে পাহাড়ী-বাঙালী সবাই সমভাবে বসবাস করবে। একটি গোষ্ঠী এখানে সামপ্রদায়িক উস্কানি দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ অপচেষ্টা দেশজুড়ে চালানো হচ্ছে। তিনি পাহাড়ী-বাঙালী সকলকে সামপ্রদায়িকতার উর্ধে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শানত্মি সমপ্রীতি ও সৌহার্দপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করার জন্য পরামর্শ দেন। আঞ্চলিকতার ধোয়া তুলো একটি গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের শানত্মিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করতে চায় বলে উলেস্নখ করে মন্ত্রী বলেন, তারা এখানে অস্ত্রবাজি ও চাঁদাবাজি করছে। সরকার এদের বিরম্নদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান। খাগড়াছড়ি থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ী-বাঙালী সহাবস্থানে বসবাস করে আসছে। এ সহাবস্থান নস্যাত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে একটি গোষ্ঠী অপচেষ্টা চালায়। বর্তমান মহাজোট সরকার পার্বত্য সমস্যার ব্যপারে যখন আনত্মরিক পদপে নিচ্ছে, তখনই মহলটি পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে নানা ষড়যন্ত্র শুরম্ন করেছে। তিনি সকলকে মিলেমিশে পার্বত্য শানত্মি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান। এ সময় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, বাঘাইছড়ি জোন কমান্ডার লে. কর্নেল ওয়াসিম, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবতর্ী, পুলিশ সুপার মাসুদুল হাসান, রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী কামাল উদ্দিন এবং বাঘাইহাট বাজার সেক্রেটারি ডা. নাজিমউদ্দিন।
এদিকে রাঙ্গামাটি পুলিশ সুপার জানান, দীর্ঘদিন ধরে বাঘাইছড়িতে পাহাড়ী-বাঙালীর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সম্প্রতি এ পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য উভয় সমপ্রদায়ের নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে একটি শানত্মি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি শানত্মি স্থাপনে অনেক দূর এগিয়ে যায়। ১৮ ফেব্রম্নয়ারি সফল একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু একটি কুচক্রী মহল শানত্মি নস্যাত করতে এ অঘটনে ইন্ধন যোগায়। তাছাড়া এলাকাটি রাঙ্গামাটি জেলা সদর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার ও বাঘাইছড়ি উপজেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ফলে কোন ঘটনা ঘটলে তড়িৎ প্রশাসনিক ্পদপে নেয়া সম্ভব হয় না। উলেস্নখ্য যে, খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে।
নিরাপত্তা বাহিনীর বাঘাইহাট জোন অধিনায়ক লে.কর্নেল ওয়াসিম এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আগুন লাগার সংবাদ পেয়ে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে যায়। এ সময় উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা সেনা টহল ল্য করে গুলি করলে সেনা সদস্যরা পাল্টা গুলি চালাতে বাধ্য হয়। তবে সেনাবাহিনী ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে পরিস্থিতি শানত্ম করার চেষ্টা চালাচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এএসএম হুমায়ুন কবীর জানান, মহলবিশেষের প্ররোচনায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এসব ঘটনা প্রায়শই ঘটছে। এখানে পাহাড়ী-বাঙালীর মধ্যে একে অপরের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
অপরদিকে নিহত বুদ্ধপদি চাকমার মেয়ে সুমিতা চাকমা জানান, সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় আমাদের গ্রামে (গঙ্গারাম মুখ) বাঙালীরা অগি্নসংযোগ করে। এ সময় সেনাবাহিনী এলাপাতাড়ি গুলি করলে আমার মা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। বঙ্গলতলী গ্রামের নিটন চাকমা জানান, তাদের গ্রামের দু'যুবককে সেনাসদস্যরা বেদম প্রহার করে ধরে নিয়ে যায়। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা আমরা এখনও জানি না। বাঘাইছড়ি উপজেলা জনসংহতি সমিতির সভাপতি সুশীল বিকাশ চাকমা জানান, যখন বাঘাইছড়ির উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে পাহাড়ী-বাঙালীদের নিয়ে শানত্মি প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছিল তখনি এ আঘাত এলো। বাঘাইহাটের সাধারণ কৃষক শেখ আলী জানান, পাহাড়ীদের যে এলাকায় অগি্নকা-ের ঘটনা ঘটেছে সেখানে বাঙালীদের যাওয়া খুবই দুরূহ। তাঁরা এলাকার শানত্মিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করার জন্য একটি মহলের ইন্ধনে নিজেদের বাড়িঘরে অগি্নসংযোগ করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করছে।

No comments

Powered by Blogger.