বরিশালের গৌরনদীতে কয়েক ঘণ্টা অনেক অভিজ্ঞতা by ড. আর এম দেবনাথ

কীঠা, এর মধ্যেই সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হয়ে যেতে হবে মতিঝিলে। সেখান থেকে সাতটায় যাত্রা শুরম্ন হবে। আমার নিজের আগ্রহ আছে তার ওপর বোর্ড সেক্রেটারি মোসাদ্দেক আলীর তাগিদ। যথাসময়ে হাজির হয়ে গেলাম মতিঝিল।
গাড়ি প্রস্তুত। আমরা দল বেঁধে যাব বরিশালের গৌরনদী। আরও পরিষ্কার করে বললে বলতে হয় যাব গৌরনদীর একটি হাটে যার নাম ভূরঘাটা। ওখানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে একটি বিশেষ ধরনের ঋণের। ঋণটি দেবে জনতা ব্যাংক লিমিটেড। ঋণদান কর্মসূচীর উদ্বোধন করবেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত, যিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান। মূলত তাঁরই 'ড্রিম প্রজেক্ট' এটা। ভূমিহীন ও প্রানত্মিক কৃষকদের জন্য সুদমুক্ত বিশেষ ঋণ এটি। ব্যাংকের ঋণ, অথচ সুদমুক্ত পরীৰামূলকভাবে। এ কারণেই আমার আগ্রহ হয় তা দেখার। এই ফাঁকে গৌরনদী দেখার। গৌরনদী ও আগৈলঝারা পাশাপাশি উপজেলা যা ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অত্যাচার-নিপীড়নের উদাহরণ হয়ে আছে। এ অঞ্চলটিতে আগে কোনদিন যাইনি। তার ওপর ২০০১ সালে যখন দিনের পর দিন আগৈলঝারায় সংঘটিত ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালানো, সহায়-সম্পত্তি লুটের রোমহর্ষক ঘটনা পড়েছি তখনই ঠিক করি সুযোগ পেলে এই জায়গাটি একবার দেখে আসব। সেই সুযোগ যখন ব্যাংক করে দেয় তখন আমি তা লুফে নিই। পূর্বাহ্নে নানাবিধ তথ্য জেনে নিই বলরাম পোদ্দারের কাছ থেকে যিনি ঐ অঞ্চলের সনত্মান। ও বলল বেশি দূরের যাত্রা নয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমরা পেঁৗছে যাব। মাঝখানে পদ্মা নদী পড়ে, নতুবা চোখের পলকে চলে যাওয়া যেত ভূরঘাটায়। সত্যিই তাই। মতিঝিলের কেন্দ্র থেকে মাওয়া ঘাট পেঁৗছতে আমাদের লাগল মাত্র পঞ্চাশ মিনিট। রাসত্মা ছিল ফাঁকা। ফেরি কিশোরী ছিল রেডি। মনে আশা ছিল নৌকা দেখব, পাল তোলা নৌকা। পদ্মা আমাকে দারম্নণ হতাশ করল। আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে কলকাতা যাওয়ার পথে আরিচায় দেখা পদ্মার সঙ্গে। তখন পাল তোলা নৌকা আমার টার্গেট ছিল না। কিন্তু ২৩ জানুয়ারি তা ছিল যেদিন আমরা দল বেঁধে যাচ্ছিলাম গৌরনদীতে। পদ্মায় দেখলাম 'স্পিড বোট' আর 'স্পিড বোট।' যাত্রীরা মাথাপিছু ১০০-১২০ টাকা দিয়ে মাওয়া ঘাট-চর জানাজাত পারাপার হচ্ছে। বড় নৌকা, পানশি নৌকা, ধান বোঝাই, পাট বোঝাই নৌকা, যাত্রীবাহী নৌকা কোন কিছুরই সন্ধান পেলাম না। পাল তোলা নৌকা তো দূরের কথা। সকাল তখন আটটা। দু'ঘণ্টা ফেরিতে। ভোরের সূর্য, সকালের সূর্য দেখলাম কিন্তু পদ্মায় কোন বড় নৌকা দেখলাম না। গান গাওয়া মাঝির প্রশ্নই উঠে না। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি' কী এই বাংলাদেশ থেকে শেষ পর্যনত্ম বিলীন হয়ে যাবে?
ফেরিতে নাশতা করলাম ভাল, আড্ডাও জমল ভাল। মধ্যমণি কামাল ভাই। সঙ্গে সর্বজনাব নজিবর রহমান, আবদুল রউফ সরদার, আমিনুর রহমান যাঁরা সবাই জনতা ব্যাংকের পরিচালক। চেয়ারম্যান ড. বারকাত ও পথপ্রদর্শক বলরাম পোদ্দার তো আছেনই। আছেন ব্যাংকের ড. জিলস্নুর রহমান, জনাব আয়াত আলীসহ অনেক উর্ধতন কর্মকর্তা। গল্প হচ্ছে ঠিকই, আমি কিন্তু হতাশ পদ্মা দেখে। মাঝে মাঝেই চর। ফেরি যাচ্ছে এঁকেবেঁকে। ওপার পেঁৗছতে তাই লাগল পাক্কা দু'ঘণ্টা। ওপারে কাওরাকান্দি, মালিগ্রাম, ভাঙ্গার ওপর দিয়ে যখন গাড়ি যাচ্ছে দেখলাম দু'দিকে সবুজের সমারোহ। খুবই ভাল রাসত্মা। দ্রম্নততম গতিতে যাওয়ার উত্তম রাসত্মা। দু'পাশের জমিতে সবুজের ফাঁকে ফাঁকে হলুদের খেলা। পিঁয়াজ, গম, ধনিয়া ফসলের মাঝখানে সরিষার গাছ। জীবনানন্দের বরিশাল। এখন তো আর বরিশাল নেই। ভেঙ্গে কয়েকটি জেলা হয়েছে। রাসত্মার দুই ধারে লম্বা লম্বা গাছ। এই অপূর্ব শোভা দেখতে দেখতে যাওয়ার সময় ভাবছিলাম প্রকৃতি কি নিষ্ঠুর হতে পারে। যেখানে যাচ্ছি দরিদ্রদের মাঝে তারা কিছুদিন পর পর ৰতিগ্রসত্ম হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বারা। আইলায় তারা ৰতিগ্রসত্ম, সিডরে তারা ৰতিগ্রসত্ম। পত্রিকায় পড়েছি এখন এ অঞ্চলের বহুলোক রাসত্মায় বসবাস করে। অনেকের বাড়িঘর জলের তলে। এসব ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছি আর নিজেকেই প্রশ্ন করছি। কত লোককে ব্যাংক ঋণ দেবে? ব্যাংক কত লোককে সাহায্য দিতে পারবে? সরকারই বা কি করবে? লাখ লাখ মানুষ কি করে বাঁচবে?
অনেক কথা ভাবতে ভাবতেই মাদারীপুর জেলার সীমানত্মে পেঁৗছি। যেখানে মাদারীপুর শেষ, সেখানেই গৌরনদীর শুরম্ন, শুরম্ন ভূরঘাটা। মাঝখানে একটা খাল। এখানে এখন কোন জল নেই। 'ভূরঘাটা' নাম থেকেই বোঝা যায় এটা ছিল একটা বড় খেয়াঘাট। আজ আর বোঝার কায়দা নেই। স্থানীয়রা বললেন এ খালের দৈর্ঘ্য বেশ বড়। যে আড়িয়াল খাঁ নদের সঙ্গে এর যোগাযোগ সে নদও মর মর অবস্থা। ওখানে ড্রেজিং হচ্ছে অল্প স্বল্প। জল নেই। আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেল অনেক গভীরে। স্থানীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুচ বললেন, আমাদের সমস্যা খুব বড়। এখানকার জমি এক ফসলী। এ জমি দু'ফসলী বা তিন ফসলী করা না গেলে এ অঞ্চলের ভাগ্যের উন্নতি হবে না। বক্তৃতায় তিনি বললেন, গৌরনদী-আগৈলঝারা এখন শানত্মির জনপদ। ৰমতাসীন দলের কমর্ী-সমর্থকরা ২০০১ সালের নির্যাতনের কোন বদলা নেয়নি, নিতে পারত। স্থানীয় একজন আমাকে বললেন ২০০১ সালে যারা নির্যাতন করেছে বিশেষ করে যারা সংখ্যালঘু নারীদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছে তাদের বিচারের কোন ব্যবস্থা এখনও হয়নি। অথচ এটি গণমানুষের দাবি। আমরা গেছি ঋণ কর্মসূচীতে। এর ফাঁকে ফাঁকে এসব কথা শুনছি। শুনলাম বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের প্রিন্সিপালের বক্তব্য। তিনি বললেন, সুদের হার একটি বিষয়। কিন্তু এর চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে অন্যান্য ব্যয়। তিনি ঐ নানা ধরনের ব্যয়ের ওপর গুরম্নত্ব দিলেন। তার বক্তব্যে ইঙ্গিত হচ্ছে ঘুষ-দুনর্ীতির প্রতি। গ্রামীণ খাতে ঋণ বিতরণের সময় ব্যাংকগুলো দুনর্ীতিতে জড়িয়ে পড়ে। তিনি এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বনের কথা বললেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা বিশেষ ঋণ কর্মসূচীর লৰ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বললেন। বিসত্মারিত বললেন ড. বারকাত যার 'ড্রিম প্রজেক্ট' এটি। তিনি দীর্ঘৰণ বক্তৃতা করলেন। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের কথা উলেস্নখ করে ড. বারকাত বললেন, দুই অর্থনীতি, দুই রাজনীতির কথা। সারাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি কিভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে তার বর্ণনা দিলেন। কিভাবে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক উদার কল্যাণ রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র নস্যাত করে তার বর্ণনা যখন তিনি দিচ্ছিলেন তখন আমার ধারণা হয় উপস্থিত লোকজনের ধৈর্যচু্যতি ঘটবে। একে দুপুর বেলা, তার ওপর ভাবগম্ভীর বক্তৃতা। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না গ্রামের লোকজন এ ধরনের বক্তৃতা শুনবে। স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, বক্তৃতা তো রাজনৈতিক কোন বক্তৃতা নয়, মানুষ কি কারণে তা ধৈর্য ধরে শুনল। উনি বললেন, মানুষ এখন মেঠো বক্তৃতা পছন্দ করে না। তথ্য প্রমাণসহ কথা কেউ বলে না। বললে মানুষ শোনে। শোনে এবং ভবিষ্যতের জন্য বুক বাঁধে। কি আর করবে? ঠকতে ঠকতে মানুষ এখন অসহায় হয়ে পড়েছে। সুদ দিয়ে মানুষ ঋণ পায় না। পেলে ঋণের জন্য দিতে হয় ঘুষ। সুদের হার এনজিওদের ৰেত্রে উচ্চ। মহাজন ও এনজিওদের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ। মহাজনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ এনজিওদের বরণ করে নেয়। এখন দেখা যাচ্ছে এগুলো হচ্ছে ভদ্রবেশী যম। এ প্রেৰাপটে যখন শোনে যে সরকারী ব্যাংক সুদমুক্ত ঋণ দেবে, তখন অনেকেই বিশ্বাস করেনি। কত লোক কত কথা বলে। এটা বুঝতেই সভায় অনেক লোক এসেছে, একজন আমাকে বললেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পালা। তখন বেলা চারটা। যথারীতি ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে চরজানাজাত ফেরিঘাটে পেঁৗছলাম। ভাবছিলাম দরিদ্র, ভূমিহীন, প্রানত্মিক চাষীদের কথা। ভাবছিলাম ঋণের টাকা ফেরতের কথা। ভাবছিলাম সুদমুক্ত ঋণের প্রসার-সম্ভাবনা কতটুকু এ সম্বন্ধে। এসব যখন মাথায় তখনই এক মুড়িওয়ালার সঙ্গে ফেরিতে জমে গেল। সন্ধ্যে বেলা। কথা হচ্ছিল কাদির সরদারের সঙ্গে। নিতানত্মই সহজ-সরল একজন প্রৌঢ়। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করতেই সে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকাল। ও বলল, আমার নিজের বাড়ি নেই। কি বল? প্রশ্ন করাতেই কাদির বলল ওর নিজের কোন জমিজমা নেই। বাড়িঘরের জায়গাও নেই। থাকে একজন দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গে। ওর কথাতে গ্রামটির নাম ধরতে পারলাম না। ফেরির মেশিনের আওয়াজ। মানুষের উচ্চৈঃস্বরের কথাবার্তা। যা শুনলাম তাতে বুঝলাম গ্রামের নাম কালাই হাজিকান্দি। ওখানে সে থাকে। একটা বড় ঘর। ভাড়া দেয় মাসে ১৫০ টাকা। কাদির ভূমিহীন, কিন্তু চাষী বা কৃষক নয়। ও বেছে নিয়েছে মুড়ি বেচার কাজ। মুড়ির সঙ্গে বিক্রি করে আলুর তরকারি। কাদিরের একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। মেয়েটি বড়, অল্প বয়সে ওর বিয়ে দিয়েছে। এর জন্য তাকে দেনা করতে হয়েছে। তা এখন পরিশোধ করছে। এটি তার জন্য বিরাট বোঝা। মহাজনের কাছ থেকে ঘন ঘন তাগিদ পায়। কিন্তু ও অসহায়। তার স্ত্রী কিছু করে না। বাড়িতেই থাকে। কিছু একটা যে করবে তার জন্য পয়সা নেই। মাঝে মাঝে সরকারের কাছ থেকে চাল-গম পায়। এ পর্যনত্ম কয়েকবার পেয়েছে। কিন্তু ওর কোন 'কার্ড' নেই। কার্ডের কথা বললেই তাকে দিব-দিচ্ছি বলে ঘুরানো হচ্ছে। চাল যখন পায় তা হয় ওজনে কম। তবু সে খুশি। কারণ এতে তার আয়ের 'সাপিস্নমেন্ট' হয়। কত আয় করে সে? দিনে ৪-৫ কেজি মুড়ি কিনে তা তেল মাখিয়ে বিক্রি করে। এর সঙ্গে কেউ আলুর তরকারি খায়। কেউ খায় না। মাঝে মাঝে সিদ্ধ ডিমও রাখে। তবে তা খুবই কম। এসব মাল বিক্রি করে দিনে ও কত পায়? ও বলল খুব ভাল দিন গেলে ২০০ টাকাও পায়। কখনও ১০০ টাকা হয়, কখনও ১৫০ টাকা হয়। খুবই অনিশ্চিত এ জীবন। এখন বেচা-কেনা কম। কুয়াশা। ফেরি চলাচল কম। লোকজন ফেরির ওপর ঠা-ায় ঘোরাফেরা করে না। এ কারণে বেচাকেনা কম। বললাম, তোমার ছেলে কি করে। ছেলেটি ছোট, মেয়েটি বড়। ছেলেটি কাজের উপযুক্ত হয়নি। স্কুলে দিয়েছিলে? দিয়েছিলাম, কিন্তু স্কুলে যায় না। কেন? এর কোন উত্তর পেলাম না। জোর করে পাঠাও না কেন? সে নিরম্নত্তর। সরকার যে স্কুলে পড়লে বিনা পয়সায় বই দেয় এটা জান? সে নিরম্নত্তর। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করাতে ও বলল, সে তা জানে না। মোৰম একটা কথা বলল কিছুৰণ পর। আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ও বলল, আমরা গরিব মানুষ, আমরা লেখাপড়া করে কি করব, গরিব বলেই তো পড়াশোনা করা দরকার আমি বললাম। সে নিরম্নত্তর। মনে মনে ভাবলাম 'দিন বদলের' কথা ওর কাছে কে পেঁৗছাবে? ও কি সরকারের হিসেবের মধ্যে আছে? কাদির যদি 'দিন বদল' না বোঝে তাহলে 'দিন বদল' হবে কার জন্য? এসব ভাবছিলাম আর ভাবছিলাম। আমি কিছুটা তখন আবেগপ্রবণও। আমার পাশেই তখন আরেকজন পড়নত্ম যৌবনের লোক। ওর নাম ধনু মিঞা।
ধনু মিঞা আমাকে বলল, আপনি কি লিখছেন? বললাম, কাদিরের সঙ্গে কথা বলছি। আমার মনে থাকে না। তাই নোট করে নিচ্ছি। বাড়িতে গিয়ে এগুলো পড়ব। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি কি কর? ও মুরগির একটা খাঁচা দেখিয়ে বলল, আমি মুরগি এপার থেকে নিয়ে ওপারে বিক্রি করি। কতগুলো মুরগি এ খাঁচায়? ১১০টা মোরগ-মুরগি খাঁচায়। ধনু মিঞার বয়স হবে ৫০-এর নিচে। কিন্তু মনে হয় অনেক বেশি। দাঁড়ি আছে, মাথায় আছে টুপি। গলায় মাফলার। বাড়ি তার লৌহজংয়ের দৰিণ মাসুন্দা। ও মাল কিনে পদ্মার ওপার থেকে। বাজারের নাম বুঝতে পালাম না। বিক্রি করে ঘোড়াদৌড় বাজারে। একটি মুরগির পড়তা পড়েছে ১৯০ টাকা। কত করে বিক্রি হবে? ধনু মিঞা বলল, ২০০-২১০ টাকা প্রতিটি। সব মুরগি বিক্রি হলে কত থাকবে? ও বলল ১০০০-১২০০ টাকা। প্রতিদিন তা হয়? কি যে বলেন স্যার, তার উত্তর। বুঝলাম সপ্তাহে সাধারণত দুদিন সে আসে। তাহলে মাসে কত হয়? গড়ে ছয় থেকে আট হাজার। কারণ সব সময় চাহিদা এক রকম থাকে না। এ ছাড়া দেশী মুরগির চাহিদা কমছে। 'পাকিসত্মানী' নামীয় এক ধরনের মুরগির দাম কম। এ কারণে বেচাকেনা কমের দিকে। তুমি কি অন্য কিছু কর? চেষ্টা করেছিলাম। হয়নি। আলু লাগাতে চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি। আলু চাষে অনেক টাকা লাগে। তবু আব্বার কাছ থেকে জমি নিয়ে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আব্বা টাকা ছাড়া জমি দিতে চান না। মায়ের পীড়াপীড়িতে একবার দিয়েছিলেন। আমার মা খুব ভাল ছিলেন। তিনি আর নেই। তিনি আব্বাকে বলতেন
ধনুর সংসার বড়। ৫টি মেয়ে, ১টি ছেলে। ৫টি মেয়েই বড়। ছেলে সনত্মানের আকাঙ্ৰায় তার সংসার বড় হয়ে যায়। আমার মা সেজন্য আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু মায়ের মৃতু্যর পর আমি আর আলু চাষের কথা ভাবিনি। এত টাকা আমার নেই। এমনিতেই দেনাদার। ৫ মেয়ের মধ্যে ২ মেয়ের বিয়ে হয়েছে। প্রথমটির বিয়েতে খরচ গেছে এক-দড় লাখ টাকা। দ্বিতীয়টির বিয়ে দিতে গিয়ে ধনু মিঞা বিপদে পড়ে। হাতে টাকা নেই। ধারদেনাও পায় না। কি করবে? সে বাধ্য হয়ে 'বাকিতে' বিয়ে দেয়। 'বাকিতে' বিয়ের কথা শুনে আমি তো অবাক। এটা কি? 'বাকিতে' বিয়ে মানে ছেলেপৰকে সে কথা দিয়েছে এটা দেবে, ওটা দেবে? এর মধ্যে নগদ টাকাও আছে। কিন্তু ঐ টাকা সে এখনও দিতে পারেনি। জামাই মেয়েকে দিয়ে তাগিদ দিচ্ছে। এই নিয়ে এখন সে দারম্নণ দুশ্চিনত্মায় আছে। কথামতো কাজ না করলে মেয়ের যদি কোন ৰতি হয়। ধনু মিঞাকে বললাম, ব্যাংক থেকে ঋণ নাও না কেন? দেখলাম এ ব্যাপারে সে উৎসাহী নয়। 'এনজিওর' কথা সে শুনেছে। কিন্তু এ সম্পর্কে তার ধারণা ভাল নয়। এরা সুদ নেয় বেশি। লোকমুখে তাদের সম্বন্ধেও ভাল শোনে না। এ কারণে সে ব্যাংক ঋণ বা 'এনজিও' ঋণ কোনটার কথাই ভাবে না। এ কথা শুনে আমার একু খটকা লাগল। গ্রামগঞ্জে এত ব্যাংক শাখা কাজ করছে কতদিন ধরে অথচ ধনু মিঞার ব্যাংক সম্বন্ধে ধারণা ভাল নয়। উলেস্নখ্য, কাদির ও ধনু মিঞা দু'জনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেমন আছে তারা। একই উত্তর দু'জনের 'আলস্নাহ আমাদের ভালই রেখেছে।' অদ্ভুত, দু'জনের একজনেরও কোন অভিযোগ নেই। ধান-চাল একটু সসত্মা তাতেই তারা খুশি। অথচ শহরে দেখি মানুষের কত অভিযোগ, সরকার এটা করছে না কেন, ওটা করছে না কেন ইত্যাদি। গ্রামের মানুষের মধ্যে এ খাই খাই নেই। তাদের তৃপ্তি খুব অল্পে। তারা সন্তুষ্ট খুব অল্পে। এটা দেখেছি আগেও যা এখনও তাই আছে। কাদির ও ধনু মিঞার কথা ভাবতে ভাবতে ফেরির ওপরে চা খেতে গেলাম। সেখানে ভিন্ন একটা আমেজ পেলাম।
চা খেতে খেতে কথা হলো এক বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি একটি ব্যাংকের পুরো বোর্ড দেখে একটা সুপারিশ করলেন। বললেন, একটা 'ওল্ড হোম' ফিন্যান্স করতে। কি রকম ওল্ড হোম? তার কাছে খবর আছে অনেক লোকের। তাদের বয়স হয়েছে। কেউ দেশে আছে, কেউ বিদেশে আছে। ছেলেমেয়ের সঙ্গে তাদের বসবাস করার সুযোগ নেই। সবাই তারা এখন নিউকিয়ার ফ্যামিলির সদস্য। সবাই স্বাধীন। ছেলেমেয়ের এই নবলব্ধ স্বাধীনতায় বুড়োরা পরিত্যাজ্য। তাদের দেখাশোনার কোন লোক নেই। অসুখ হলে দেখার কেউ নেই। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো কোন ব্যবস্থা নেই। ভদ্রলোকের মতে, তিনি এমন অসহায় দু'জন প্রাক্তন সচিবের কথাও জানেন। তাদের বাড়িঘর নেই। একথা শুনে আমি হতবাক। দু'জন প্রাক্তন সচিব, অথচ তাদের বাড়িঘর নেই ঢাকায়। অসম্ভব একটা ব্যাপার। আমি বললাম না এটা হতে পারে না। ঢাকা শহরে প্রাক্তন দুই সচিবের বাড়িঘর নেই, এটি সত্য খবর হতে পারে না। আমলারা আর যাই হোক বাড়ির ব্যবস্থাটা করে ফেলে প্রথম জীবনেই। আমার কথা শুনে ভদ্রলোক বললেন, আপনার কথা ঠিক। কিন্তু আপনি কি জানেন ঢাকায় বহু অবসরপাপ্ত অফিসার আছেন যারা 'স্ত্রী-পরিত্যক্ত।' প্রতিদিন শুনি স্বামী পরিত্যক্তদের কথা। স্ত্রী পরিত্যক্ত লোক আছে আজ শুনলাম। বাড়িঘর স্ত্রীর নামে। স্ত্রী যখন পরিত্যাগ করে তখন বাড়িটাও যায়। এমন হতভাগা ঢাকা শহরে অনেক। আমি তাকে বললাম, আপনার প্রসত্মাব মতো ব্যাংক 'ওল্ড হোম' করলে কোথায় করবে? মিরপুর, উত্তরায়? উনি বললেন, না। কথায় যা বুঝলাম তাতে মনে হলো উনি যাদের কথা বলছেন তাদের টাকা পয়সা কোন সমস্যা নয়। 'ওল্ডদের' কথামতো খাবার-দাবার, পরিচর্যা, চিকিৎসার সুযোগ দিতে পারলে তারা মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকা দিতেও রাজি। টাকা তাদের জন্য সমস্যা নয়। তারা চায় একটু কেয়ার, স্নেহ, শেষ বয়সে একটু আশ্বাস, নিরাপত্তা। ভদ্রলোকের কথা শুনতে শুনতে ভাবলাম ড. বারকাতের কথা। তিনি বিশেষ ধরনের ঋণের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন 'দুই বাংলাদেশের' কথা। 'দুই বাংলাদেশের' উদাহরণ পেয়ে গেলাম। আমরা তা দেখছিও প্রতিদিন। এ দেশের জনগণের বৃহত্তর একটা অংশ ভুগছে অর্থাভাবে। তাদের ভাত নেই, কাপড় নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, শিৰা নেই। অন্যদিকে রয়েছে আরেকটি জনগোষ্ঠী যাদের সব আছে। কিন্তু মানসিক শানত্মি নেই। তারা বলতে পারে না 'আলস্নাহ ভালই রেখেছে।' আরেকটি জনগোষ্ঠী রয়েছে যাদের কিছুই নেই, কিন্তু নির্দ্বিধায় বলতে পারছে 'আলস্নাহ ভালই রেখেছে।' যেমনটা বলেছে কাদির সরদার। এই নিয়েই আমাদের নিত্যদিনের বাংলাদেশ। এখানেই কথা হচ্ছে 'দিন বদলের।' কঠিন এক সংগ্রাম।!

লেখক : অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার
ঊ-সধরষ : ৎধহধফবনহধঃয@সংহ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.