চিলির রাজনীতির নেপথ্যে সিআইএ! by শামীম আহমেদ

চিলির মেদ মাংস তবিত মুখ ঝঞ্ঝাতানায়, অত্যাচারের চিহ্ন বুকে নিয়ে পম্পায় শত শহিদ, আমি খুঁজে পাই স্বজাতির রক্ত অগি্নশোধিত প্রতিটি বিন্দু। _পাবলো নেরম্নদা পুঁজিবাদী বুর্জোয়া গণতন্ত্রের শুরম্ন থেকেই মার্কস, লেনিনবাদ ধ্বংসের পাঁয়তারায় লিপ্ত।
কমিউনিজম, মার্কসবাদ সমাজের শ্রেণীবৈষম্য দূর করতে চায়, শোষণ নিষ্পেষণ থেকে মেহনতী মানুষগুলোকে মুক্ত করে তার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তি আনয়ন করতে চায়। পুঁজিবাদী বুর্জোয়া গণতন্ত্রের স্রোতে বিলীন হতে হতেও পৃথিবীর যে কয়টি ভূখ-ে সমাজতন্ত্রের লালঝা-া মিটমিট করে জ্বলছিল তার মধ্যে চিলি একটি। চলতি মাসে নির্বাচনে চিলির রাজনীতে বাম জোটের দীর্ঘ ২০ বছরের মতার অবসান ঘটিয়ে ডানপন্থী প্রার্থী সেবাসত্মিয়ান পিনেরা নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পুঁজিবাদের মুখপাত্র ও মিডিয়া মোগল পিনেরা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বামপন্থী জোটের নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট এদোয়ারদো ফ্রেই থেকে চার শতাংশ ভোট বেশি পান। ৫২ বছরের মধ্যে রণশীল দলের পিনেরাই হতে যাচ্ছেন দেশটিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট। পিনেরা এই বিজয়কে দণি আমেরিকায় ডানপন্থীদের বিজয় বলে অভিহিত করেছেন। অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েও ভেনিজুয়েলা থেকে আর্জেন্টিনা পর্যনত্ম বামপন্থীদের যে আধিপত্য বজায় ছিল, চিলিতে বাম জোটের পরাজয়ের পর দণি আমেরিকার সমাজতন্ত্রের ভাগ্যাকাশ থেকে আরো একটি ধ্রম্নবতারা খসে পড়ল।
দণি আমেরিকার দণি প্রশানত্ম মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশ চিলির রাজনীতিতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র সম্পৃক্ততা কোন নতুন ঘটনা নয়। সত্তরের দশকে সিআইএ-ও ন্যক্কারজনক ভূমিকার কারণে শানত্ম চিলি হয়ে ওঠে অশানত্ম। সে সময় চিলির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক েেত্র যে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার সূচনা হয়, তার জের পোহাতে হয় দীর্ঘ দুই দশক। সত্তর থেকে নব্বইর দশক পর্যনত্ম রাজনৈতিক নির্যাতন, নিষ্পেষণ, হানাহানি, মানবিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা, সামাজিক অরাজকতা ছিল চিলির নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র। চিলির রাজনীতিতে সিআইএর- এমন ন্যক্কারজনক ভূমিকার পেছনে মূল কারণ ছিল চিলি থেকে মার্কসবাদী দর্শনের উৎখাত।
চিলির রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র ভূমিকা বিশেষ করে সত্তরের দশকে দেশটি থেকে কমিউনিস্ট শাসন পতনের জন্য সিআইএ যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তা বিশ্ববাসী হয়ত কোন দিন ভুলবে না। মার্কসবাদী নেতা সালভাদর আলেন্দেকে চিলির কংগ্রেস যাতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা না দিতে পারে সে জন্য ১৯৭০-এর অক্টোবরে চিলির সেনাপ্রধানকে অপহরণের এক ষড়যন্ত্রে মদদ দেয় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। কিন্তু সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। সে ঘটনায় চিলির সেনাপ্রধান রেনে সেস্নইদার গুলিবিদ্ধ হয়ে দু'দিন পর নিহত হন। ঐদিনই চিলির কংগ্রেস আলেন্দেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে। তবু সিআইএ চিলিতে তাদের কূটকৌশল অব্যাহত রাখে। মতা গ্রহণের তিন বছর পর ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রক্তয়ী এক সামরিক অভু্যত্থানে প্রেসিডেন্ট আলেন্দের সরকারকে উৎখ্যাত করা হয়। অভু্যত্থানে আলেন্দে নিহত হন। আলেন্দের মৃতু্যর সাথে সাথে সামরিক জানত্মার বুটের আঘাতে চিলিতে মার্কসবাদী দর্শন মুখ থুবড়ে পড়ে। আলেন্দেকে উৎখাতের জন্য সিআইএ'র মদদে যে অভু্যত্থান ঘটানো হয়, সে সময় হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে নির্মম নির্যাতন ও নিষ্পেষণ করা হয়। ঐ অভু্যত্থানের মধ্য দিয়ে সেনাপ্রধান অগাসত্মো পিনোশে চিলির শাসনভার দখল করেন। দীর্ঘ ১৭ বছর নির্মম নির্যাতন ও নিষ্পেষণের পর ১৯৯০ সালের ১১ মার্চ পিনোশের স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হয় চিলির জনগণ। পিনোশের শাসনামলে চিলির ৩ লাখেরও বেশি লোককে কারারম্নদ্ধ করা হয়, দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় লাধিক লোককে, ৫ হাজারের মতো লোককে খুন বা গুম করা হয় এবং নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতনের শিকার হয় আরও ৫০ হাজার লোক। পিনোশের নির্মম নির্যাতন ও অত্যাচারের বিষয়ে ১৯৭৪ সালে এক যাজক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে পিনোশে যাজককে বলেন : "আপনারা যাজক। মা করার মতো বিলাসিতা আপনাদের আছে। আমি হলাম একজন সৈনিক এবং চিলির প্রেসিডেন্ট যে কিনা কমিউনিজম নামক ব্যাধির আক্রমণের মুখে। এই ব্যাধিকে অবশ্যই নির্মূল করতে হবে। মার্কসবাদী ও কমিউনিস্টদের অবশ্যই নির্যাতন করতে হবে। নইলে তারা পথে আসবে না।" যে মার্কিনীরা বিশ্বব্যাপী মানবতা ও মানবাধিকারের বুলি আউড়ে বেড়ায়, সে মার্কিনীরাই পিনোশের সব অন্যায়-অত্যাচার নীরব দর্শকের মতো প্রত্য করেছিল। কারণ পিনোশেও তাদেরই সৃষ্টি এবং তাদের এ্যাসাইনমেন্টই বাসত্মবায়ন করেছে চিলিতে।
১৯৭০ সালে আলেন্দের প্রেসিডেন্ট হওয়া ঠেকানোর ষড়যন্ত্রে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানানোর অপরাধে জেনারেল রেনে সেস্নইদারকে অপহরণের যে নীলনক্সা অাঁটে সিআইএ, তার জন্য চিলির একটি গ্রম্নপকে ৩৫ হাজার ডলার ঘুষ প্রদান করে সিআইএ। সিআইএ'র প্রতিবেদন অনুযায়ী চিলিতে তাদের মিশন সফল করার জন্য তারা তৎকালীন চিলির গোপন পুলিশ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল মানুয়েল কনট্রেরাস সেপুলভেদার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রা করত। ১৯৭৭ সাল পর্যনত্ম এই যোগাযোগ অুণ্ন ছিল বলে সিআইএ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। সিআইএ'র দলিলপত্র থেকে আরও জানা যায়, আলেন্দে সরকারকে উৎখাতের মাত্র তিন সপ্তাহ আগে মার্কিন কর্মকর্তারা চিলির বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বেসরকারী সংগঠনগুলোকে গোপনে ১০ লাখ ডলার দেয়।
নব্বইয়ের দশকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙ্গে খান খান করার পেছনে মার্কিন সিআইএ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই কাজে সিআইএ তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখায়েল গর্বাচেভকে ব্যবহার করে বলেও শোনা যায়। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরও দণি আমেরিকার কয়েকটি দেশ মার্কসবাদী দর্শন লালন করে চলছে। হুগো শ্যাভেজ, ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মতো অনমনীয় মনোভাবের নেতারা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের কাছে মাথা নত করেনি। তাতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ একের পর এক কৌশল পরিবর্তন করে দেশগুলোর মতায় পরিবর্তন আনতে চায়। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৬৮ সাল থেকে '৭৮ পর্যনত্ম দণি আমেরিকায় কমপ েতিন লাখ বেসামরিক লোককে হত্যা করা হয়। ঐ সময়ে দণি আমেরিকার বলিভিয়া, উরম্নগুয়ে, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় একের পর এক প্রতিবিপস্নবীদের অপতৎপরতা ঘটতে থাকে। আর এসব ঘটনার নেপথ্য কলকাঠি নেড়েছিল মার্কিন গোয়েন্দ সংস্থা সিআইএ ও তার মিত্ররা। চিলির স্বৈরশাসক পিনোশের পতনের পর চিলির রাজনীতিতে আবারও বামদের উৎখাত সম্ভবত খুব ভালভাবে মেনে নিতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চিলির এবারের নির্বাচনে ডানদের আবির্ভাবের পেছনে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র কোন হাত আছে কি না তা সময় বলে দেবে।

No comments

Powered by Blogger.