জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে by ইফতেখার আহমেদ টিপু

জ্বালানি তেলের দাম আরেক দফা বাড়ানো হলো। সরকারের নির্বাহী আদেশবলে ৩ ডিসেম্বর মূল্যবৃদ্ধির এই অপ্রিয় সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়। এর ফলে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম সাত টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। ৬১ টাকা থেকে দাম দাঁড়াল ৬৮ টাকা।
অকটেন ও পেট্রলের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা বেড়েছে। এর ফলে এখন প্রতি লিটার পেট্রল ৯৬ ও অকটেন ৯৯ টাকায় বিক্রি হবে। জ্বালানি তেলের দাম সর্বশেষ বাড়ানো হয় এক বছর আগে, ২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর। সে সময় সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা বাড়ানো হয়। ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে মূল্যবৃদ্ধির ফলে এ সরকারের আমলে চার বছরে পাঁচবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো। নির্বাচনের ঠিক এক বছর আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মানতে। আইএমএফ বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ সুবিধা দেয়। এই ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ১৪ কোটি ১০ লাখ ডলার চলতি মাসে পাওয়ার কথা। আইএমএফ শর্ত দেয়, এ কিস্তি পেতে হলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে হবে। সে চাপের কারণে সরকার কার্যত এ সিদ্ধান্ত নেয়।
গত এক বছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম তেমন বাড়েনি। ডিজেল ও কেরোসিনে সরকার ভর্তুকি দিলেও অকটেন ও পেট্রলের ক্ষেত্রে গত এক বছরে কিছুটা হলেও মুনাফা অর্জন করেছে। তার পরও অকটেন ও পেট্রলের দাম বাড়ানো হয়েছে অযৌক্তিকভাবে। কৃষির সেচকাজে ব্যবহৃত ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বাড়াবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জ্বালানি তেলের পাশাপাশি এবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামও বাড়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ্য। এক. জ্বালানি তেলের মধ্যে ফার্নেস অয়েল ও জেট ফুয়েলের দাম বাড়ানো হয়নি। এগুলোতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয় না। অকটেন ও পেট্রলেও ভর্তুকি দিতে হয় না, তবু দাম বাড়ানো হয়েছে। আবার গত এক বছরে বিশ্ববাজারেও জ্বালানি তেলের দামে সে রকম হেরফের হয়নি। তবু বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে হলো কেন? দুই. জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে শুধু তো জ্বালানি তেলের দামই বাড়ে না- বাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও। যাতায়াত খরচও বেড়ে যায়। কিন্তু জনগণের আয় তো বাড়েনি। তাহলে প্রশ্ন হলো, তারা চলবে কিভাবে? তিন. ডিজেলের দাম বাড়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষক। কারণ বোরো ধানের উৎপাদন ব্যাহত হবে? এই ধান পুরোপুরি সেচনির্ভর? আর সেচের জন্য পাম্প চালাতে ডিজেলের কোনো বিকল্প নেই? বেশি দামে যদি কৃষকদের ডিজেল কিনতে হয়, তাহলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। তাঁরা পড়বেন লোকসানের মুখে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় কৃষকদের অবস্থা হবে খুবই খারাপ। এ অবস্থায় বেশি দামে ডিজেল কেনার সামর্থ্য তাঁদের থাকবে কী? যদি না থাকে, তাহলে তো কৃষির উৎপাদন ব্যাহত হবে, যার প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতির ওপর। সরকার এ পরিস্থিতি সামাল দেবে কিভাবে?
বছরের শুরুতেই আবারও জ্বালানি তেলের এ বাড়তি দামের ফলে জনজীবনে এক অস্বস্তিকর বিরূপ প্রভাব ফেলবে, এ কথা বিশেষজ্ঞরাও বলছেন। দাম বাড়ার পেছনে সরকারের যুক্তি, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে গেছে। ফলে ভর্তুকি সমন্বয় করে বাজেটের ওপর চাপ কমাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। তার পরও সরকারকে প্রতি লিটার ডিজেলে ১১ টাকা ৭৭ পয়সা এবং কেরোসিনে ১২ টাকা ১৫ পয়সা করে ভর্তুকি দিয়ে যেতে হবে বলে সরকারের তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর সরকারের নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কাজেই জ্বালানি তেলে ভর্তুকির পরিমাণ যে হারে বাড়ছে এতে দায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রে তরল জ্বালানি সরবরাহ। যদিও সরকার দোহাই দিচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকারকেও দাম বাড়াতে হচ্ছে। বিস্ময়কর হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম পড়ে যায়, তখনো আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমে না।
২০১০ সালে একজন বিদ্যুৎ গ্রাহক যে দামে বিদ্যুৎ কিনত, এখন কিনছে তার চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি দামে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত বাড়তি মূল্য দিতে হচ্ছে সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে। জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হচ্ছে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের। লক্ষ করার বিষয়, একদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও ভর্তুকির অজুহাতে, অন্যদিকে তেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেলের জোগান দিতে ও ভর্তুকি কমাতে। এই লাগাতার দাম বাড়ানোর পরিণতি দেশের অর্থনীতির জন্য কি হতে পারে সরকারকে তা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি ছিল। জনগণের কষ্ট-দুর্ভোগ লাঘব ও শান্তি-স্বস্তিতে জীবন যাপন নিশ্চিত করাসহ অর্থনীতির ওপর চাপ কমানোর লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নেবে- এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক দৈনিক নবরাজ, চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ
chairman@ifadgroup.com

No comments

Powered by Blogger.