কেমন আছেন চা শ্রমিকরা শেষ ॥ সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ একেবারেই সীমিত- অবকাঠামো নেই, আর্থিক অসচ্ছলতা ॥ পঞ্চম শ্রেণীর পর আগানো দুঃসাধ্য

 দেশের চা বাগান শ্রমিকের সন্তানদের শিক্ষায় দুর্দমনীয় আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অবকাঠামোগত অসুবিধা, আর্থিক অসচ্ছলতা ও চা বাগান মালিকদের অসহযোগিতায় তাদের সবাইকে বিদ্যালয়মুখী করা যাচ্ছে না।
তবে দিন দিন স্কুলে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। পরিবারের খরচ যোগাতে একসময় বাবা-মায়েরা যেখানে তাদের শিশুদের নিয়ে আসতেন চা বাগানে, সেখানে এখন শিশুদের স্কুলে পাঠাতে সচেতন হয়ে উঠছেন তাঁরা। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার পর তাদের আর ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
সরেজমিনে মৌলভীবাজারের চা বাগানে গিয়ে দেখা যায়, এখানকার শিশুরা এখন বাগান পরিষ্কার কিংবা পাতা তোলার কাজে যাচ্ছে না। তারা এখন স্কুলগামী। ফলে স্কুলমুখী শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি কমে আসছে চা বাগানে শিশু শ্রমিকের হার। তবে স্কুলগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মাটির দেয়ালে ঘেরা অন্ধকার স্কুলে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে কিংবা গুটিকয়েক বেঞ্চিতে গাদাগাদি হয়ে বসে শিশুরা শেখার চেষ্টা করছে। একটি মাত্র কক্ষে সারাদিনে বিভিন্ন ক্লাসের শিক্ষার্থীদের পড়াতে হচ্ছে। যেসব স্কুলে টিনের ছাউনি বা কাঠের বেড়া রয়েছে তার অধিকাংশই পড়ে আছে ভাঙা অবস্থায়।
স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যাও খুবই নগণ্য। মৌলভীবাজার জেলাসংলগ্ন প্রেমনগর চা বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক মাত্র দুজন। একই এলাকার ব্র্যাক পরিচালিত একটি স্কুলে গিয়ে দেখা গেল সেখানে একজন মাত্র শিক্ষক সবার ক্লাস নিয়ে থাকেন।
সম্প্রতি ইউনিসেফের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) আয়োজিত ‘শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম (চতুর্থ পর্যায়) প্রকল্পে’র আওতায় এক সরেজমিনে ভ্রমণে এসব চিত্র পরিলক্ষিত হয়। মৌলভীবাজার পৌরসভা সূত্র জানায়, এই চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই সামান্য। তিন থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের মাত্র ৫ শতাংশ প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করে। মাত্র ১০ শতাংশ ছেলেমেয়ে যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু তার পর আর শিশুদের খুব বেশি পড়াশোনার সুযোগ হয় না। চা বাগানের কাজে লেগে পড়তে হয় বাধ্য হয়ে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন এনজিও প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও বয়স্ক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে এই হার বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রেমনগর চা বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে কথা হয় আকাশ ভৌমিকের সঙ্গে। সে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তারা দুই ভাই, এক বোন। বোন ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। তারপর আর পড়াশোনা করেনি। তার বাবা-মা দু’জনই বাগানে কাজ করেন। তার স্কুলে আসতে খুব ভাল লাগে। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানান, এখানে মাত্র দু’জন শিক্ষক ১ম থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় দেড় শ’ শিক্ষার্থীকে পাঠদান করে থাকেন।
ন্যাশনাল টি গার্ডেনে কর্মরত এক নারী শ্রমিক কল্যাণীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার দুই ছেলে। তাদের দু’জনই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। কিন্তু অর্থাভাবে ভাল কোন স্কুলে ভর্তি করতে পারেননি। পড়ালেখা না করে বাগানে কাজ করে তার ছেলেরা এখন রোজগার করছে। তাঁর আর্থিক ক্ষমতার জন্য তিনি অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত বলে জানালেন কল্যাণী।
চা বাগান শ্রমিকরা ক্ষেত্রবিশেষে দিনে ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। এ টাকার মধ্যে তাদের যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে হয়। খাদ্যের সংস্থান করে পড়াশোনার পেছনে টাকা দেয়ার মতো মন-মানসিকতাও তাদের থাকে না। বিনা বেতনে যতটুকু পড়া সম্ভব ততটুকুও গ্রহণ করতে অনিচ্ছা রয়েছে অনেকের। তাদের মতে, স্কুলে না গিয়ে যদি কাজে যায় তবে বেশি অর্থ আর খাবার জুটবে কপালে। তাই, স্কুলে গেলেও সময় বিশেষে তাদের ফিরে আসতে হয় সেই আদিম পেশায়। বংশপরম্পরায় তারা চা বাগানে কাজ করে আসছেন। তাদের আদি পুরুষরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসেছিলেন এ দেশে। অন্য কোন কাজ না শেখায় এ কাজেই তাদের রুটি-রুজির সন্ধান করতে হয়। সেখানে শিক্ষার আলো পৌঁছানো কঠিন বলে স্বীকার করেছেন একাধিক কর্মকর্তা।
জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তার তথ্যানুযায়ী, মৌলভীবাজারের মোট ৯২টি চা বাগানের মধ্যে মাত্র ২০ টিতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দেয়ার অনুমতি পাওয়া গেছে। এসব চা বাগানে স্কুল তৈরির জন্য চা বাগানের মালিকদের অনুমতি নিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে মালিকরা অসহযোগিতা করায় এখনও খুব বেশি কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।
তথ্যমতে, চা বাগানগুলোর মাত্র ৫০ শতাংশ বাগানে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। মালিকের টাকায় চলা এসব স্কুলের পাশে কোন এনজিও প্রতিষ্ঠানের স্কুলকে তারা অনুমতি দেন না। এসব কারণে সব বাগানে শিক্ষা নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
মৌলভীবাজার জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ জসীম উদ্দীন বলেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে জেলার ৬টি বাগানে তাদের ১৫৯টি শিশু শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তাদের কেন্দ্র থেকে ১৪ হাজার ৯শ’ ৩০ জন শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ বছর থেকে আরও ৫০টি কেন্দ্র চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে শিক্ষার হার আরও বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.