ঝিনাইদহের গ্রামে চার জনকে কুপিয়েছে সন্ত্রাসীরা- ঢাকায় চিকিসাধীন সাগরের বাবা-মা আতঙ্কে ॥ অনেকেই ভয়ে গ্রামছাড়া

আত্মস্বীকৃত সন্ত্রাসীরাই এক আইনজীবী, কৃষকের ছেলেসহ গ্রামের নিরীহ চারজনকে নির্মমভাবে কুপিয়েছে। এক মাস ধরে আহতরা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।
সোমবার রাজধানীর জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) ছেলে আকরাম হোসেন সাগরের (৩৫) শয্যা পাশে দাঁড়িয়ে আতঙ্কে-কান্নায় এ কথাগুলো বলছিলেন কৃষক আতিয়ার রহমান ও তাঁর স্ত্রী কোহিনুর বেগম। কৃষক আতিয়ার জানান, সন্ত্রাসী রবির নেতৃত্বে সদর উদ্দিনের বাহিনীর ভয়ে গ্রামের প্রায় ৪০ পরিবারের বৃদ্ধ নারী পুরুষ ও তরুণী আতঙ্কে গ্রাম ছাড়া। ওদের সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি আরও জানান, ১৯৯৬ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কাছে এসব সন্ত্রাসী অস্ত্র জমা দিয়েছিল। এসব সন্ত্রাসীই এখন আবার পুলিশের নাকের ডগায় রামদা আর চায়নিজ কুড়াল হাতে গ্রামে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। এরাই ঘটনার দিন গত ১৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে বাড়িতে ঢুকে একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান আকরাম হোসেন সাগর, ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নলভাঙ্গা গ্রামের আইনজীবী সহকারী ওমর আলী (৪০), তাঁর ভাই শরিফুল ইসলাম (৪৫) ও আমজাদকে (৪৬) এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে। তাঁদের মৃত ভেবে ফেলে যায়। পরে তাঁদের গুরুতর আহত অবস্থায় ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় আহত সাগর বলেন, সদর বাহিনীর ক্যাডাররা গ্রামের সরকারী অফিস আদালত ও বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী কর্মকা- করছে দিনের পর দিন। তিনি জানান, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিমের হাতে এরা আগ্নেয়াস্ত্র জমা দিলেও তাদের কর্মকাণ্ড এখনও বন্ধ হয়নি। উল্টো এরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গ্রামের মানুষ এদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের হাত থেকে বাঁচতে চায়। এ ব্যাপারে সদর উদ্দিনের বাহিনীপ্রধান সদর উদ্দিনের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
জানা গেছে, ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নলভাঙ্গা গ্রামের সাধারণ কৃষক আতিয়ার রহমান। তাঁর একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান আকরাম হোসেন সাগর (৩৫)। নিজের সামান্য জমিতে কৃষিকাজ করেই তাঁদের সংসার চলে কোন রকমে। আতিয়ার রহমান জানান, গরিবের সংসারে তাদের সুখ ছিল। ছোট ছেলে সাজেদুর রহমান সাজু চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। সবার স্বপ্ন সাজেদ ডাক্তার হয়ে গ্রামের দরিদ্রের চিকিৎসা করবে। ছোট ছেলের পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য বড় ছেলে সাগর নিজেদের সামান্য জমি ও অন্যের চাষের জমি বর্গা চাষ করত। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। আত্মস্বীকৃত সন্ত্রাসীরা ছেলে আকরাম হোসেন সাগরকে চাপাতি, রামদা দিয়ে কুপিয়েছে। ছেলে সাগর পঙ্গত্ব জীবন যাপন করছে। কে চালাবে তাদের সংসার। ছোট ছেলে সাজেদুরের ডাক্তারি পড়া এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তিনি আরও বলেন, শুধু সাগর নয়, সন্ত্রাসীরা একে একে কোপায় শরিফুল, ওমর আলী ও আমজাদকে। গত ১৩ ডিসেম্বের শুক্রবার সকাল ৮টায় আত্মস্বীকৃত সন্ত্রাসী সদর বাহিনীর সদস্যরা হামলা চালায় নলভাঙ্গা গ্রামের আইনজীবী সহকারী ওমর আলীর ওপর। সন্ত্রাসীরা বেধড়ক মারধর করে তাঁকে। এ ব্যাপারে ঢাকা ডেন্টাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওমর আলী জানান, তাঁর দায়ের করা চাঁদাবাজি ও মারধরের মামলা মীমাংসার জন্য চাপ দেয় সন্ত্রাসী রবির নেতৃত্বে সদরউদ্দিন। এতে তাঁরা মামলা তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানান। আর এই কারণে তিনিসহ আতিয়ার রহমানের পরিবারের ওপর হামলা চালিয়েছে সদরউদ্দিন বাহিনী। ওমর আলী আরও জানান, তিনি আহত অবস্থায় পালিয়ে গেলেও তারা আমার বড় ভাই শরিফুল ইসলামকে বাড়ি থেকে ধরে এনে রামদা দিয়ে কোপাতে থাকে। তাঁর ডান চোয়াল কেটে দাঁতের পাটি আলগা হয়ে যায়। রামদা দিয়ে তাঁর বাঁ পায়েও আঘাত করে সন্ত্রাসীরা। তিনি জানান, এ ঘটনার প্রতিবাদ জানায় নিরীহ আকরাম হোসেন সাগর ও আমজেদ আলী। এতে সন্ত্রাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে সাগর ও আমজাদ আলীকে নির্মমভাবে কোপাতে থাকে। পালিয়ে ওরা বাঁচতে পারেনি। পালানোর সময় সন্ত্রাসীরা রামদা দিয়ে কুপিয়ে আহত করে সাগর ও আমজাদকে। প্রথমে তাঁদের ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে আমজাদকে যশোর আড়াই শ’ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গুরুতর আহত শরিফুল ইসলামকে মিরপুরের ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডের ১০ নম্বর বেডে ভর্তি করা হয়। ওমর আলী আরও জানান, ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে একটু সুস্থ হওয়ার পর এখন বড় ভাই শরিফুলের দেখাশোনা করছেন মিরপুর ডেন্টাল হাসপাতালে। হাসপাতালের বেডে কষ্ট ও যন্ত্রণায় কাতর শরিফুল জানান, ছোটভাইকে প্রাণে মারতে না পেরে তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে এনে সন্ত্রাসী সদরউদ্দিন ও তার বাহিনীরা তাঁকে রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে। তাঁর পাশে বসা ঝিনাইদহ জেলা জজ আদালতের আইনজীবী সহকারী আহত ওমর আলী আরও জানান, গ্রামের এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয় তার অধিকাংশ মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী সহকারী হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এ কারণেই তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী ঘটনা ও চাঁদাবাজির মামলা হলে তাঁকে দায়ী করা হয়। তিনি আরও জানান, এসব সন্ত্রাসী ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ তাঁকে মারধর করে। ওই ঘটনায়ও মামলা হয়। এরপর থেকে সন্ত্রাসীরা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মামলা তুলে নেয়ার জন্য তাঁকে প্রায়ই হুমকি দিত। মামলা না তোলায় ওরা ঘটনার আগের দিন গ্রামের হারুন ও কবিরসহ গ্রামের নিরীহ কয়েকজনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে। এ নিয়ে এই ঘটনার পরদিন ১৩ ডিসেম্বর শুক্রবার সকালে গ্রামবাসীরা সালিশ বৈঠক বসায়। ওই বৈঠকে সন্ত্রাসী রবিরের নেতৃত্বে সদর উদ্দিনের বাহিনী তাঁর ওপর আক্রমণ চালায়। সদর উদ্দিন নিজেও অংশ নেয় ওই সন্ত্রাসী হামলায়। আহতদের পরিবারের দাবি, ওদের হাত থেকে আমরা ও গ্রামবাসীরা বাঁচতে চাই। এ ব্যাপারে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

No comments

Powered by Blogger.