নূরজাহান মুরশিদ :সৎ ও সুস্থ রাজনীতির অনন্য প্রবক্তা by কামাল হোসেন

ষাটের দশকে বেগম নূরজাহান মুরশিদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে, যা আমি এখনও একটা স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে মনে করি। ওই সময় আমরা সামরিক শাসনের যন্ত্রণা ভোগ করছিলাম। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের আওতায় একটি তথাকথিত সংবিধান প্রদান করে সামরিক শাসনকে আড়ালের সূক্ষ্ম আবরণ সৃষ্টি করা হলেও বস্তুতপক্ষে সামরিক শাসনই বহাল থাকে।


১৯৫৪ সালের নির্বাচনে সাম্প্র্রদায়িকতা-নির্ভর রাজনীতিবিদরা চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যাত হলেও সামরিক শাসনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে তারাই আবার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সূচনা হয় এবং ১৯৬৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গণরোষের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষক হিসেবে ওই সময়ে আমি ডক্টর খান সারওয়ার মুরশিদ ও বেগম নূরজাহান মুরশিদের নিবিড় সানি্নধ্যে আসার সুযোগ লাভ করি। ড. খান সারওয়ার মুরশিদ ও নূরজাহান মুরশিদের সাহচর্যে বেশ কিছু শিক্ষক ছিলেন, যারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতবিনিময় করতেন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে বিবৃতি প্রদান করতেন।
নূরজাহান মুরশিদ ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি গণপ্রতিনিধি হিসেবে নারী-অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সামরিক শাসনের প্রতি তার সুতীব্র ঘৃণা এবং গণতন্ত্রের প্রতি সুদৃঢ় অঙ্গীকার আমাদের মতো সমমনাদের জন্য শক্তির উৎস হিসেবে প্রেরণা জোগাত।
ষাটের দশকের শুরু থেকে শেষ অবধি আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে এবং গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খান, তার সামরিক শাসন ও তার পদলেহীরা জনজোয়ারে ভেসে যায়। মুরশিদ সাহেবের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসস্থল গণতন্ত্রকামী সমমনা শিক্ষক ও বন্ধুদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়।
বেগম মুরশিদ ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ নেত্রী। তিনি আওয়ামী লীগ আয়োজিত প্রতিটি মিছিল ও সমাবেশে কার্যকর অংশগ্রহণ করতেন। স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তার ধানমণ্ডির বাসভবনে আমরা প্রায়ই মিলিত হতাম এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ওখানে বসেই গৃহীত হতো। জাতীয় সংবিধান রচনার জন্য গঠিত গণপরিষদেও তিনি সদস্য ছিলেন।
পরে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে বিশাল পরিবর্তন ঘটে। আমরা উভয়ে এবং সমমনা অন্যদের সহযোগিতায় আমরা যে রাজনীতিতে বিশ্বাস করি সেই রাজনীতি পুনরুদ্ধার এবং একটি অসাম্প্র্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় নারী-পুরুষের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও সাম্প্র্রদায়িকতামুক্ত একটি সুষ্ঠু রাজনীতি তথা মূলধারার রাজনীতি প্রবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে কাজ শুরু করি। প্রতিষ্ঠিত হয় গণফোরাম।
গণফোরাম প্রতিষ্ঠার মাত্র দুই বছর আগে একটি সুদীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের ধারায় স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে এবং সংসদীয় পদ্ধতির গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার সূচনা হয়। একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক সরকার ও জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ইস্পাতদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে জনগণ স্বৈরাচারী সরকারের পতন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। স্বৈরশাসনের পতন হলেও স্বৈর সরকারের রেখে যাওয়া অস্ত্রধারী ক্যাডার বাহিনী ও কালো টাকার মালিকদের দৌরাত্ম্যে গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখীন হয়। সুবিধাবাদীদের ক্ষমতা ও অর্থের অন্তহীন লালসা স্বৈরশাসনের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। এসবের ফলে নীতি ও আদর্শনির্ভর রাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে।
আশির দশকে আমরা ভোটারবিহীন নির্বাচন দেখেছি। নব্বয়ের দশকে আমরা আদর্শহীন রাজনীতির নগ্ন উত্থান ও উল্লাস দেখেছি। ক্ষুদ্র ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে তথাকথিত দলীয় স্বার্থের কাছে জাতীয় ও জনস্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের বিরূপ পরিস্থিতিতে আমরা দেশবাসীকে সমাজ ও সভ্যতা বাঁচাতে সুস্থ রাজনীতির পুনর্জাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাই। এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা সীমিত শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে ধারাবাহিক কর্মকাণ্ড শুরু করি। এটি ছিল একটি কঠিন কাজ।
এ ধরনের কাজ এখনও সহজ নয়। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের পর দীর্ঘ ২২ বছর হতে চলল। 'স্বৈরাচার নিপাত যাক-গণতন্ত্র মুক্তি পাক'_ এ স্লোগান বুকে-পিঠে লিখে মিছিলের অগ্রভাগে থেকে টগবগে যুবক নূর হোসেন জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতন হলো, নিপাত গেল; কিন্তু এখনও গণতন্ত্র কাঙ্ক্ষিত মুক্তি পায়নি। বিকশিত হয়নি। জনগণ এখনও গণতন্ত্রের সুফল লাভে বঞ্চিত। সুশাসন, সৎশাসন, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকারগুলো ভোগ করার অধিকার, বৈষম্যের বিলোপ সাধন এবং প্রত্যেক নাগরিকের আত্মবিকাশের সমসুযোগ_ এসবের কোনোটি আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণ বিদ্যমান রুগ্ণ রাজনীতির বিপরীতে সুস্থ রাজনীতি চায়। জনগণের আকাঙ্ক্ষার কথা ভেবেই আমাদের পথের সব বাধা সরাতে হবে।
যেহেতু আমরা একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছি, সেহেতু আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে একটি আঙ্গিক পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের দরকার জাতীয় ঐকমত্যের রাজনীতি। সংঘাত ও সংঘর্ষের রাজনীতির পরিসমাপ্তি। জাতীয় কৌশল অবলম্বনের মধ্য দিয়ে আমাদের মানবসম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগাতে হবে; যে কৌশলের মাধ্যমে তুচ্ছ ব্যক্তিগত, গোত্র বা দলের স্বার্থ আমাদের ক্রমবর্ধমান বিশাল জনগোষ্ঠীর উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।
আমাদের দরকার তুচ্ছ দল বা শ্রেণীবৈষম্যের ঊধর্ে্ব একটি সত্যিকারের জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি, যা জাতীয় নিরাপত্তা এবং জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে নীতিমালা গ্রহণ করবে। শুধু এই দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমেই আমরা রাজনীতি, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতে পারি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
আমাদের সম্পদকে কাজে লাগানোর অনুকূল অবস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে আমাদের জাতীয় কৌশল ও নীতিমালার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং অংশীদারদের বৈধ স্বার্থের প্রতি পারস্পরিক সম্মানবোধ বৃদ্ধি করতে হবে। হীন দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমরা আমাদের অনেক সময় ও সুযোগ হারিয়েছি। আমাদের অবশ্যই হীন ও পশ্চাৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, যা অত্যন্ত দরকারি জাতীয় ও আঞ্চলিক উন্নয়নকে ব্যাহত করছে, তা বর্জন করতে হবে।
বাস্তবমুখী সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা আমাদের পানি ও জ্বালানি সম্পদের জন্য সর্বোত্তম অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করতে পারি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমুদ্র-উপকূলে একটি আন্তর্জাতিক গভীর সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি। ১০টি দেশকে সেবা প্রদানকারী রটারডাম যেমন ইউরোপোর্ট হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে, ঠিক তেমনি আমরা আমাদের উপকূলরেখায় একটি সার্ক সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
দ্রুত পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে যে সমাজ আমাদের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে এবং কার্যকর প্রগতিশীল আঞ্চলিক সহযোগিতায় অবদান রাখতে পারে এবং আমরা সক্রিয় ও সৃজনশীল অবদান রাখার সুযোগ যাতে পাই, সে লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।
নির্যাতন ও সংঘাতমুক্ত একটি বিশ্বের জন্য, শান্তি ও ন্যায়ের জন্য, গণতান্ত্রিক সহনশীলতা ও মানবাধিকারের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র হিসেবে এই অঞ্চলে এবং সারাবিশ্বে আমাদের সম্মান অর্জনের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
বেগম নূরজাহান মুরশিদ ছিলেন একজন প্রাণবন্ত ও নিবেদিতপ্রাণ নেত্রী। তিনি কখনও হতাশ হতেন না। দারুণ উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করার একটি সহজাত অভ্যাস তার ছিল। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইতিবাচক ধারায় সবার উচিত নূরজাহান মুরশিদের সেই উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করা। হতাশ না হওয়া।

স ড. কামাল হোসেন :সভাপতি, গণফোরাম; নিবন্ধটি নূরজাহান মুরশিদ স্মৃতি পরিষদ থেকে প্রেরিত
 

No comments

Powered by Blogger.