আইএসআই জড়িত! ॥ শাহজালাল দিয়ে ভারতীয় মুদ্রা পাচার- ০পাকি জঙ্গীদের অর্থায়ন ও ভারতের অর্থনীতি পঙ্গু করাই লক্ষ্য- ০ ধৃত পাচারকারীরা বাহক- ০ যশোর সাতক্ষীরা ও কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে মূলত পাচার হয় by আজাদ সুলায়মান

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে কোটি কোটি ভারতীয় মুদ্রা পাচারে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই জড়িত। সংস্থাটি এজন্য বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এসব মুদ্রা ছাপানোর পর আকাশ পথে বাংলাদেশে এনে ভারতে পাচার করা হচ্ছে।


প্রতিমাসেই প্রায় বিপুল পরিমাণ ভারতীয় মুদ্রা পাকিস্তান থেকে পাঠানো হচ্ছে। ভারতে ঘাপটি মেরে থাকা পকিস্তানী জঙ্গীদের অর্থায়ন এবং সে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করাই এসব মুদ্রা পাচারের মূল কারণ। একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে এসব তথ্য মিলেছে।
এছাড়া র‌্যাবের তদন্তেও উঠে এসেছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। আকাশ পথে পাকিস্তান থেকে এনে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত পথে মুদ্রাগুলো ভারতে পাচার সহজ বলে মনে করেন র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের কমান্ডার এম সোহায়েল। তিনি বলেন, বার বার পাকিস্তান থেকে ভারতীয় মৃুদ্রা বাংলাদেশ দিয়ে পাচার করার কারণ নিরাপদ ট্রানজিট। পাচারকারী সম্ভবত বাংলাদেশকে নিরাপদ বলেই মনে করে।
জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রায় প্রতিমাসেই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় মুদ্রার চালান আসছে। তবে ধরা পড়ছে খুব কম। গত পাঁচ মাসে বিমানবন্দর দিয়ে আনা এসব জাল মুদ্রার পাঁচটি চালান ধরা পড়ে। বাংলাদেশী মৃুদ্রায় যার মূল্য সাড়ে তিন কোটি টাকা। গ্রেফতার করা হয়েছে ১৪ জনকে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিক ৭ জন। বাকিরা পাকিস্তানের। তারা সবাই এখন জেলহাজতে।
র‌্যাব কমান্ডার এম সোহায়েল জানান, পাকিস্তান থেকেই সব ক’টা চালান এসেছে। যদিও বেশ কিছু ভারতীয় রুপী জাল বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবে এগুলো আসল মুদ্রার মতোই নিখুঁত ও মসৃণ। পাাকিস্তানের টাকশাল থেকে ছাপা রুপী আর ভারতীয় রুপীর মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই।
গত মার্চেই পর পর তিনটে বড় মুদ্রার চালান ধরা পড়ায় র‌্যাবসহ অন্যান্য গোয়েন্দা স্স্থংা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এ তিনটে চোরাচালান ঘটে মার্চের ১৪, ১৮ ও ২৯ তারিখে।
এর মধ্যে প্রথম মুদ্রার চালানটি আসে ১৪ মার্চ। র‌্যাব-১ বিশেষ অভিযান চালিয়ে শাহজালালের ড্রাইভওয়ে এলাকায় গ্রেফতার করে মুদ্রা চালানের নেতা মামুন আল আজাদ@সুমন (৩৫), মোশাররফ হোসেন (৩০) ও জুয়েল হোসেনকে। তাদের লাগেজ থেকে উদ্বার করা হয় ডলার, পাউন্ড ও অন্যান্য মুদ্রা, যা বাংলাদেশী ১৭ কোটি টাকারও বেশি।
এর মাত্র চার দিনের মাথায় র‌্যাব-১ আবার উত্তরার হোটেল নগরভ্যালিতে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৬০ লাখ ভারতীয় রুপী উদ্ধার করে। গ্রেফতার করা হয় করাচীর বাসিন্দা মইনউদ্দিনকে। তার সহযোগী শফিকুর রহমান আরিফকেও গ্রেফতার করা হয়।
এ ঘটনার দশ দিনের মাথায় র‌্যাব-১ নগরীর পলওয়েল মার্কেটের সামনে একটি কাপড়ের ট্রাকে অভিযান চালিয়ে দশ কোটি ভারতীয় মুদ্রা উদ্ধার করে। ৪টি কাপড়ের কাভার্ড ভ্যানের ভেতর থেকে এসব মুদ্রা উদ্ধার হয়। এ সময় গ্রেফতার করা হয় মুরাদ হোসেন, আব্দল্লাহ আল মামুন ও ইমরান হোসেনকে। ইমরান হোসেন ও মুরাদ হোসেন দীর্ঘদিন ধরে চোরাচালানে জড়িত। গত রমজান মাসেও পাকিস্তান থেকে আগত এক নাগরিককে ভারতীয় মুদ্রাসহ আটক করা হয় শাহজালাল বিমানবন্দরে। তার নাম আফজাল মাহমুদ। উদ্ধারকৃত মুদ্রার পরিমাণ ৬১ লাখ। দুবাই থেকে আগত ইতিহাদ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে পাকিস্তানী নাগরিক আফজাল মাহমুদ কাস্টমস হলে অবতরণ করেন। তিনি একটি লাগেজ নিয়ে দ্রুত চলে যান স্ক্যানিং মেশিনের কাছে। স্ক্যানিংয়ে ধরা পড়ে এসব মুদ্রা। পরে কর্তব্যরত কাস্টমস কর্মকর্তা তার ব্যাগেজ খুলে দেখতে পান চকোলেটের প্যাকেটে মোড়ানো এসব মুদ্রা। এ সময় মুদ্রাগুলো ব্যাংকে নিয়ে দেখা যায় এগুলো ভারতীয় মুদ্রা। পুলিশ জানায়, আফজাল মাহমুদ পাকিস্তানী নাগরিক হলেও তিনি নিয়মিত ঢাকায় বসবাস করেন। এর আগেও তিনি একাধিকবার মুদ্রা পাচার করেছেন। আটকের পর আফজাল জানান, তিনি দুবাই থেকে এসব মুদ্রা এনেছেন। কোন এক ব্যক্তি তার কাছে এগুলো দিয়েছে শুধু ঢাকায় পৌঁছে দেবার জন্য। পুলিশ বলছে, আফজাল পেশাদার মুদ্রা পাচারকারী।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ভোরে হাশিম নামের আরও এক পাকিস্তানী প্রায় ৫৯ লাখ ভারতীয় রুপীসহ ধরা পড়েন হযরত শাহজালাল বিমান বন্দরে। তিনিও ইতিহাদ এয়ারলাইন্সেই আফজাল মাহমুদের মতোই একই কায়দায় একই সময়ে আসেন। নিজেকে শুধু মুদ্রার বহনকারী হিসেবে দাবি করেন তিনি। ঢাকায় নামার পর পরই তার কাছ থেকে একজন বাংলাদেশী নাগরিক মুদ্রাগুলো সংগ্রহ করার কথা ছিল। সেই ব্যক্তিকে তিনি চেনেন না। তবে তার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত মুৃদ্রাগুলো নকল না আসল তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
র‌্যাব সূত্র জানায়, ঢাকায় বার বার ভারতীয় মুদ্রা ধরা পড়ার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। কমান্ডার এম সোহায়েল বলেন, এখন পর্যন্ত যাদেরকে ধরা হয়েছে তারা সবাই ক্যারিয়ার। মূল নায়কদের এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এমন কি ক্যারিয়াররাও জানেনা এর নেপথ্য নায়ক কারা। তারা শুধু মুদ্রার হাত বদল করে। প্রথম হাত দ্বিতীয় হাতে পৌঁছে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। প্রথম হাত কখনই জানেনা দ্বিতীয় হাত থেকে কার কাছে মুদ্রা যাবে। আবার দ্বিতীয় হাতের কাজ শুধু তৃতীয় হাতে পৌঁছে দেয়া। তিনি কখনোই চতুর্থ হাত সম্পর্কে জানতে পারেন না। এভাবেই বার বার হাত বদল হয়ে মুদ্রা পাচার করা হয় প্রকৃত গন্তব্যে। যে কারণে এখন পর্যন্ত গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মুদ্রা পাচারকারীদের গডফাদার সম্পর্কে তেমন তথ্য মিলছে না। তবে বার বার পাচারের ঘটনায় এটা নিশ্চিত বাংলাদেশকে নিরাপদ ট্রানজিট হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। আকাশ পথে পাকিস্তান থেকে মুদ্রা আনার পর বাংলাদেশের স্থলপথের সীমান্ত দিয়ে সেগুলো ভারতে পাচার অনেকটাই সহজ বলে মনে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যশোর, সাতক্ষীরা ও কুমিল্লার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে তা ভারতে পাচার করা হয়। যেটা হয়ত পাকিস্তান থেকে সীমান্ত পথে ভারতে পাচার করা খুবই কঠিন।
একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পাকিস্তানে বার বার ভারতীয় মুদ্রা পাচারের দুটো বিষয়ে দুটো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। একটা হচ্ছে জঙ্গীদের অর্থায়ন। অপরটি ভারতের অর্থনীতিতে বিপত্তি ঘটানো। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় মদদ ছাড়া এত বড় চালান ছাড় করা সম্ভব নয়। করাচী বিমানবন্দরের কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে এত বড় চালান ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। এতে সেখানকার গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও নিরাপত্তাকর্মীদের মদদ থাকার যথেষ্ট আলামত মিলেছে। এ ছাড়া নকল টাকাগুলোও এমনভাবে তৈরি করা যা স্ক্যানার মেশিন ছাড়া শনাক্ত করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রেও সরকারের ইন্ধন থাকতে পারে।
কেন নেপথ্য নায়কদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না জানতে চাইলে র‌্যাব কমান্ডার এম সোহায়েল বলেন, মুদ্রা পাচারের রুট ত্রিদেশীয়। পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত। তিন দেশের ভূমি ব্যবহৃত হচ্ছে। এর তদন্তও করতে হবে তিন দেশেই। শুধু ঢাকায় বসে এক পেশে তদন্তে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাবে না। যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা বার বার একই কথা বলছে, প্রকৃত গডফাদারদের তারা চেনে না। এ অবস্থায় করাচী বিমানবন্দরে গিয়ে সেদিনকার কর্তব্যরত নিরাপত্তাকমীদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানা যেত কিভাবে কারা পাচারে সাহায্য করেছিল। একই ভাবে ভারতে কারা এসব মুদ্রার গ্রাহক সেটাও জানার প্রয়োজন। এ দুটো দেশে সরেজমিন তদন্ত ছাড়া প্রকৃত রহস্য উদঘাটন সম্ভব নয়।

No comments

Powered by Blogger.