বিশ্ব বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে ॥ ফান্ড ম্যানেজারদের কারসাজি- ০ যুক্তরাষ্ট্রে খরার অজুহাত দেয়া হচ্ছে- ০ আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে খাদ্য ঘাটতির- ০ তবে ভিয়েতনাম থাইল্যান্ড ও ভারতে চালের বাম্পার ফলন- ০ বাংলাদেশে চালের মজুদ পর্যাপ্ত by কাওসার রহমান

ফান্ড ম্যানেজারদের কারসাজিতেই আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র খরাকে কাজে লাগিয়ে ফান্ড ম্যানেজাররা কৌশলে আগামী বছরের খাদ্য ঘাটতির আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। আর এ আতঙ্কের কারণে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে চাল, ভোজ্যতেল, গম ও যবের দাম।


এ অবস্থায় বিপুল পরিমাণ চালের মজুদ ও বাম্পার ফলন নিয়ে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। তবে আমদানিনির্ভরতার কারণে গম ও ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
যুক্তরাষ্ট্র কৃষি বিভাগের খবরে জানা যায়, বিশ্বে ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র খরার কবলে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে গম, যব ও সয়াবিন উৎপাদন বিপর্যয়ের মুখে। গমের অপর উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেনেও চলছে খরা। বন্যায় ব্রাজিলের চিনি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। শুধু গম, যব, চিনি ও ভোজ্যতেলের বাজারই নয়, এর প্রভাবে চালের বাজারও উর্ধমুখী।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং এ্যান্ড মনিটরিং ইউনিটের আগস্ট মাসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের গমের দাম ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি টন ২৪৪ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তবে রাশিয়ার গমের দাম এক দশমিক ছয় শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৩১০ ডলারে নেমে এসেছে। অবশ্য ইউক্রেনের গমের দাম ৩১০ ডলারে স্থিতিশীল আছে। ঢাকার পাইকারি বাজারেও গমের দাম প্রতিটন ৩১০ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
গমের মূল্যের এই প্রভাব আন্তর্জাতিক চালের বাজারেও পড়েছে। থাইল্যান্ডে চালের দাম চার দশমিক চার শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রতিটন ৫৯০ ডলারে উঠেছে এবং ভিয়েতনামে চালের দাম এক দশমিক দুই শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪২০ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানে চালের দাম প্রতিটন ৪৭০ ডলারে অপরিবর্তিত থাকলেও, কলকাতার পাইকারি বাজারে চালের দাম সামান্য বেড়ে ৩০৯ ডলারে অবস্থান করছে। ঢাকায় অবশ্য প্রতিটন চাল ২৯৪ ডলারে বিক্রি হচ্ছে।
বাজার ভেদে চাল ও গমের দাম ওঠানামা করলেও খরার আতঙ্কে ভোজ্যতেলের দাম টনপ্রতি ১০০ ডলার বেড়ে গেছে। যদিও এই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির কোন কারণ নেই।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) তাদের আগস্ট মাসের প্রতিবেদনে বলেছে, গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত টানা চার মাস সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম কমেছিল। তবে গত জুলাই থেকে খাদ্যপণ্যের দাম ছয় শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
খাদ্য বিশেষজ্ঞরা আশা করেছিলেন জুনের প্রথম দিকেই যুক্তরাষ্ট্রে যব ও সয়াবিনের ফসল কাটা শুরু হবে। ফলে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম আরও কমে আসবে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অর্ধ শতাব্দীর ভয়াবহ খরায় সব হিসাব পাল্টে দিয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫টি অঙ্গরাজ্যে খরা ছড়িয়ে পড়েছে। পুরো দেশের অর্ধেক এলাকা খরায় আক্রান্ত। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে কমতে থাকা খাদ্য পণ্যের দাম মধ্য জুনের পর থেকে আবার উর্ধমুখী হয়েছে। সর্বশেষ মধ্য জুন থেকে এ পর্যন্ত ফিউচার মার্কেটে গমের দাম প্রায় ৪১ শতাংশ, যবের দাম ৬০ শতাংশ এবং সয়াবিনের দাম ৩১ শতাংশ বেড়েছে। এর অর্থ ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে খাদ্যপণ্য ক্রয়ে বেশি দাম দিতে হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতি চার শতাংশ বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা করছে যুক্তরাষ্ট্রের খরার কারণে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের যে মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে তা দীর্ঘস্থায়ী হবে। এই মূল্যবৃদ্ধির রেশ ২০১৫ সাল পর্যন্ত গড়াতে পারে। বিশ্বব্যাংক বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে খরার বিপরীতে ইউরোপীয় অনেক দেশে অতি বৃষ্টির কারণে গমের আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। আবার রাশিয়া, ইউক্রেন ও কাজাখস্তানে কম বৃষ্টিপাতের কারণে গমের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার ভারতেও ভরা ফসল আবাদ মৌসুমে গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে ২০ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে।
আবাহওয়া বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এ বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার থেকে ব্যাংককে শুরু হওয়া জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনা হবে। এ অবস্থায় ভবিষ্যত করণীয় সম্পর্কেও আলোকপাত করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি রাশিয়াতেও খরায় গমের উৎপাদন প্রায় ২৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ বছর রাশিয়ায় গমের উৎপাদন ছয় কোটি ১০ লাখ টন থেকে চার কোটি ১৫ লাখ টনে নেমে এসেছে। ফলে বিশেষজ্ঞরা গম রফতানির ওপর রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করছেন।
গত এক মাস ধরে এ খবর আন্তর্জাতিক মাধ্যমে প্রচারের কারণেই খাদ্যপণ্যের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। গত জুনে যেখানে সয়াবিন তেলের দাম ১১শ’ ৭৫ ডলার ছিল, আগস্টে এসে তা ১২শ’ ৭৫ ডলারে উঠে গেছে। একইভাবে ঈদের আগে যেখানে পাম তেলের দাম প্রতিটন ৯৫০ ডলার ছিল, তা ঈদের পর বেড়ে এক হাজার ৫০ ডলারে উঠে গেছে।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষক অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ মাহবুব আলী বলেন, মূলত আমেরিকার খরার কারণে আন্তর্জাতিক খাদ্যপণ্যের বাজারে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। ওই আতঙ্কের কারণেই সব খাদ্য পণ্যের দাম বাড়ছে। খরার খবরের কারণে গম ও ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে পারে। কিন্তু চালের দাম কেন বাড়বে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র তো আর চাল উৎপাদন করে না। আর চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোতে চালের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে চালের দাম বাড়ার কোন কারণ নেই। এটা যে আতঙ্ক সৃষ্টির কারণে বাড়ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই এই মূল্য বৃদ্ধির প্রতি সরকারকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ‘এটা আন্তর্জাতিক ফান্ড ম্যানেজারদের কারসাজি হতে পারে। কারণ তারাই এখন কৃষিপণ্যের ‘পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট’ করছে। তারাই ছাড়াচ্ছে ২০১৩ সালে বিশ্বে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের খরাকে কাজে লাগিয়ে তারা মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে কৌশলে মুনাফা করে নিতে চায়।’
জানা যায়, ২০০৭-০৮ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক ফান্ড ম্যানেজাররা খাদ্যপণ্যে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ শুরু করে। সেই থেকে তারা বর্তমান বিশ্বের খাদ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ওই সময় তারা এই বিনিয়োগ থেকে বিপুল মুনাফা করলেও পরবর্তীতে বিশ্বে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমে যায়। বিশেষ করে ২০১১ সালের শেষ দিকে এসে খাদ্যপণ্যের দাম দ্রুত কমতে থাকে। ফলে এই ফান্ড ম্যানেজাররা বিপুল লোকসানের মুখে পড়ে। ফলে তারা সুযোগ খুঁজছিল ওই লোকসান কাটিয়ে বিনিয়োগ নিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের খরা তাদের সেই সুযোগই করে দিয়েছে।
বর্তমানে এই ফান্ড ম্যানেজারদের হাতে প্রচুর পরিমাণ ভোজ্য তেলের মজুদ রয়েছে। দাম কমে যাওয়ায় এই তেল তারা বিক্রি করতে পারছিল না। ফলে তারা লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছিল। এখন খরাকে পুঁজি করে খাদ্য সঙ্কটের আতঙ্ক সৃষ্টি করে কৌশলে দাম বাড়িয়ে সেই মজুদ বিক্রি করছে।
ওই আতঙ্কের কারণে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেশি বাড়ছে। কারণ বলা হয়েছে, খরার কারণে যুক্তরাষ্ট্রেই দেড় কোটি টন সয়াবিন তেল কম উৎপাদন হবে। এতে গত এক মাসে সয়াবিন তেলের দাম ১০০ ডলার করে বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে পাম তেলের দামও। ইতোমধ্যে এ তেলের দামও টনপ্রতি ১০০ ডলার বেড়ে গেছে। যদিও এখন পাম তেলের পূর্ণ মৌসুম চলছে এবং এ সময়ে এ তেলের দাম বৃদ্ধির কোন যৌক্তিক কারণ নেই।
কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়া যতটা অতঙ্ক ছাড়াচ্ছে পরিস্থিতি ততটা ভয়াবহ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের সর্বশেষ খবরে বলা হয়েছে, খরার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গম, যব ও সয়াবিনের উৎপাদন আট শতাংশ হ্রাস পাবে। এ ক্ষেত্রে খরায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে যব। এ ফসল এখন শীষ বের হওয়ার অবস্থায় থাকায় তা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তুলনামূলক কম ক্ষতি হয়েছে সয়াবিনের। কারণ সয়াবিন এখন ফসল ওঠার পর্যায়ে রয়েছে। ফলে সয়াবিনের উৎপাদনে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে চাষীরা মনে করছে। তবে গমেরও কিছু ক্ষতি হবে। এ কারণে রাশিয়ার বাজারে গত সপ্তাহে গমের দাম কমে গেছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এই অবস্থাকে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের সঙ্গে তুলনা করলেও বিশ্বখাদ্য মজুদ পরিস্থিতি ওই সময়ের চেয়ে অনেক ভাল। ওই সময় রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গম উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। সেই সঙ্গে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ভারতেও প্রাকৃতিক দুর্যোগে চালের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বের বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোতে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। থাইল্যান্ড গত ৫০ বছর ধরে চালের সবচেয়ে বৃহত্তম মজুদ গড়ে তুলেছে। ভিয়েতনাম ও ভারতে প্রচুর খাদ্যশস্য মজুদ আছে। বরং ফলন ভাল হওয়ায় ভারত চালের পাশাপাশি গম রফতানিও শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষিপণ্যের বাজারে ফান্ড ম্যানেজারদের প্রবেশের কারণেই খাদ্য বাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বে কৃষি পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মূলত ১০টি বহুজাতিক কোম্পানি। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র চারটি কোম্পানি। ফলে তাদের ইচ্ছের ওপর খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার ওঠানামা করে। এ বছর খরায় খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ব্যবসায়ীদের প্রায় ১২ হাজার ২২৬ কোটি ডলার মুনাফা হবে বলে ব্লুমবার্গের খবরে বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই খরা নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। আসলে যতটা বলা হচ্ছে বাস্তবে পরিস্থিতি ততটা ভয়াবহ নয়। খরায় গম, যব ও ভোজ্যতেলের দাম বাড়লেও চালের বাজারে তেমন প্রভাব পড়েনি। কারণ প্রধান চাল উৎপাদনকারী দেশ থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ভারতে চালের বাম্পার ফলন হয়েছে। ভারতে গমেরও বাম্পার ফলন হয়েছে এবং ভারত গম রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে এই খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কার মধ্যে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। এর কারণ হচ্ছে গত টানা পাঁচ বছর ধরে দেশে বাম্পার ফলন হচ্ছে খাদ্যশস্যের। ফলে ২০০৭-০৮ সালের চেয়ে বাংলাদেশেও এখন খাদ্য মজুদ অনেক বেশি। বরং সরকার চাল রফতানির চিন্তাভাবনা শুরু করেছিল। কিন্তু এই খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কার কারণে সরকার চাল রফতানির সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘আগামী নবেম্বরের আগে চাল রফতানি করা হবে না। নবেম্বরে কৃষকের ঘরে আমন মৌসুমের ধান ওঠার পর এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
এছাড়া বিশ্বে খাদ্য উৎপাদনকারী অন্য দেশগুলোর খাদ্য পরিস্থিতিও পর্যবেক্ষণ করছে সরকার। জরুরী প্রয়োজনে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে চাল ও গম আমদানি করে দেশের খাদ্য মজুদ বাড়ানোরও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে খাদ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। বাংলাদেশে প্রধান খাদ্য ভাত। গমের উৎপাদন কমলেও চাল বা ধানের উৎপাদন তেমন কমেনি। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো চাল উৎপাদনকারী দেশগুলো এখনও ধানে উদ্বৃত্ত। তারা চাল বিক্রি করতেও চাইছে। তবে দেশে পর্যাপ্ত মজুদ থাকায় এই মুহূর্তে সরকার চাল কিনছে না।
তিনি বলেন, ‘জরুরী প্রয়োজন হলে আমরা দ্রুত এসব দেশ থেকে চাল কিনতে পারব। এছাড়া দীর্ঘদিন পর এবার ভারত গম রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখানে গমের উৎপাদনও বেশি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে খাদ্যমন্দার কোন আশঙ্কা দেখছি না।’
এ অবস্থায় বাংলাদেশের করণীয় প্রসঙ্গে মাহবুব আলী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে আমাদের বাজারেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমাদের ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগটা গ্রহণ করবে। বরং আন্তর্জাতিক বাজারে যে পরিমাণ দাম বাড়বে তার চেয়ে দ্বিগুণ দাম বেড়ে যাবে স্থানীয় বাজারে। যার কোন যৌক্তিক কারণ থাকবে না। তাই আন্তর্জাতিক খাদ্যপণ্যের বাজারের দিকে আমাদের তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ‘স্থানীয় বাজারে ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি মূল্য নিয়ে কারসাজি করবে ভোজ্যতেল ও গম নিয়ে। তাই স্থানীয়ভাবে এ দুটি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারী উদ্যোগে আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে প্রয়োজনের সময় সরকার বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।’
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের খাদ্য গুদামগুলোতে বর্তমানে ১৪ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে ১১ লাখ ২৩ হাজার মেট্রিক টন চাল এবং তিন লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন গম। এছাড়া বন্দরে চার হাজার মেট্রিক টন চাল এবং ১২ হাজার মেট্রিক টন গম খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে।
গত বছর এই সময়ে সরকারী খাদ্য গুদামগুলোতে মজুদ ছিল ১৩ লাখ ২১ হাজার ৫২০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। এর মধ্যে চাল ছিল ১০ লাখ ৪৪ হাজার ৯০০ টন এবং গম ছিল দুই লাখ ৭৬ হাজার ৬৪০ টন।
গত ১ জুলাই থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত দুই লাখ ৬৪ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারী খাতে এক লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন এবং বেসরকারী খাতে এক লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য এসেছে।
গত বোরো মওসুমে সরকার ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল কেনার ঘোষণা দিলেও এ পর্যন্ত কিনতে পেরেছে ছয় লাখ ৬১ হাজার ৭২০ মেট্রিক টন। গুদামে জায়গা না থাকায় গত মে মাসে শুরু হওয়া এ কার্যক্রমের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। ফলে চালকল মালিকদের গুদামে চাল রাখা হচ্ছে।
এছাড়া বেসরকারী পর্যায়েও প্রচুর ধান চাল মজুদ আছে। চাল ব্যবসায়ী এবং কৃষক উভয়ের ঘরেই গত কয়েক বছর ধরে বিপুল পরিমাণ ধান চাল মজুদ রয়েছে। এই মজুদের পরিমাণ প্রায় কোটি টনের ওপর গিয়ে দাঁড়াবে। কারণ গত তিন বছর ধরেই দেশে চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন খাদ্য শস্য উদ্বৃত্ত থাকছে। যার সিংহভাগই ব্যবসায়ী ও কৃষকের হাতে মজুদ রয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বছরে গমের চাহিদা ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টন। এ বছর দেশে উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ টন গম। সরকারী গুদামে মজুদ রয়েছে তিন লাখ ১৭ হাজার টন গম। এ বছর সরকারের আরও ১০ লাখ টন গম আমদানির কথা রয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজে খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে ১৩ হাজার টন গম। চাহিদার বাকি ১৫ লাখ টন গম বেসরকারীভাবে আমদানি হবে।

No comments

Powered by Blogger.