জমি নেই, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ফেরত যাচ্ছে by ড. আর এম দেবনাথ

কয়েকদিন আগে আমার এক পরিচিত ব্যবসায়ী বন্ধু দুঃখ করে ব্যবসা ও শিল্পের কিছু খবর দিচ্ছিলেন। ভদ্রলোক নরসিংদীর ব্যবসায়ী। রং ও সুতার ব্যবসা করেন। বলা যায় মাঝারি ধরনের ব্যবসায়ী। বহুদিন এই ব্যবসায় জড়িত থেকে কিছু টাকার মুখ দেখেছেন। দেখেছেন স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা করেই। তাঁর এখন বয়স হয়েছে।
তিনি চান তাঁর ছেলে একটা কিছু করুক। রং ও সুতার ব্যবসাকে কেন্দ্র করে একটা শিল্প করা যায় কিনাÑএটাই তাঁর মাথায়। তিনি যথারীতি লেগে যান এই প্রকল্পে। শিল্প করতে গেলে প্রথমেই দরকার জমি। ছোটখাটো শিল্প করতে গেলেও এক-দুই-তিন বিঘা জমি লাগে। তিনি জমির দালালের শরণাপন্ন হন, বন্ধুদের বলেন, পরিচিতদের বলেন জমির কথা। ছয় মাস চেষ্টা করেও তিনি মনমতো জমি পাচ্ছেন না। পূর্বাচলের আশেপাশে, পূবাইল, ঢাকা-নরসিংদী রোড, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোড, সাভার-আশুলিয়া পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করে তিনি শেষ পর্যন্ত বিফল মনোরথ হয়ে বসে পড়েছেন। জমি মিলে তো জমির ‘টাইটেলে’ গ-গোল, ‘টাইটেল’ মিলে তো পরিমাণে মিলে না। পরিমাণে ও টাইটেলে মিলে তো দামে বনে না। সোনার চেয়ে দাম জমির। অল্পস্বল্প পুঁজির লোকের পক্ষে জমি কেনা সম্ভব নয়। যেখানে গেছেন সেখানেই খবরÑ এই জমির মালিক ঢাকার অমুক গ্রুপের অমুক। একই ধরনের কথা ও অভিজ্ঞতার বিষয় শুনেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। সেটা ছিল উপজেলা শহরের ঘটনা। আমার পরিচিত একটা ছেলে ব্যাংক থেকে ‘লোন’ নিয়ে মাছের চাষ করতে চায়। ওর নিজস্ব জমি যা আছে তা মাছ চাষের উপযুক্ত নয়। আমাকে বলার পর ওকে বললাম পুকুরের ব্যবস্থা করতে। যতটুকু সাহায্য করা যায় তা আমি করব। প্রথম প্রথম সে ভীষণ উৎসাহী ছিল। যতই সময় যায় সে আর আসে না। খবর নিয়ে জানলাম মাছ চাষের উৎসাহ তার মিলিয়ে গেছে। জমির ভীষণ দাম। তারপর তাতে পুকুর কাটার কাজ ব্যয়বহুল ব্যাপার। তারপর ব্যাংক লোন। সব মিলিয়ে ব্যাংক নাকি বলেছে, এই প্রকল্পে তার লাভ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
এই যে ঘটনাটি বললাম তার ওপর আমি একবার লিখেছি। আর জমিজমার দামের ওপর লিখেছি অনেকবার। গত তিন-চার বছরে অন্তত চারবার লিখেছি। বলেছি জমি নিয়ে নিচ্ছে ভূমিদস্যুরা, প্রভাবশালীরা। জমি কিনে নিচ্ছে বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। একদম গ্রামে জমি কিনে নিচ্ছে রেমিটেন্সওয়ালারা। এতে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে এখন কৃষির জমি হ্রাস পাচ্ছে। দিন দিন চাষের জমি কমছে। আবার অন্যদিকে শিল্পের জন্য জমি পাওয়া যায় না। সরকার একেকটা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা কাগজে দেয় আর ওই অঞ্চলে জমির দাম বাড়ে হু হু করে। ফল? ফলে কৃষি হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু শিল্প হচ্ছে না। এই সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখেছি এই আশায় যে, সরকার হয়ত এর প্রতি নজর দেবে। না, তা হয়নি।
আমার কথা, ইদানীং দুই-একজন মন্ত্রী সমস্যাটির কথা বলতে শুরু করেছেন। গত কয়েকদিন আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আমাদেরকে জানিয়েছেনÑবিদেশী বিনিয়োগকারীরা আসতে চাইছে বাংলাদেশে। এদের সংখ্যা প্রচুর। এরা জমি চায়। কিন্তু সরকারের কাছে জমি নেই। অর্থাৎ জমির অভাবে শিল্পায়ন, বিদেশী বিনিয়োগ হচ্ছে বিঘিœত। তিনি একই সভায় আরেকটি সমস্যার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, কুইক রেন্টালে বিদ্যুত উৎপাদন করতে গিয়ে এখন ব্যাংকের ঋণ প্রদান কার্যক্রম বিঘিœত হচ্ছে। কারণ, এই খাতে মোটা পরিমাণ ঋণ ব্যাংকগুলো প্রদান করেছে। এ বিষয়টি ভিন্ন একটা বিষয় বিধায় আমি এর আলোচনায় যাচ্ছি না। কুইক রেন্টালে কত টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে, এই পরিমাণ টাকা না দিয়ে কি সমপরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব ছিল কিনা, কুইক রেন্টাল আদৌ প্রয়োজন ছিল কিনা, কুইক রেন্টালের জন্য অর্থনীতির কি সমস্যা হচ্ছে, ভতুর্কির পরিমাণ এতে কত টাকা বেড়েছে ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়। অতএব এই যাত্রায় এসব বিষয় নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছি না। আলোচনা উপস্থিত ক্ষেত্রে দরকার জমি নিয়ে। চোখের সামনে জমি, ফ্ল্যাট, বাড়িঘর ইত্যাদি নিয়ে যাচ্ছেতাই ঘটছে। অথচ কেউ দেখার নেই। এখন মনে হচ্ছে হাতে আগুন লেগেছে। হাতে আগুন লেগেছে। কারণ এখন শিল্পায়নের জন্য জমি নেই। কাগজে দেখেছি কুমিল্লার গৌরীপুরের মতো জায়গায় এককাঠা জমির দাম নাকি দুই-তিন কোটি টাকা। ঢাকার আশেপাশে উপজেলা শহরে এক শতাংশ জমির দাম ছয় থেকে আট লাখ টাকা। উত্তরবঙ্গ, রাজশাহী, রংপুর অঞ্চলের খবরও প্রায় একই। ঢাকা শহরের কথা আলোচনায় আসছি না। কারণ ঢাকায় জমি নয়, এখন ছোট ফ্ল্যাট কেনাও সাধারণের জন্য সম্ভব নয়। এই যে পরিস্থিতি তা কি একদিনে তৈরি হয়েছে?
সর্বশেষ ঘটনার কথা দিয়ে শুরু করা যাক। দেশে দুটো বড় ধরনের ফ্রড করেছে দুটো মাল্টিলেভেল কোম্পানি। এর মধ্যে একটি ‘যুবক’। এখন নাম আসছে ডেসটিনি গ্রুপের। খবরের কাগজে দেখলাম এরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নামে-বেনামে জমি কিনেছে; যার হদিস করা এক কঠিন ব্যাপার। প্রশ্ন, এই ঘটনা কি সরকারের কোন এজেন্সি জানত না, রাজনীতিবিদরা জানত না, মুক্তিযোদ্ধারা জানত না। যদি জানত তাহলে বাধা দেয়া হলো না কেন? এই দুটোর পরে আরও একটা খুবই বড় ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটা সোনালী ব্যাংকের। তবে আমার ধারণা, আরও অনেক ব্যাংক এতে শেষ পর্যন্ত জড়াবে। ঘটনাটি ‘হলমার্ক’ গ্রুপের। এটি কোন বিখ্যাত গ্রুপ বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নয়। এখন খবর পাওয়া যাচ্ছেÑপ্রতিষ্ঠানটি ‘লোকাল এলসি’নামীয় একটা সুন্দর ব্যবস্থার মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে ২-৩ হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়েছে। কারো কারো ধারণা, সব ব্যাংকের এদের মেরে দেয়া টাকার পরিমাণ আরও বেশি হবে। বাজারের খবর, তারা এই টাকার একটা বড় অংশ দিয়ে সাভার অঞ্চলে জমি কিনে রেখেছে, যার হদিস পাওয়াও কঠিন হবে। বলা বাহুল্য, এই প্রতিষ্ঠানের পেছনে খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রয়েছেন। এরা কেন, আমরা জানি ব্যাংকিং খাতে টিআর (ট্রাস্ট রিমিট) লোন বলে একটা ‘সেল’ আছে। মাল এসেছে বিদেশ থেকে। পার্টির টাকা নেই মাল বন্দর থেকে ছুটানোর। ব্যাংক ‘ট্রাস্ট’ করে মালের ডক্যুমেন্ট পার্টিকে দিয়ে দেয়। পার্টি মাল বিক্রি করে টাকা ফেরত দেবে। দেখা যাচ্ছে, এই ‘ক্রেডিট ফেসিলিটি’র যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। ঋণ ‘পুনর্তফসিলের’ মতো একটা ভাল ব্যবস্থাকে ব্যবসায়ীরা একটা আতঙ্কজনক ব্যবসায় পরিণত করেছে। তারা একের পর এক পুনর্র্তফসিল করিয়ে নিচ্ছে। করিয়ে নিচ্ছে সুদ মওকুফ। বিদ্যুত নেই, গ্যাস সংযোগ নেই, ব্যাংকগুলো প্রকল্প ঋণ দিয়ে যাচ্ছে সমানে। কোন খবরদারি নেই। এসব কেন হচ্ছে? আমার অনুমানÑঅনুমান বলি কেন, বাজারে সবাই জানে ‘বড় বড় ব্যবসায়ীরা নিজের টাকায় তো জমি কিনছেই, ব্যাংকের টাকায়ও জমি কিনছে। রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, খুলনা পর্যন্ত এই জমি কেনার ঘটনা ঘটছে। ঢাকার আশেপাশে তো আগেই তা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা জমির ব্যবসাকে খুবই লাভজনক ব্যবসা মনে করে। ভূমিদুস্যরা জমি দখল করে মানুষকে প্রলুব্ধ করে হাজার হাজার একর জমি বিক্রি করছে বেআইনীভাবে। সরকারও জমিতে বিনয়োগকে উৎসাহিত করছে। সঞ্চয়পত্রকে এক-দুই বছর আগেও অলাভজনক বিনিয়োগে পরিণত করা হয়। এর ফলে প্রচুর লোক গেছেন শেয়ারবাজারে, জমিতে। এখন ব্যাংকের আমানতের ওপর চড়াও হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। ‘টিআইএন’-এর নামে ১৫ শতাংশ কর বসানো হয়েছে ব্যাংকসুদের ওপর। বলা হচ্ছে জমিতে যাও। এদিকে বিদেশে যাঁরা থাকেন তাঁরা যে টাকা পাঠান গ্রামে বসবাসকারী বাবা-মার কাছে তারাও জমি কিনছে, বাড়ি করছে। এটা দেখার কেউ নেই। এমন অমূল্য সম্পদ বৈদেশিক মুদ্রার টাকা বিনিয়োজিত হচ্ছে জমিতে। ফলে কি গ্রামে, কি শহরে জমির দাম বাড়ছে শনৈঃ শনৈঃ। লাভজনক বিনিয়োগ মনে করে অনেক মধ্যবিত্তও ঢাকার আশেপাশে জমি কিনে বিনিয়োগ করে রেখেছেন।
এই পরিস্থিতিতে এখন আমরা চোখেমুখে সর্ষে ফুল দেখছি। চাষের জমি কমছে, শিল্পায়নের জন্য জমি পাওয়া যাচ্ছে না। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ফেরত যাচ্ছেন। দেশীয় উদ্যোক্তারা, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারিরা হাহুতাশ করছেন। তাহলে করণীয় কি? আমার কতক সুপারিশ আছে। ঢাকা ও তার আশেপাশে যেসব বৈধ আবাসিক এলাকা আছে, যেখানে প্রকল্প করা হয়েছে সেখানে যাঁরা জমি কিনেছেন তাঁদেরকে সময় বেঁধে দেয়া হোক। বলা হোক, বাড়ি করার জন্য জমির প্লট কিনেছেন ভাল কথা। এতদিনের মধ্যে বাড়ি করতে হবে। এভাবে একটা চাপ তৈরি করে জমির ‘স্পেকুলেশন’ বন্ধ করা হোক। বড় বড় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী যাঁরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় জমি কিনেছেন বিনিয়োগ হিসাবে তাঁদের কাছ থেকে সেই জমির হিসাব নেয়া হোক। তাঁরা সেখানে কি শিল্প করবেন তার সম্বন্ধে তথ্য নেয়া হোক। তা না দিলে তাদের ‘টিআর লোন’ সুবিধা বাতিল করা হোক। তাদের ঋণ সুবিধা, বিশেষ করে পুনর্তফসিল সুবিধা বন্ধ করা হোক। ভয় দেখানো হতে পারে। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। আমার ধারণা, কিছুই হবে না। ঋণের টাকা ডাইভার্ট করে যাঁরা জমি কিনেছেন তাদের হিসাব চেক করলেই তারা ধরা খাবে। দরকারবোধে ‘চার্টার্ড এ্যাকাউন্ট্যান্টদের’ এই দায়িত্ব দেয়া হোক। তাঁরা টাকা নিয়ে কোথায় কোথায় চেক পেমেন্ট করেছেন এই তথ্য নিলেই জমি কেনার তথ্য পাওয়া যাবে। ঋণ বরাদ্দের টাইম এবং সাবরেজিস্ট্রি অফিসের বড় বড় জমি কেনার রেকর্ড খুঁজলেও তথ্য পাওয়া যাবে। ভূমিদস্যুদের দখলীকৃত জমি উদ্ধার করা হোক। দরকারবোধে লোকাল লোকদের সাহস দেয়া হোক আন্দোলন করার জন্য। যেমন প্রভাবশালী লোক জমি দখল করেছে তাদের নাম কাগজে ছাপা হোক। এভাবে শত পথ আছে জমির স্পেকুলেশন বন্ধ করার। দেখা যাচ্ছে, বড় বড় গ্রুপ সরকারের কাছ থেকে শিল্প কিনে নিচ্ছে এক উদ্দেশ্য। কিন্তু কেনার পর সেই উদ্দেশ্য জলাঞ্জলি দিচ্ছে। এ কাজে মন্ত্রী-এমপি সাহেবরা মদদ দিচ্ছেন। আমি একটা ঘটনার কথা বলতে পারি। এ রকম ডজন ডজন উদাহরণ আছে। ব্যবসায়ীরা যেকোনভাবে পারে খালি জমি হস্তগত করছে। আমার ধারণা, সরকার শক্ত হলে এসব বন্ধ করা সম্ভব। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, নয় পেরিয়ে গেছে। জমি নেই শিল্পায়নের। ভূমিদস্যু ও বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিকে জমির স্পেকুলেটিভ ব্যবসা থেকে নিরস্ত করতে না পারলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক বিআইএম

No comments

Powered by Blogger.