দেশে দেশে নারী নেতৃত্ব by লিটু খান

মেরি পেট্রিসিয়া ম্যাক্যালেসি : আয়ারল্যান্ডের অন্যতম সফল ও প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট মেরি ম্যাক্যালেসি। দেশটির অষ্টম প্রেসিডেন্ট ও দ্বিতীয় নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তিনিই বিশ্বের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রেসিডেন্ট, যিনি একজন নারী প্রেসিডেন্টের উত্তরসূরি হিসেবে দেশ পরিচালনা করার বিরল গৌরব ও সোভাগ্য অর্জন


করেছেন। অর্থাৎ মেরিম্যাক্যালেসি ব্যতীত বিশ্বের অন্য কোন নারী প্রেসিডেন্টই কোন নারী প্রেসিডেন্টের পর পর নির্বাচিত হননি। ১৯৯৭ সালে তিনি দেশের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসনের উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচিত হন।
প্রথম মেয়াদে ৭ বছর সফলভাবে দেশ পরিচালনার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৪ সালে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয় মেয়াদে পুনর্নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় মেয়াদেও সফলতার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার পর তিনি ১০ নবেম্বর ২০১১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অফিস ত্যাগ করেন। তিনি বর্তমানে ক্ষমতাসীন ও প্রাক্তন নারী রাষ্ট্র প্রধানদের সংগঠন ‘কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড উইম্যান লিডার্স’Ñএর একজন সক্রিয় সদস্য। দীর্ঘ ১৪ বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পূর্বে তিনি সাংবাদিকতা ও আইন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। কর্মজীবেনে সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ চলতি বছরের মে মাসে তিনি স্বামী মার্টিন ম্যাক্যালেসির সঙ্গে যৌথভাবে ‘তিপ্পারারি শান্তি পুরস্কারে’ ভূষিত হন।

এ্যাঞ্জেলা মেরকেল : জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মেরকেল। তিনি দেশের বর্তমান ও প্রথম নারী চ্যান্সেলর হিসেবে দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত আছেন। ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ভৌত রসায়নের ওপর পড়াশুনা শেষ করেন। ইতোমধ্যে কোয়ান্টাম রসায়নের ওপর গবেষণার জন্য ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। গবেষক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ও বেশকিছু গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। কিন্তু নিয়তির লিখন ছিল ভিন্ন। ১৯৮৯ সালের দিকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বিভক্ত জার্মানিÑ পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানি। ১৯৮৯ সালের নবেম্বরের দিকে দুই জার্মানির সীমানা বিভেদকারী বার্লিন প্রাচীর পতনের পর পর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। এই সময় তিনি নব গঠিত ‘ডেমোক্র্যাটিক এ্যাওকেনিং’ নামক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হন। পূর্ব জামানির প্রথম (একমাত্রও বটে) গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর তিনি জার্মানি পুনরেকত্রীকরণ প্রক্রিয়া পূর্ব লুথার ডি মাজিরের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের সহকারী মুখপাত্র হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৯০ সালে জার্মানি পুনরেকত্রীকরণের পর তিনি একজন বানডারটাক বা জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষের আইনপ্রণেতা সদস্য নির্বাচিত হন। শুরু হয় এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। তিনি ১৯৯৮-২০০০ মেয়াদে ‘ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন-এর (সিডিইউ) সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০০০ সালে এর সভানেত্রী নিযুক্ত হন। বর্তমানেও তিনি এই রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত আছেন। ২০০৫ সালে অনুষ্ঠিত দেশের কেন্দ্রীয় নির্বাচনে চ্যান্সেলর হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তাঁর বোনের দল ‘ক্রিস্টিয়ান সোশাল ইউনিয়ন’ (সিএসইউ) ও ‘সোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব জামার্নি’কে (এসপিডি) নিয়ে বৃহত্তর জোট গড়ে তোলেন। উল্লেখ্য, তিনি এই জোটের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের কেন্দ্রীয় নির্বাচনে তাঁর দল সিডিইউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে তিনি বোনের দল সিএসইউ ও ‘ফ্রি ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। বর্তমানে এই কোয়ালিশন সরকারই দেশের রাষ্টক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। ২০০৭ সালে তিনি ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই বছরে জি-৮ প্রধানের দায়িত্বও পালন করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাংবিধানিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে পরিচিত ২০০৭ সালের ঐতিহাসিক লিসবন চুক্তি বাস্তবায়নে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। একই বছরের বার্লিন ঘোষণায় তাঁর ভূমিকাই ছিল অগ্রগণ্য। এক কথায় ইইউ প্রতিষ্ঠায় যাঁদের অবদান অগ্রগণ্য তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে ইউরো জোনেরও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ‘নীতিনির্ধারক’ (ডিসাইডার) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। স্বদেশে সরকার পরিচালনায় তাঁর স্বাস্থ্যনীতি সংস্কার ও জ্বালানি উন্নয়ন পরিকল্পনা দৈশিক ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে।

ভেরোনিকা মিশেল ব্যাশেলেট জেরিয়া : মিশেল ব্যাশেলেট নামেই তিনি পরিচিত। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট। দেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী রাষ্ট্রপ্রধান। ১১ মার্চ ২০০৬ থেকে ১১ মার্চ ২০১০ মেয়াদে তিনি দেশের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট রিকার্ডো ল্যাগোসের মন্ত্রিসভায় প্রথমে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পরবর্তীতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, মিশেল ব্যাশেলেটই লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম নারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের গৌরবের অধিকারী।
রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার আগে তিনি শিশুচিকিৎসক ও দুর্ভিক্ষ পরবর্তী স্বাস্থ্যকর্মীর পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি একজন বহুভাষাবিদ। স্প্যানিশ, জার্মান, ইংরেজী, পর্তুগিজ, ফরাসী ভাষায় তিনি সমানভাবে পারদর্শী। সামরিক কৌশল বিষয়েও তিনি পড়াশুনা করেছেন। রাজনীতিতে তিনি বাম ঘরানার মধ্যপন্থী সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত। দেশটির ২০০৬ সালের নির্বাচনে ৫৩ শতাংশ ভোটে লাভ করে তিনি ডানপন্থী নেতা ও কোটিপতি ব্যবসায়ী সেবাস্টিন পিনেরাকে পরাজিত করেন ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অব্যাহতি গ্রহণের পর তিনি একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের প্রধান নিযুক্ত হন। ২০০৮ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় তিনি ২৫তম স্থানে জায়গা করে নেন। এছাড়া, একই বছরে টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় তিনি ১৫তম হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.