সুকান্তের কবিতা বিপ্লবী উচ্চারণ by মোহাম্মদ নূরুল হক

বাংলা কবিতার যে ধারাটি সংগ্রাম, প্রতিবাদের পথে বিকশিত- সে ধারার প্রথম সার্থক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী নজরুল ইসলামই প্রথম দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সাহিত্যিক কলম ধরেন এবং বিস্ময়করভাবে সফল হন। তার কবিতায় প্রথম গণমানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায় এবং সে কণ্ঠস্বরে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়।
কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অস্থির চিত্তের এবং চঞ্চল। বস্তুতপক্ষে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রেমের কবি। তার রাজনীতি, সমাজ সচেতনতামূলক কবিতার প্রাচুর্য সত্ত্বেও এ কথা সত্য। ফলে তার কবিতা শুধু সংগ্রামের কবিতা হিসেবে আর থাকল না; তিনি একই সঙ্গে অন্যান্য ধারার কবিতা রচনায়ও আত্মনিয়োগ করলেন। পরবর্তীতে শ্রেণী সংগ্রাম ও বিপ্লবী ধারার কবিতা রচনায় যারা অবতীর্ণ হয়েছেন তাদের মধ্যে সুকান্তের কবিতাও প্রকাশরীতিতে স্বতন্ত্র। আধুনিক বাংলা কবিতায় বিপ্লবী ধারার কবিতা রচনার ক্ষেত্রে সুকান্তের স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয় এবং উজ্জ্বল। তার আগে আর কারও কবিতা একান্তভাবে শ্রেণী সংগ্রামের নয়; নয় সম্পূর্ণ বিপ্লবী ধারার- সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে মনে রেখেও এ কথা দ্বিধাহীন বলা যায়। পূর্ববর্তী কবিদের কবিতার একটি অংশমাত্র সংগ্রামী চেতনা সমৃদ্ধ; সম্পূর্ণ নয়। কিন্তু সুকান্তের কবিতার প্রায় সবটাই শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে।
যে দেশে মানুষ জন্মগ্রহণ করেই জানতে পারে “ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি” এবং হিসেবের খাতায় “রক্তখরচ”ই লেখা সে দেশে “পদাঘাত” অনিবার্য হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের জীবনে। সুতরাং শোষক শ্রেণীকে প্রণাম করার দিন শেষ হয়ে আসে স্বাধীনতাকামী কবির কাছে :

... তাইতো চলেছি দিন পঞ্জিকা লিখে
বিদ্রোহ আজ! বিপ্লব চারিদিকে
(অনুভব : সুকান্ত সমগ্র পৃ: ৩৩)

মানুষ স্পষ্টই দুটি শিবিরে বিভক্ত। প্রথম শ্রেণী হচ্ছে শোষিত- যারা সংখ্যায় বেশি; দ্বিতীয় শ্রেণী হচ্ছে শোষক- যারা সংখ্যায় কম। এই কম সংখ্যক শোষক শ্রেণীর অত্যাচারে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ প্রকম্পিত। তাদের প্রতিবাদের ভাষাও যেন নেই। যেন তারা দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেও শান্তির মুখ দেখা পাপ। কারণ শোষক শ্রেণীর রক্তচক্ষু সব সময় দুর্বলদের ওপর নিক্ষিপ্ত। যেহেতু সম্পদ সীমিত এবং এই সীমিত সম্পদের সিংহভাগই জোতদার মজুতদারদের হাতে কুক্ষিগত এবং তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে সম্পদের বণ্টন, সেহেতু তাদেরকে খুশি রাখার জন্য সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ নিজেদের অধিকার আদায়ের দাবি উত্থাপন করতে পারে না। এর কারণ অস্পষ্ট নয়; শাসক এবং শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে বিপ্লব সহজসাধ্য নয়, এবং ব্যর্থ বিপ্লবে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের পরাজয় ও করুণ পরিণতি অনিবার্য। আর তাই সাধারণ মানুষ দুঃশাসন এবং শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশ নেয় না। তবুও তাদের জীবনে শান্তি আসে না। সাম্রাজ্যবাদী জাতিগুলো দরিদ্র জাতিগুলোর ওপর নিরন্তর অত্যাচারের খড়গ কৃপাণ উত্তোলিত রাখে এবং বিভিন্ন অজুহাতে তার প্রয়োগও করে। কিন্তু এভাবে তো আর চলতে দেয়া যায় না। শ্রমিকের শ্রমের ফসল অন্যের গোলায় উঠবে অথচ শ্রমিক থাকবে নিরন্ন, এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন।
তবু আমরা জানি
চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে
চাপা থাকবে না
আমাদের দেহে তোমাদের এই পদাঘাত।
আর সম্রাট হুমায়ুনের মত
একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্খলন।
( সিঁড়ি : সুকান্ত সমগ্র পৃঃ ২৭)

স্বদেশ পরাধীন। সেখানে বিপ্লবী, স্বাধীনতাকামী মানুষের স্থায়ী ঠিকানা অন্বেষণ বৃথা। প্রকৃত দেশপ্রেমিক বিপ্লবীর ঠিকানাতো প্রত্যেক স্বাধীনতাকামী দেশ এবং প্রতিটি বিপ্লবী প্রাণতো একই সূত্রে গাঁথা। তাদেরকে ভিন্ন করে দেখার অবকাশ কই? প্রকৃত স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীর ঠিকানা স্বদেশ মুক্ত হওয়ার আগে স্থির হয়ই বা কী করে!
পৃথিবী যেখানে অন্যায় অত্যাচারে আকীর্ণ, সেখানে শান্তির বারতা অর্থহীন; সেখানে প্রয়োজন সংগ্রাম আর গণ অভ্যুত্থান। যুদ্ধ ছাড়া অত্যাচারী শোষক শ্রেণীর পতন সম্ভব নয়। কারণ, শোষক শ্রেণী কখনও স্বেচ্ছায় শ্রমিকের হাতে শাসনভার সমর্পণ করবে না এবং করেও না। তারা চিরকালই নানা অজুহাতে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করে থাকে এবং থাকার পথ তৈরি করে। আর তাই বিপ্লবী দেশপ্রেমিকের চোখে লেনিন হয়ে ওঠেন আদর্শ প্রতীক-

লেনিন ভূমিষ্ঠ রক্তের ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ
বিপ্লবী স্পন্দিত মনে হয় আমিই লেনি
( লেনিন: সুকান্ত সমগ্র পৃঃ ৩২)

লেনিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় সত্য; তবে তা স্থায়ী হয় না। আবার জেগে ওঠে অত্যাচারী, মজুদদার, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর লুণ্ঠন, রাহাজানির ফলে ভারতবর্ষে নেমে আসে জ্বরা, মৃত্যু, ক্ষুধা আর সঙ্কটময় সকাল-সন্ধ্যা। দেশে দুর্ভিক্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। কৃষকের ফসল মজুদদার মুনাফাখোরদের জিম্মায় চলে গেলে সাধারণ মানুষের অন্ন জোটে না। ফলে মানুষের মুখের হাসি শুকিয়ে যায়; বিষণœতা বাসা বাঁধে খেটে খাওয়া মানুষের মনে। কবি চঞ্চল হয়ে ওঠেন এবং বিপ্লবী আহ্বান করেন-

ভারতবর্ষের পরে গলিত সূর্য ঝরে আজ
দিগি¦দিকে উঠেছে আওয়াজ
রক্তে আনো লাল
রাত্রীর গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল

কারণ
নিরন্ন আমার দেশে আজ তাই উদ্ধত জেহাদ
টলোমলো এ দুর্দিন, থরোথরো জীর্ণ বনিয়াদ।
তাইতো রক্তের স্রোতে শুনি পদধ্বনি
বিক্ষুব্ধ টাইফুন- মত্ত চঞ্চল ধরণী;
বিপন্ন পৃথিবীর আজ শুনি শেষ মুহুর্মুহু ডাক...
(বিবৃতি : সুকান্ত সমগ্র পৃঃ ৩৭ )

যে জনজীবনে স্বাধীনতা নেই, নেই ক্ষুধার অন্ন; চিকিৎসা এবং সম্পদের সুষম বণ্টন; সে জনজীবনে হাসি, প্রেম ভালবাসা অবান্তর। যে জনজীবনে নিরন্নের আর্তচিৎকারে আকাশ চৌচির। “পূর্ণিমা চাঁদ ... ঝলসানো রুটি”-এর মতোই মনে হয় ক্ষুধার্ত মানুষের। সে জনজীবনে বিনোদন অপ্রত্যাশিত এবং বেমানান। পৃথিবীর পরিব্রাজকযোদ্ধা সমগ্র প্রতারিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিয়োজিত। প্রেয়সীর কথা মনে পড়লেও ঘরে ফেরার সময় হয়ে ওঠে না তার। তবু একবার কোন এক ফাঁকে মনে পড়ে- প্রিয় রমণীর কথা। সেখানেও ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রামে দৃঢ় প্রত্যয় এবং শেষ দীর্ঘশ্বাস।

আমি যেন সেই বাতিওয়ালা
যে সন্ধ্যায় রাজপথে বাতি জালিয়ে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই বাতি জ্বালার সামর্থ্য
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার
(প্রিয়তমাসু : সুকান্ত সমগ্র পৃ : ৭৩)

শোষক শ্রেণীর হাত থেকে শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের চাবি কেড়ে আনতে হলে সর্বাগ্রে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রয়োজন। কারণÑ স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যতীত স্বাধীনভাবে কোন চিন্তার প্রকাশ, বিকাশ এবং বাস্তবায়ন কখনও সম্ভব নয়। মহাজনদের হাত থেকে খেটে খাওয়া মানুষের সম্পদ ফিরিয়ে আনতে হলে স্বাধীন স্বদেশ ভূমির ব্যবস্থাটা আগেই করা দরকার। দেশের স্বাধীনতার পক্ষে সুকান্তের পঙ্ক্তিগুলো :

বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষè করো চিত্ত
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত
মূঢ় শত্রুকে হানো শ্রোতে রুখে তন্দ্রাকে করো ছিন্ন
একাগ্র দেশের শত্রুরা এসে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন
(উদ্যোগ : সুকান্ত সমগ্র পৃ : ১০৫)

বাচাঁব দেশ আমার দেশ হানবো প্রতিপক্ষ
এ জনতার অন্ধচোখে আনবো দৃঢ় লক্ষ্য
বাইরে নয় ঘরেও আজ মৃত্যু ঢালে বৈরী
এদেশে জনবাহিনী তাই নিমিষে হয় তৈরী
(ছুরি : সুকান্ত সমগ্র : ৭৩)

তার অধিকাংশ সফল কবিতা নিরূপিত ছন্দে রচিত; তবে ছন্দের প্রচলিত নিয়মের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে গদ্য ছন্দেও কবি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার অধিকাংশ কবিতা বিপ্লবী ধারার কবিতা হওয়ার পরও সেøাগানসর্বস্ব নয়; নয় তাৎক্ষণিক ঘটনাপুঞ্জের সাংবাদিক প্রতিবেদন কিংবা রাজনৈতিক বিবৃতি মাত্র। শব্দ নির্বাচন ও প্রয়োগে তার পরিমিতি বোধ তার কণ্ঠস্বরকে দিয়েছে প্রাতিস্বিক চারিত্র্য। যা সুকান্ত পূর্ববর্তী বা পরবর্তী আর কারও মধ্যে তেমনভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। উপমা ব্যবহারেও কবি অভিনব। বিশেষত পূর্ণিমা চাঁদকে প্রিয়ার সৌন্দর্যের সাথে তুলনা না করে ঝলসানো রুটির সাথে তুলনা করে কবি ক্ষুধার্ত মানুষের অসহনীয় পর্যায়ের যে চিত্র অঙ্কন করেছেন, তেমন করে আর কেউ দেখাতে সক্ষম হননি। এখানে কবি কাব্যিক সত্য ও বস্তুগত সত্যের যে সমন্বয় সাধন করে দেখিয়েছেন তা আধুনিক কবিতার পাঠক মাত্রই সম্পূর্ণ নতুন ধরনের উপমার ব্যবহার লক্ষ্য করে বিস্ময়াভিভূত। পরবর্তীতে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের অনুভবে ‘পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ বাক্যটি প্রবচনের মর্যাদা লাভ করে।
সুকান্তের কবিতা নিবিড়ভাবে পাঠ করে পাঠকের বোধে যে বিষয়টি প্রতিভাত হয় তা হচ্ছে কিছু কবিতা বাদ দিলে সিংহভাগ কবিতাই বিপ্লব, স্বাধীনতা এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের বিষয় সম্পৃক্ত। তার কবিতা পাঠে যে কণ্ঠস্বরটি পাঠকের কানের কাছে ক্রমাগত গর্জন করে উঠে- তা বিপ্লবের। সেখানে আপোস নেই; আছে কেবল সংগ্রাম, অসহযোগিতা আর প্রতিবাদ। প্রকৃত বিপ্লবী কবিতার স্বাদ গ্রহণ করতে হলে সুকান্তের কবিতার কাছে পাঠককে বার বার ফিরে যেতে হয়; কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে বিপ্লবের সেøাগান এবং দীপ্ত ঘোষণার এমন অজর প্রকাশের প্রাচুর্য পাঠকের মনে ক্রমাগত যে অনুরণন তোলে তা দীর্ঘকাল বঞ্চিত মানুষের মুক্তির মন্ত্রে রূপান্তরিত হতে হতে পাঠকের নতুন চিন্তার দ্বার উন্মোচন করে দেয়। আর এ জন্যই পাঠকের কাছে সুকান্ত ভট্টাচার্য আপাদমস্তক একজন বিপ্লবী কবি; অন্য কথায় শ্রেণী সংগ্রামের কবি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।

No comments

Powered by Blogger.