জরিনা বুবু ও আমরা

আজ থেকে সাত বছর আগে ১৮ জুলাই ভোরে জরিনা বুবু আমাদের থেকে বিদায় নিলেন। রাত ১১.৩০ মি. থেকে ভোর ৫.৩০ মি. পর্যন্ত তাঁর কাছে আমি একনাগাড়ে ছিলাম। চেষ্টা করেছি ড্রপার দিয়ে একটু পানি বা মধু খাওয়াতে। রাত সাড়ে ১২টা বা ১টা’র দিকে তাঁর একটু একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। আস্তে আস্তে তা বাড়ল।


আমি শ্বাসকষ্ট কমানোর ওষুধ ড্রপার দিয়ে একটু একটু দিলাম। শ্বাসকষ্ট বাড়ল। রাত শেষ হওয়ার পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট অনেকটা কমে এল। ভোরের আজান শোনা গেল। আমার মেয়ে উম্মিকে শামিম ডাকল। সে ঘুম থেকে উঠে এল। আমার ছেলে শামিম বলল, আম্মা সারারাত একটুও ঘুমায়নি। শুনে মেয়ে উম্মি বলল, আম্মা যাও তুমি একটু শোও।
আমি তাদের পীড়াপীড়িতে উঠে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে বিছানায় গা এলালাম, কিন্তু ঘুমুতে পারলাম না। মিনিট পনেরো পরে উঠে জরিনা বুবুর কাছে এলাম। আমার মেয়ে কিছুটা মনোক্ষুণœ হলো বিশ্রাম না নিয়ে চলে আসায়। দেখলাম তাঁর শ্বাসকষ্ট আর নেই। তখনও বুঝতে পারিনি। তিনি চলে গেছেন ইহজগত ছেড়ে। শামিমকে ডেকে বললাম, দেখ দেখ এখন তো শ্বাসকষ্ট নেই। আমার ছেলেরা শামিম-তামিম পাশের কনসার্স ক্লিনিক থেকে ডাক্তার নিয়ে এলো। ডাক্তার বললেন, ‘তিনি তো মারা গেছেন।’ আফসোস হলো সরারাত কাছে থাকলাম, শেষ মহূর্তে কিনা গেলাম বিশ্রাম নিতে।
মনকে সামলিয়ে প্রথমে টেলিফোন করলাম কনু আপাকে, জানালাম জরিনা বুবু আর নেই। আপনি আসুন। তিনি জানালেন, আসছি। সেজ ভাই আলমগীরকে, জাহাঙ্গীর ভাইকে, বড় ভাইকে, একে একে সব ভাইবোনকে জানালাম। কনু আপা এলেন। এসেই তিনি আলমগীরকে টেলিফোনে বললেন, ওনার মাটি হবে আমদের বাড়িতে মসজিদসংলগ্ন নতুন কবরস্থানে। ভাই-বোন সবাই এ ব্যাপারে একমত হলেন। আমার ছেলে শামিম তাঁকে ধোয়াবার ও কাফনের ব্যবস্থা করল। বড় ছেলে তসলীম (অধ্যাপক ও এ্যাসিসট্যান্ট প্রক্টর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলমালের কারণে রাতে বাড়ি ফিরতে পারেনি। সেখান থেকে বেরুনো বেশ মুশকিল ছিল।
সে এক ফাঁকে পারমিশন নিয়ে এসে দেখে গেল। তার বউ আন্তর্জাতিক সংগঠনে কাজ করে, সেখান থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলো। আমরা পাঁচটা গাড়িতে করে চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার গুলবাহার গ্রামে রওনা হলাম। লাশ নেয়া গাড়ির ব্যবস্থা আলমগীর করেছিল। আলমগীরের নির্দেশে আমরা সকল ভাইবোন বেলা ১১টায় আমাদের বাসায় একত্রিত হলাম। গাড়িতে লাশ তোলা হলো। লাশের গাড়িতে পতাকা লাগানো হলো। আমরা একে একে গাড়িতে উঠলাম। সবাই চলছি গুলবাহারের পথে, সঙ্গে যাচ্ছে জরিনা বুবুর লাশ।
খুব দ্রুত আমরা এগোলাম। পথে যানজট বা ঝামেলা হলো না, তবে কচুয়া উপজেলায় গাড়ি ঢোকার পরÑকে মারা গেছেন? মন্ত্রী সাহেবের কে হন? ইত্যাদি প্রশ্ন পরিচিত এলাকাবাসীর মুখে। আমার ভাই সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জানালেন, আমাদের বড় বোন সমতুল্য জরিনা বুবুর লাশ। তাঁর দাফনের জন্য গুলবাহার যাচ্ছি। গুলবাহার গিয়ে পৌঁছলাম সম্ভবত দেড়টায়। আগের থেকে ভাই আলমগীর কবর তৈরির ব্যবস্থা টেলিফোনের মাধ্যমে করে রেখেছিল।
আমরা পৌঁছার পর সুলতানা বিল্ডিংয়ের সামনে লাশ রাখা হলো। বাড়ির আত্মীয়স্বজন এক নজর দেখলেন। তাঁকে নিয়ে পুরনো স্মৃতিচারণ করলেন। এরপর জানাজার জন্য স্কুলের মাঠে মসজিদের কাছে নেয়া হলো। দলে দলে লোক আসতে শুরু করল। বিশাল জানাজা হলো। আমাদের ভাই আলমগীর সকলের কাছে বিশেষ করে মুরব্বিদের কাছে তাঁর জন্য দোয়া চাইলেন। রেওয়াজ মতো মাফ করে দেয়ার অনুরোধ করলেন। এরপর খাটিয়া কাঁধে নিয়ে আমার ভাইরা ও ছেলেরা তাঁকে কবরস্থানে নিল।
মসজিদের পাশেই কবরস্থান। তাকে সমাহিত করা হলো। আমরা কান্নাকাটি করলাম, মন ভারাক্রান্ত। খাওয়া- দাওয়ার পর বিকেলে রওনা হয়ে রাতেই ঢাকায় ফিরলাম। ঢাকার নিজ ফ্ল্যাটে পৌঁছে জরিনা বুবুর বিছানাটা দেখে বুকটা মুষড়ে উঠল ব্যথায়। ৪২ বছরের সহচরী আপন মানুষটি আর নেই। ম্যাট্রিক পাসের পর আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরি, বিদেশে উচ্চ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ সব করতে পেরেছি জরিনা বুবুর জন্য। বিয়ের পর বাচ্চাকাচ্চা সামলানোর জন্য আম্মা-আব্বা জরিনা বুবুকে আমার কাছে পাঠান। তারপর বিয়াল্লিশ বছর আমার সংসার ও ছেলেপুলে তিনি সামলিয়েছেন। আমার জীবনযুদ্ধে জয়লাভের প্রধান সহায়তাকারী ছিলেন তিনি। ছোট ছেলেটিকে বিলেতে পড়াকালীন তিনিই দেখাশোনা করেছেন। সে জন্য ছোট ছেলে তামিম প্রায় বলত জরিনা খালাই আমার আসল মা, আম্মা তো আমাকে দশ মাসের রেখে বিদেশে পড়তেই চলে গেলেন। আম্মা তো শক্ত।
জরিনা বুবু শুধু আমাদের পরিবার ও ছেলেপুলেকে সেবা দেননি। আমার আব্বা-আম্মার পরিবারে আমাদের আট ভাই-বোনকে কোলে করে বড় করেছেন। আমাদেরকে গল্প শুনিয়েছেন, খাইয়েছেন, আমাদের সঙ্গে লুডু ও কার্ড খেলেছেন। অসুখ-বিসুখ হলে আম্মার সঙ্গে রাত জেগেছেন। নিঃস্বার্থভাবে সেবাযতœ করেছেন। আমাদের ছেলেমেয়েদেরও যতœ করেছেন।
আমাদের সবার বড় আপার ছোটবেলায় তাকে আনা হয়েছিল ছোট্ট পরিচর্যাকারী হিসেবে। আমরা একে একে আরও সাত ভাইবোন জন্মালাম। আমাদের বিয়েশাদি হলো। ছেলেপুলে হলো। সবাই ওনার হাতের ওপর দিয়ে। ওনার বয়সকালে জায়েদ আলী বাবুর্চি ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়। সন্তান হয়। ছোটবেলায় সে সন্তান মারা যায়। জায়েদ আলী ভাই তাকে নিয়ে বাড়িতে আলাদা সংসার গড়তে চেয়েছিলেন। আমাদেরকে ফেলে জরিনা বুবু যাননি। পরবর্তীতে জায়েদ আলী ভাই বাবুর্চির কাজ করতে মক্কা শরীফ চলে যান। তিনি আর ফিরেননি।
আর জরিনা বুবু তার সকল স্নেহ-ভালবাসা, মায়া-মমতা দিয়ে আমাদের বড় করলেন। আমাদের সন্তানদেরও। এরপর বিশেষভাবে আমার সংসার টেনে আমাকে ক্যারিয়ার উইমেন হতে সহায়তা করলেন। এ ঋণ আমি শোধ করব কি দিয়ে। আমরা সকল ভাইবোন তার ঋণপাশে আবদ্ধ। তাঁর এই সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা পরিবার-পরিজন, ভাই-বোন, ছেলেপুলে সকলেই তাঁকে জানাচ্ছি অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা। তিনি নেই তাঁর স্মৃতি রয়েছে আমাদের মাঝে।

নীলুফার বেগম
সাবেক যুগ্ম সচিব

No comments

Powered by Blogger.