অধ্যাপক রব্বানী ॥ বায়োমেডিক্যাল ফিজিক্সে স্বপ্ন পূরণের দিশারী by ইব্রাহিম নোমান

ডায়াবেটিস রোগীদের স্নায়ুবিক বৈকল্য থাকার ফলে পায়ের নিচে ব্যথা সে বুঝতে পারে না ফলে পায়ের নিচে আলসার হয়, ক্রমে তা গ্যাংগ্রিনে পরিণত হলে পুরো পা টিই কেটে ফেলতে হয়। এর প্রতিকারে জন্য ভাল থাকা অবস্থায় পায়ের নিচে চাপ পরিমাপ করার জন্য পেডোগ্রাফ নামে একটি বিদেশী যন্ত্রের দাম প্রায় ৫০ লাখ টাকা।


অধ্যাপক রব্বানীর অন্যান্য উদ্ভাবনের ওপর বক্তৃতা শুনে করাচীর একটি হাসপাতালের এক গবেষক- ডাক্তার এ যন্ত্রটি স্বল্প মূল্যে তৈরি করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন তাকে। এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নও করেন তারা। কয়েকজন তরুণকে সাথে নিয়ে এক বছরের মধ্যে একটি পেডোগ্রাফ তৈরি করে করাচীর ওই হাসপাতালে লাগিয়ে দেন, দু’বছর ধরে নিয়মিত তা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আরও ৫টি পেডোগ্রাফ তৈরি করে দেয়ার জন্য তারা সম্প্রতি অনুরোধ করেছেন। প্রতিটিতে খরচ অবিশ্বাস্যভাবে কম মাত্র ৩ লাখ টাকা।
প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে আকর্ষণীয়ভাবে স্থান করে নিয়েছে কার্জন হল ভবনে আয়োজিত বায়োমেডিক্যাল ফিজিক্স এ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের গবেষণা প্রদর্শনী। পরপর ৩ বছর এ আয়োজন করল এ বিভাগটি। দেশের সাধারণ মানুষের অর্থে চালিত বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ মানুষের জন্য কি করতে পারে তার একটি সুন্দর উপস্থাপন ছিল এ প্রদর্শনীটি। পিএইচডি গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ২০০৮ সালে স্থাপিত নতুন এ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বিভাগের উদ্ভাবিত চিকিৎসা পদ্ধতি, প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ইতোমধ্যেই দেশের গ-ি ছাড়িয়ে উন্নত বিশ্বসহ বহির্বিশ্বেও ছড়াতে শুরু করেছে।
অধ্যাপক রব্বানীর সাথে কাজ করছেন প্রায় ১৮ তরুণ। যাদের মধ্যে ১২ জন ঢাকা ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইডডি ও এমফিল ডিগ্রির জন্য ভর্তি হয়েছেন। মেলায় প্রদর্শিত যন্ত্রপাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কম্পিউটার ও ইন্টানেটভিত্তিক টেলিমেডিসিন প্রকল্প, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে সামনে রেখে যা তৈরি করা হয়েছে। এতে রয়েছে স্টেথোস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ, এক্স-রে, ভিউ বক্স ও ১২- লিড ডায়াগনস্টিক ইসিজিÑপ্রতিটিই ডিজিটাল প্রযুক্তির এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের রোগীরদের গায়ে লাগানো হলে তার ফলাফল সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবে শহরের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে, যিনি তা দেখে রোগ নির্ণয় করে গ্রামে প্রেসক্রিপশন পাঠিয়ে দেবেন সঙ্গে সঙ্গে। প্রতিটির হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার নিজেদের তৈরি বা অন্যান্য সহজলভ্য যন্ত্রপাতি মিশিয়ে তৈরি করা। ইতোমধ্যে ইসিজি যন্ত্রটি সরকারী হৃদরোগ হাসপাতালের ডাক্তারদের অনুমোদন পাওয়া পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ চারটি যন্ত্রসহ টেলিমেডিসিন ব্যবস্থার একটি সিস্টেম নিয়ে মাঠ পর্যায়ে ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি প্রদর্শিত হয়েছে ডিজিটাল ও অপটিক্যাল কলপোস্কোপ, মহিলাদের জরায়ুমুখ ক্যান্সার নির্ণয়ে খুবই প্রয়োজনীয় একটি যন্ত্র এটি। এর প্রতিটি যন্ত্রই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে বিদেশী যন্ত্রে থেকে অনেক কম দামে দেয়া যাবে। তা ছাড়া দেশের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রযুক্তি থাকায় এসব যন্ত্র থেকে সেবা পাওয়া যাবে যুগের পর যুগ, বিদেশী যন্ত্রে যা অকল্পনীয়। পানীয় পানির জন্য সূর্যের আলোতে পানিকে জীবাণুমুক্ত করার এবং বৃষ্টির পানি বেশি করে সংগ্রহ করার জন্য কম খরচে কিছু সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন অধ্যাপক রব্বানী প্রায় দু’যুগেরও আগে বাঁশের ডালা, খড়, পলিথিন শিট, পলিথিন ব্যাগ এগুলো ব্যবহার করে। এ পদ্ধতিগুলোকে প্রয়োজনে আরও সহজ ও উন্নত করে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে বিভাগটি। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে বন্যার পানিকেই জীবাণুমুক্ত করে পান করা যেতে পারে, যা তৈরি করা যাবে। কলাগাছের ভেলার উপরেই অথবা যে কোন শুকনো জায়গায়। এ পদ্ধতিতে পানিতে আর্সেনিকের সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে খুব সহজেই। কারণ নদী-নালা, পুকুর বা বন্যার পানিতে আর্সেনিক নেই, কেবল রযেছে রোগ-জীবাণু আর রোগ জীবাণু ধ্বংস করা যায় খুব সহজেই, উপরের পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে। রোগ জীবাণু যে এ পদ্ধতিতে ধ্বংস হচ্ছে তারও পরীক্ষার ফলাফল দেখানো হয়েছে প্রদর্শনীতে। আবার লবণাক্ত এলাকার পানি কম খরচে পাতন করে বিশুদ্ধ করার একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করার পথে আছে বিভাগটি। সে যন্ত্রটিও প্রদর্শিত হয়েছে। সে পেডোগ্রাফের একটি প্রাথমিক যন্ত্রও ছিল প্রদর্শণীতে। অনেক দর্শনার্থীই তাদের পায়ের চাপ পরীক্ষা করেন এ যন্ত্র ব্যবহার করে। এছাড়া ছিল অধ্যাপক রব্বানীর উদ্ভাবন ফোকাস্ড ইম্পিড্যান্স মেথড বা এফআইএম যা ব্যবহার করে জরায়ুমুখ ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, নিউমোনিয়া, ইত্যাদি রোগ নির্ণয় এবং ফুসফুস ও পাকস্থলীর কার্যকারিতা নির্ণয় ইত্যাদির জন্য দলটি গবেষণা করছে। এর জন্য উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতিও প্রদর্শিত হয়েছে। এ প্রযুক্তিটির সম্ভাবনা দেখে সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, নরওয়ে এবং কোরিয়ার তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ও গবেষণা শুরু করেছে। প্রদর্শণীতে দেখানো আর একটি আবিষ্কার হচ্ছে স্নায়ুবৈকল্য পরিমাপে ডিস্ট্রিবিউশন অব এফ-লেটেন্সি বা বিএফএল নামে একটি নতুন পদ্ধতি, যার মাধ্যমে হাত-পায়ের স্নায়ুর ভেতরের অজস্র স্নায়ু-আঁশের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানা যায়। এ তথ্য নির্ভুলভাবে জানার জন্য ক্লিনিকে ব্যবহারোপযোগী আর কোন পদ্ধতি পৃথিবীতে নেই। প্রথাগত যন্ত্র ব্যবহার করেই এ পরিমাপ করা যায়। এ দলটি ডিএফএলের সাহায্যে ঘাড়ে ও কোমরে ব্যথা হবার যে স্নায়ুজনিত কারণ তা খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করার পদ্ধতি বের করেছেন। যুক্তরাজ্যে এবং সিঙ্গাপুরে এ পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে।
এ ছাড়া প্রদর্শনীতে আরও যা ছিল তার মধ্যে রয়েছে একটি কৃত্তিম হাত। যেটি স্প্রিংয়ের সাহায্যে বুড়ো আঙুলটি নাড়িয়ে জিনিসপত্র ধরতে পারে। ফলে খুব অল্প খরচে কিছুটা ব্যবহারোপযোগী একটি হাত পেয়ে যাবে হাত না থাকা রোগীরা। আর একটি প্রদর্শনী ছিল রক্তে অক্সিজেন পরিমাপক যন্ত্র। এটি স্থানীয়ভাবে উন্নয়ন করার পর্যায়ে রয়েছে। আরও ছিল সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাইবিটের তৈরি অতিরিক্ত হাত-পা ঘামের চিকিৎসা যন্ত্র ‘এ্যান্টি সোয়েট’ যা কয়েক শ’ রোগী বাড়িতে ব্যবহার করে সুস্থ থাকছেন বহু বছর ধরে। আরও ছিল স্নায়ুবৈকল্য চিকিৎসার যন্ত্র ‘মাসল এ্যান্ড নার্ভ স্টিমুলেটর’ যা বিএসএমএমইউ’র ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগ ছাড়াও দেশের অনেক ফিজিওথেরাপিস্ট বহু বছর ধরে ব্যবহার করছেন।
তৃতীয় বিশ্বে বাস করা পৃথিবীর ৮০% মানুষ আধুনিক চিকিৎসা উপকরণের সুযোগ বঞ্চিত। উন্নত বিশ্বকেন্দ্রিক প্রযুক্তি উন্নয়ন ও ব্যবসায়িক ব্যবস্থা এ বিষয়ে নিদারুণভাবে ব্যর্থ। তৃতীয় বিশ্বের প্রতি দেশে নিজস্বভাবে এসব প্রযুক্তি উন্নয়ন করে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় সহজলভ্য করে পৌঁছে দেয়াটাই এর সমাধানÑএ উপলব্ধির ওপর ভিত্তি করে এ বিভাগের স্থাপক-চেয়ারপার্সন অধ্যাপক খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তার উদ্ভাবন ও অধ্যবসায়ে আকৃষ্ট হয়ে এক ঝাঁক তরুণ শিক্ষার্থী নতুন এ বিভাগে তার সঙ্গে যোগ দিয়ে কর্মকা-কে স্বল্প সময়ে অনেকদূর এগিয়ে নিতে পেরেছেন। প্রযুক্তিগুলো মাঠ পর্যায়ে সফলতা লাভ করলে পরে দেশের ও অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের প্রযুক্তিবিদ ও প্রকৌশলীদেরও এসব প্রযুক্তির জ্ঞান, কলাকৌশল, এমনকি বাণিজ্যিভাবে উৎপাদন করে বাজারজাতকরণও শিখিয়ে দেয়া হবে। যার যার দেশে গিয়ে এসব যন্ত্রপাতি বানিয়ে তার দেশের জনগণের কাছে যেন সুলভে পৌঁছে দিতে পারে তার জন্য এ উদ্যোগ নেয়া হবে। এ পথেই পৃথিবীর বঞ্চিত ৮০% মানুষের কাছে আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছবেÑএটিই এ বিভাগের কর্মরত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস।

No comments

Powered by Blogger.