তৃণমূল মানুষের প্রকৌশলী by মোঃ শহীদুল হাসান

বাংলাদেশে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং এলজিইডির রূপকার ও প্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু তার অমর কীর্তি রয়ে গেছে। রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় এলজিইডি কমপ্লেক্সে বহুতলবিশিষ্ট নান্দনিক ভবন দুটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে তার মনন ও সৃজন প্রতিভার সাক্ষ্য দিচ্ছে।


আমাদের কাঁদিয়ে ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন শ্রদ্ধেয় কিউআই সিদ্দিক। ১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি কুষ্টিয়া শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। তিনি ১৯৬৬ সালে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক এবং ১৯৭৭ সালে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবান ও রিজিওনাল প্লানিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬৭ সালে কামরুল ইসলাম সিদ্দিক কুষ্টিয়া জেলা বোর্ডে পূর্ত কর্মসূচি শাখায় সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে শত্রুর সঙ্গে লড়াই করেন। স্বাধীনতার পর খুলনা মিউনিসিপ্যলিটিতে পূর্ত কর্মসূচির নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে বদলি হন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পূর্ত কর্মসূচি সেল গঠিত হলে জনাব সিদ্দিক সেখানে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন। ১৯৭৬ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে যান এবং পরের বছর সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে কিছুদিন পর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পান। পরে উপ-প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে সেলের প্রধান হন। এখন সচিবালয় গেটের যেখানে স্ক্যানিং মেশিন কক্ষ, সেখানে তখন সেমি-পাকা টিনশেড ছিল। পশ্চিমদিকের কক্ষটিতে বসতেন কিউআই সিদ্দিক।
তখন গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ বাস্তবায়ন হতো পূর্ত কর্মসূচির আওতায়। এ জন্য জেলা পর্যায়ে নির্বাহী প্রকৌশলী ও থানা পর্যায়ে উপ-সহকারী প্রকৌশলীসহ কারিগরি লোকবল বার্ষিক সংরক্ষণের ভিত্তিতে কর্মরত ছিল। আমিও এই অস্থায়ী লোকবলের একজন হয়ে ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে ফরিদপুর জেলা বোর্ডে পূর্ত কর্মসূচির নির্বাহী প্রকৌশলী পদে যোগদান করি। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক তখন বিদেশে। ওই বছর সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে এলে তার সঙ্গে দেখা করতে সচিবালয়ের সেই সেমি-পাকা টিনশেডে উপস্থিত হলাম। প্রথম আলাপেই মনে হলো তিনি মেধাবী ও সদালাপী। বললেন, এসেছো ভালো হয়েছে। অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠিত ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের চাকরি স্থায়ী কাঠামোতে এনে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিপণনের প্রসার করতে হবে। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে ইত্যাদি। প্রথম আলাপেই উপলব্ধি করতে পারি তার বিরাট পরিকল্পনার কথা।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে মনোনিবেশেও দেরি করেননি কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। কেবল কথা বলে বসে থাকার লোক তিনি ছিলেন না। প্রথমেই সচিবালয়ের ভেতরের টিনশেড থেকে পূর্ত কর্মসূচি সেলের সদর দফতর লালমাটিয়ায় বি-ব্লকে ভাড়া ভবনে স্থানান্তর করেন। এ ছিল আমাদের জন্য বিরাট প্রাপ্তি। তার প্রচেষ্টাতেই ১৯৮২ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও বিকেন্দ্রীকরণকালে সরকার পূর্ত কর্মসূচির বিভিন্ন স্তরে কর্মরত লোকবল একক কাঠামোয় আনতে পূর্ত কর্মসূচি উইং সৃষ্টি করে। কিন্তু অন্যান্য সংস্থার সামঞ্জস্য না হওয়ায় এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তিনি না দমে গিয়ে রাজস্ব খাতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর নামে একটি স্থায়ী সংস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৯৮৪ সালে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেন এবং রাজস্ব খাতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল ব্যুরো বা এলজিইবি নামে স্বতন্ত্র সংস্থা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। তিনি প্রথম নির্বাহী প্রধান। নবগঠিত এলজিইবিকে দেশ-বিদেশে পরিচিত করার পাশাপাশি স্থানীয় উন্নয়নে এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে থাকেন। ব্যুরোকে অধিদফতরে রূপান্তরেও কাজ করতে থাকেন। নবসৃষ্ট সংস্থার সদর দফতর নির্মাণে আগারগাঁওয়ে জমি আদায়ও করেন। ভবনটি ১৯৯৬ সালে সম্পন্ন ও ১৯৯৭ সালে উদ্বোধন হয়। ১৯৯৬ সালের মধ্যে সব জেলায় নিজস্ব অফিস ও বাসভবন কমপ্লেক্স নির্মাণ সম্পন্ন হয়। তারও আগে, ১৯৯২ সালে ব্যুরোর মর্যাদা বৃদ্ধি করে প্রতিষ্ঠিত হয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর। প্রথম প্রধান প্রকৌশলী হন তিনিই।
সবাই জানেন, এলজিইডি গ্রামীণ যোগাযোগ ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়নে কী বিপ্লবের সূচনা করে। ১৯৯৯ সালের মে পর্যন্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। অধিদফতরটি পাবলিক সেক্টর এজেন্সি দিয়ে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের মডেলে পরিণত হয়। তার নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, সুইডিশ সিডা, ইউএসএইড, কানাডিয়ান সিডা, আইএলও, ইউএনডিপি, ডবি্লউএফপি, ডিফিড, ডানিডা, নোরাড, জাইকা, ওপেক তহবিল, আইডিবি, ইফাদ প্রভৃতি উন্নয়ন সহযোগীর আগ্রহ ও আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়।
কামরুল ইসলাম সিদ্দিক যখনই বিদেশে গিয়েছেন, খুঁজেছেন বাংলাদেশে প্রয়োগ-উপযোগী প্রযুক্তি। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম রাবার ড্যাম প্রবর্তন করেন। ১৯৮২ সালে পূর্ত কর্মসূচি উইংয়ের লালমাটিয়াস্থ সদর দফতরে দুটি আইবিএমপিসি-২ ব্রান্ডের পারসোনাল কম্পিউটার দিয়ে তিনিই বাংলাদেশে সরকারি অফিসে প্রথম ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রয়োগ শুরু করেন। তিনি উপজেলাভিত্তিক বেজম্যাপ প্রস্তুতের কাজ হাতে নেন এবং ১৯৯২ সালের মধ্যে রঙিন ও সাদা-কালো বেজম্যাপ প্রত্যেক উপজেলা প্রকৌশলীর দফতরে পেঁৗছে দেন। তিনি মানচিত্রটিকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। ১৯৯০ সালে তিনি ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করে এলজিইডিতে তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন।
কিউআই সিদ্দিকী ক্ষুদ্রাকার পানিসম্পদ প্রকল্প প্রণয়ন, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় পাউবোর সঙ্গে বিরোধের অবসান ঘটিয়ে এলজিইডির অধিকার নিশ্চিত করেন। এলজিইডিতে স্থাপন করেন সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট।
স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী ও দক্ষ করতে উদ্যোগী ছিলেন কিউআই সিদ্দিক। তিনি উপলব্ধি করেন যে ইউনিয়ন পরিষদকে অধিকতর কার্যকর করতে হলে দরকার স্থায়ী অফিস। তিনি ইউনিয়ন পরিষদ ভবন বানিয়ে সেখানে ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত সব বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে একত্রে বসানোর চিন্তা করেন। এ লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে দোতলা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের নকশা ও মডেল তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যান। ১৯৯৮ সালে প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন লাভ করে।
১৯৯৯ সালের মে মাসে কিউআই সিদ্দিককে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০০ সালের প্রথমদিকে তিনি পূর্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। ২০০১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অবসর প্রস্তুতি ছুটিতে যান। 'গ্গ্নোবাল ওয়াটার পার্টনারশিপের' বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন কিউআই সিদ্দিক। এলজিইডির 'আরডিইসি' ভবনের পঞ্চমতলায় ওয়াটার পার্টনারশিপের অফিসের জন্য জায়গা দেওয়া হয়।
২০০৮ সালের ১১ আগস্ট রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত তিনি ওই অফিসে ছিলেন। পরদিন ওয়াটার পার্টনারশিপের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সুইডেন যাবেন। ২৭ আগস্ট আমার এলপিআরে যাওয়ার দিন। এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে শেষবারের মতো স্যারের সঙ্গে দেখা করতে রাত সাড়ে ৯টার দিকে তার অফিসে যাই। কে জানত সেটাই হবে জীবনের শেষ দেখা! ১ সেপ্টেম্বর দুপুরে সহকর্মীর ফোনে স্যারের মৃত্যুসংবাদ জেনে স্বজন হারানোর বেদনায় আমি নীল হয়ে গেলাম।
নিরহঙ্কারী এই মানুষটি চিন্তা-চেতনায় ছিলেন প্রগতিশীল। মূল্যবোধ ও বিশ্বাসে কল্যাণকর প্রায় সবকিছুই ধরে রেখেছিলেন জীবনাচরণে। পরমতসহিষুষ্ণতা ছিল তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সংবেদনশীল মনের এ মানুষটি কর্তব্যে অবহেলাকে কখনও প্রশ্রয় দেননি। অধীনদের কর্মশিথিলতার কারণে কখনও কখনও কঠোর হয়েছেন; কিন্তু হৃদয় ছিল কোমল। তিনি ছিলেন সবার ভক্তি ও ভালোবাসার পাত্র।

স মোঃ শহীদুল হাসান : এলজিইডির প্রাক্তন প্রধান প্রকৌশলী
 

No comments

Powered by Blogger.