গোলাম আকবর চৌধুরীর ৮২তম জন্মদিন- শ্রদ্ধাঞ্জলি

আজ ১ সেপ্টেম্বর, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও রাজনীতির নেপথ্য মানুষ গোলাম আকবর চৌধুরীর ৮২তম জন্মদিন। ১৯৩১ সালের এই দিনে তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার মাদার্শা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষত আওয়ামী লীগের উত্থান ও বিকাশে একজন নেপথ্য সংগঠক হচ্ছেন গোলাম আকবর চৌধুরী।


ছাত্র অবস্থায়ই পূর্ব বাংলার স্বাধিকার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধকালে এবং স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অন্যতম নীতি নির্ধারকের ভূমিকা পালন করেন। এতসব অবদান সত্ত্বেও তিনি থেকে গেছেন নেপথ্যে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করে জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে তিনি আজও বিরামহীন সৃষ্টিশীল কলাম লিখে চলেছেন। গোলাম আকবর চৌধুরী অনেক কিছু সৃষ্টি করেছেন, অনেক কিছুকেই পুনর্জন্ম দিয়েছেন কিন্তু কখনই সেসব কিছুর স্রষ্টা হিসেবে নিজেকে দাবি করেননি। তাঁর এই নিঃস্বার্থ পথচলায় কোন ক্লান্তি ও আলস্য নেই। অর্থ, খ্যাতি বা পদ কোন কিছু পাওয়ার আকাক্সক্ষা নেই। নদীর দুরন্ত প্রবাহের মতো তিনি নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছেন। জাতীয় জীবনের এমন কোন তাৎপর্যপূর্ণ ও স্মরণীয় ঘটনা নেই যার সঙ্গে গোলাম আকবর চৌধুরীর সম্পৃক্ততা নেই। ১৯৪৬ সালের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদান করে তিনি ছাত্র অবস্থায় রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের সদস্যপদ লাভ করেন এবং ১৯৪৯ সালে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। মহান ভাষা আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯৫২ সালে গোলাম আকবর চৌধুরীর সভাপতিত্বে গঠিত চট্টগ্রাম সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হয় এবং ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করে। ১৯৫৪ সালে তিনি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বর্তমানে সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের সভাপতি ম-লীর সিনিয়র সদস্য ও সংসদ উপনেতা। ১৯৫৮ সালে গোলাম আকবর চৌধুরী লায়ন্স আন্দোলনের সূচনা করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধেই তিনি ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি লাভের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সার্বক্ষণিক যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং দেশের বহু স্থানে তিনি তার সফরসঙ্গী হন।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুমন্ত বাঙালীদের ওপর এক নিধনযজ্ঞ শুরু করে। লাখ লাখ মানুষকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। ২৭ মার্চ ভোরে কারফিউ প্রত্যাহারের পর প্রথমেই গোলাম আকবর চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর বাড়ি যান তাঁর পরিবার-পরিজনের খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে সামরিক বাহিনীর একটি দল বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে থাকে এই সময় জনাব চৌধুরী অত্যন্ত সুকৌশলে তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে প্রাণে বেঁচে আসেন। তারপর ৩০ জুন সপরিবারে তিনি কলকাতা পৌঁছেন। পার্ক সার্কাসের সামনে যে বাড়িতে তিনি ছিলেন সেখানে মুজিবনগর সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থাকতেন। কিছুদিন পর মুজিবনগর সরকারের কয়েকজন কর্মকর্তা তাঁকে অনুরোধ জানালেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নিকট তিনি যেন সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের পরামর্শ দেন। তিনি সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিবেদনটি পড়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান। প্রতিবেদন দাখিল করার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রবাসী সরকার সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে। বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করে তাজউদ্দীন গোলাম আকবর চৌধুরীকে পাঠান মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরীর কাজে। তিনি তাঁকে সদস্য হিসেবে যোগদানের কথা বলেন। তিনি কিছুদিন পরিকল্পনা সেলে কাজ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে তিনি টিসিবির পরিচালক পদে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক ও তাঁর পরিবারের বহু সদস্যকে হত্যার মাত্র কয়েকদিন পর অর্থাৎ ২২ আগস্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ পিও-৯-এর আদেশ বলে তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন কারণ তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ জন।
১৯৭৬ সালের ২৬ আগস্ট আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তখন তাঁর স্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয় মহীউদ্দিন আহমদকে। ২৯ নভেম্বর ১৯৭৬, সাজেদা চৌধুরী ও আব্দুল মালেক উকিলসহ অনেকে কারারুদ্ধ হন। মহীউদ্দিন আত্মগোপন করেন। এ সময় দলের রক্ষণশীল নেতারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দখলের চেষ্টা করে। মূলত জনাব চৌধুরীর উদ্যোগে তা ব্যর্থ হয় এবং তারই প্রচেষ্টার ফলে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালের ১৪-১৫ ফেব্রুয়ারি ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচনের ব্যাপারে ঐকমত্য না হওয়ায় দলের ভাঙ্গন অবধারিত হয়ে পড়ে। দলের এ দুঃসময় জনাব চৌধুরী মুক্তিদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁরই উদ্যোগে ও অসামান্য রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। শুধু তাই নয় শেখ হাসিনা সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর অনেক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন কিন্তু চৌধুরী সাহেবের অসামান্য কূটনৈতিক কৌশলের কারণে ষড়যন্ত্রকারীদের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
জনাব চৌধুরী একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। তিনি নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকায় লিখে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চার। গ্রন্থগুলো হচ্ছেÑ
১. বাংলাদেশের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা।
২. বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন স্বাধীনতা ও আজকের বাংলাদেশ।
৩. বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু।
৪. চড়ষরঃরপং রহ ইধহমষধফবংয ধহফ ঃযব জড়ষব ড়ভ অধিসর খবধমঁব.
গোলাম আকবর চৌধুরীর ৮২তম জন্মদিন শুভ হোক। তিনি যেন দীর্ঘজীবী ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হন সেই কামনাই করি।

No comments

Powered by Blogger.