প্রসঙ্গ ইসলাম- রমাদান সিয়াম তাকওয়া by অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

রমাদান আরবী চান্দ্র সনের নবম মাস। এই মাসে সিয়াম পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু আর আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু রমাদান মাসব্যাপী প্রতিদিন সুবিহ সাদিকের পূর্ব মুহূর্ত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে দৃঢ় সঙ্কল্পের সঙ্গে বিরত থাকতে বিধান নাযিল করেছেন।


এই সিয়াম বিধান নাযিল করার মূল লক্ষ্য হচ্ছেÑতাকওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়া।
তাকওয়া হচ্ছে মানব জীবন কলুষমুক্ত রাখার এক শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। তাকওয়াই হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের কার্যকর উপায়। একজন সায়িম রমাদানের সিয়াম পালন করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম, আত্মপরিচয় এবং আত্ম উপলব্ধির প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ করেন।
৬২২ খ্রিস্টাব্দে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা মনওয়ারায় হিজরত করে আসেন। মদীনায় গড়ে ওঠে এক আদর্শ কল্যাণরাষ্ট্র। ইসলামের ইতিহাসে এই হিজরত এক নবদিগন্ত উন্মোচিত করে। ইসলামের শত্রু মদীনার ইয়াহুদী, মুনাফিক এবং মক্কার কুরায়শ মুশরিক জোটবেঁধে মদীনায় গড়ে ওঠা আদর্শ কল্যাণরাষ্ট্র এবং ইসলামকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা শুরু করে দিলো। মদীনার সীমান্তবর্তী এলাকায় এসে কুরায়শরা লুটতরাজ শুরু করে দিলো। তখনও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম সশস্ত্র যুদ্ধ করতে প্রয়াসী হননি; কেবলমাত্র পাহারার ব্যবস্থা করেছেন।
মদীনায় হিজরত করে এসে তিনি জানলেন, মদীনার ইয়াহুদীরা আশুরার সিয়াম পালন করে। তিনি তাদের ডেকে বললেন : তোমরা আশুরার সিয়াম পালন করো কেনো? তারা জানালো : এদিন নবী মূসা ফেরাউনের কারাগার থেকে ইসরাঈল সন্তানদের মুক্ত করে দরিয়া পাড়ি দিয়েছিলেন। তাই তিনি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আশুরাতে সিয়াম পালন করতেন। আমরা তাঁকে অনুসরণ করে আশুরার সিয়াম পালন করি। একথা শুনে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : তোমাদের চেয়ে মূসার উপর আমার অধিকার বেশি। এরপর তিনি ১০ মুহররমে আশুরার সিয়াম পালন করলেন। তাঁর অনুসরণ করে সাহাবায়ে কেরাম আশুরার সিয়াম পালন করলেন ৭ মাস পরে দ্বিতীয় হিজরীর ১৫ শা‘বান মুতাবিক ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে আল্লাহ জাল্লা শানুহু রমাদান মাসকে সিয়ামের জন্য নির্ধারিত করে সিয়াম বিধান নাযিল করলেন।
আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ওহে! তোমরা যারা ঈমান এনেছো! তোমাদের প্রতি সিয়াম বিধান দেয়া হলো। যেমন বিধান দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)। রমাদান মাস, যাতে নাযিল হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াত ও সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী আল-কুরআন। সুতরাং তোমাদের মধ্যে এই মাস প্রত্যক্ষ করবে তারা এতে সিয়াম পালন করবে (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)। এরপর শা‘বান মাসের শেষদিন সাঁঝেরবেলায় রমাদানের চাঁদ উদিত হলো। এই সময় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত সবার উদ্দেশে এক দীর্ঘ খুতবা দিলেন। হযরত সালমান ফারসী রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন : শা’বান মাসের শেষদিনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম আমাদের উদ্দেশে এক খুতবায় বললেন : হে মানুষ! তোমাদের ছায়া দিতে এক মহান মুবারক মাস আসছে। এই মাসে রয়েছে হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম রজনী। এই মাসের সিয়ামকে আল্লাহ্্ ফরয করে দিয়েছেন। এর রাতে দ-ায়মান হওয়াতে (তারাবীর সালাত আদায়ে) রয়েছে সওয়াব। যে ব্যক্তি এ মাসে আল্লাহর নৈকট্য লাভের লক্ষ্যে একটি নফল কাজ করবে, সে অন্য মাসে একটি ফরয আদায়ের সওয়াব পাবে, আর যে ব্যক্তি এই মাসে একটি ফরয আদায় করবে, সে অন্য মাসে সত্তরটি ফরয আদায়ের সমান সওয়াব লাভ করবে। এটা ধৈর্যের মাস আর ধৈর্যের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত। এটা সহমর্মিতার মাস। আর এটা হচ্ছে সেই মাস যাতে মু’মিনের রিয্্ক বৃদ্ধি করা হয়। এ মাসে কোন সায়িম (রোযাদার)-কে যে ব্যক্তি ইফ্্তার করাবে সে ব্যক্তির জন্য তা গোনাহ মাফ পাবার এবং দোযখের আগুন থেকে মুক্তি পাবার হেতু হয়ে যাবে। এছাড়া সে সায়িমের সমান সওয়াব পাবে, কিন্তু সায়িমের সওয়াব একটুও কমে যাবে না। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে অনেকেরই সায়িমকে ইফতার করানোর মতো সামর্থ্য নেই। তখন হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : পেট ভর্তি করে খাওয়াতে হবে তা তো নয়। আল্লাহ তা‘আলা তাকেই সওয়াব দান করবেন যে সায়িমকে এক চুমুক অথবা এক টুকরো খেজুর কিম্বা এক ঢোক পানি দ্বারা ইফ্্তার করাবে। আর যে ব্যক্তি কোন সায়িমকে তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়াবে আল্লাহ তাকে আমার হাউদ (হাউযে কওসার) থেকে পানি পান করাবেন, যার ফলে সে জান্নাতে দাখিল হওয়ার আগ পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত হবে না। এ এমন এক মাস যার প্রথম অংশ রহমতের, মধ্য অংশ মাগফিরাতের এবং শেষের অংশ দোযখের আগুন থেকে মুক্তির। আর যে ব্যক্তি এ মাসে চাকর-বাকরদের (অধীনস্থদের) কাজের ভার লাঘব করে দেবে আল্লাহ তা’আলা তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং দোযখের আগুন থেকে তাকে নাযাত দান করবেন (বায়হাকী, মিশকাত শরীফ)।
প্রথম সেই সিয়াম পালনের রমাদান মাসে এক নবতর উদ্দীপনায়, এক অনন্য আনন্দ অনুভবে মদীনা ভরপুর হলো, এমন অবস্থায় খবর এলোÑমদীনা আক্রমণ করার জন্য মক্কার কুরায়শ নেতা আবূ সুফিয়ান সিরিয়া থেকে ৫০,০০০ দিনার মূল্যের প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র কিনে ফিরছে। এই খবর পেয়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অস্ত্রের যুদ্ধ অস্ত্র দিয়েই প্রতিহত করা উচিত, কিন্তু অস্ত্রযুদ্ধ বা সশস্ত্র যুদ্ধের কোন নির্দেশ আল্লাহ জাল্লা শানুহু দেননি। এমন পরিস্থিতিতে সশস্ত্র যুদ্ধের নির্দেশ এলো। সেই নির্দেশনায় জিহাদের বদলে কিতাল শব্দটি দেখা যায়। আল্লাহ জাল্লা শানুহু কিতাল অর্থাৎ সশস্ত্র যুদ্ধের নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ করেন : উযিনা লিল্লাযীনা ইউকাতালূনা বি আন্নাহুম জুলিমুÑ সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে (সূরা হজ্জ : আয়াত ৩৯), কুতিবা ‘আলায়কুমুল কিতালÑ তোমাদের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের বিধান দেয়া হলো (সূরা বাকারা : আয়াত ২১৬)।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ মুতাবিক দ্বিতীয় হিজরীর ১১ রমাদান আবূ সুফিয়ানকে প্রতিরোধ করবার জন্য ৩১৩ জন সাহাবায়ে কেরামের সমন্বয়ে গঠিত মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে মদীনা মনওয়ারা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ৮০ মাইল দূরে অবস্থিত বদর প্রান্তরে এসে অবস্থান নিলেন। এই মুজাহিদ বাহিনীতে ২৫৩ জন আনসার ও ৬০ জন মুহাজির ছিলেন। ৬২৪ ক্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ মুতাবিক দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমাদান মক্কার বাছাই বাছাই লোকদের নিয়ে গঠিত ১০০০ সৈন্যের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ বেধে গেলো। তারাই প্রথমে আক্রমণ করল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের সেনাপতিত্বে অল্প সময়ের মধ্যে মুজাহিদ বাহিনী বিজয় পতাকা উড্ডীন করলেন। সিয়ামের মাস রমাদানে যখন সিয়াম পালন করছেন রিপুর সঙ্গে যুদ্ধ করে নফসের সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করে একই সময় বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া এবং সে যুদ্ধে কাফির-মুশরিকদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করা ইতিহাসে এক অনন্য যুদ্ধ হিসেবে রয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম শত্রুর সঙ্গে অস্ত্র দ্বারা যুদ্ধ করাকে ছোট যুদ্ধ বলেছেন আর নফসের সঙ্গে যুদ্ধ করাকে বড় যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করেছেন। নফ্সের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ সিয়ামের মাধ্যমে লাভ হয়।
সিয়ামের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করা যায়। সুবিহ্্ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহকারে যাবতীয় পানাহার, কামাচার থেকে বিরত থাকাটাই হচ্ছে সিয়াম। সিয়াম পালনের মাধ্যমে নফসকে সুপথে পরিচালনা করা সম্ভব হয়। হাদীস শরীফে আছে রমাদান মাসে জান্নাতের সব দরজা খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এই মাসে শয়তানকে শেকল দ্বারা বেঁধে রাখা হয়। সায়িম বা রোযাদার এই কথাগুলো থেকে সঠিক শিক্ষা লাভ সহজে করতে পারেন।
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (স.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

No comments

Powered by Blogger.