থানার নাম ভাষানটেক by ম. আনোয়ার হোসেন

ঢাকা শহরের ভাষানটেকের জনদুর্ভোগের নানা চিত্র তুলে ধরে ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে জনকণ্ঠে আমার একটা লেখা ছাপা হয়েছিল। সে লেখায় ঢাকা ডেন্টাল কলেজ (মিরপুর-১৪) থেকে ভাষানটেক পর্যন্ত একটি ওয়ানওয়ে রাস্তা নির্মাণের জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।


কাকতালীয়ভাবে সেটি প্রকাশিত হবার পর পরই উক্ত রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে যায়। অবশ্য আমি বলছি না যে আমার লেখা ছাপার পরই ১২০ ফুটের ওই রাস্তাটি নির্মিত হয়ে গেছে। এর ফলে ভাষানটেকের চেহারা পাল্টে যেতে থাকে। রাতারাতি মানুষ বাড়িঘর তৈরি করতে শুরু করে। এখন যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই বহুতল ভবন। রাস্তাঘাটেরও উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। আধুনিক দোকানপাট, চালের আড়ত, মার্কেট সবই হয়ে গেছে। সম্প্রতি ‘ভাষানটেক থানা’ ঘোষিত হয়েছে এবং কার্যক্রমও চলছে। এটি ডিজিটাল বাংলাদেশের সংযোজন। এর আগে ‘র‌্যাব’-এর অফিসও হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে এবং ভাল ফলও করছে। এছাড়া বেসরকারীভাবে একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটও চালু হয়েছে। কিন্তু পোস্ট অফিস, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ব্যাংক-বীমা বা অন্যান্য সরকারী-বেসরকারী অফিস এখনও হয়নি। অবশ্য ভাষানটেকের অবস্থা বহু পূর্ব থেকেই খারাপ।
প্রাচীনকালে বিশাল জনগোষ্ঠীর এই ভাষানটেকে কোন বাড়িঘর ছিল না। ১৯৬৫ সালের দিকে এখানে হাতেগোনা ৩০টির মতো বসতবাড়ি ছিল। চারদিকে ছিল শুধু পানি আর পানি। মানিকদী, মাটিকাটা, মিরপুর ইত্যাদি বিশাল এলাকায় পানিতে থই থই করত। নৌকাই ছিল একমাত্র যাতায়াতের বাহন। কৃষিকাজ ছিল মূল পেশা। মাছ ধরে বিক্রি করার পেশাও ছিল অনেকের। মৌজা ছিল জোয়ার সাহারা। কথিত আছে, ছোট ছোট টিলা/ভূখ- পানির ওপর ভেসে থাকত বলে এর নাম হয়েছে ভাষানটেক। তখন থানা ছিল সাতারকুল। সেটা ভেঙ্গে পর্যায়ক্রমে গুলশান, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, কাফরুল এবং পর বাড্ডা ও সবশেষে ভাষানটেক থানা গঠিত হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, সাতারকুল বলতে এখন আর কোন থানা নেইÑএটি বাড্ডার একটি জায়গার নাম হয়ে আছে। তার মানে গুলশান, বাড্ডা, ক্যান্টনমেন্টের আশপাশ, মিরপুর, কাফরুল এই বিশাল এলাকায় বাড়িঘর ছিল না বললেই চলে। নদীর মতো কেবল পানি আর পানি। স্বাধীনতার পরও মিরপুর-১৪ থেকে মানুষ নৌকায় ভাষানটেক, দেওয়ানপাড়ায় যাতায়াত করত। এই নৌকার পথটুকুই এখন ১২০ ফিটের ওয়ানওয়ে রাস্তা। কি যেন একটা হয়েছে! মানুষ ঘর থেকে বের হতো না। শ্মশানের মতো লাগত। রাস্তার দু’পাশের সব বন্ধ হয়ে যেত। যেন হরতাল ডাকা হয়েছে। চৈত্র বা ভরা বর্ষায় এর চিত্র আরও বেশি করে ধরা পড়ত। তবে বিকেল/সন্ধ্যা হলে চাঞ্চল্যতা দেখা যেত। এখানে সেখানে দু’একটা চায়ের দোকানে দূর থেকে কাপের শব্দ শোনা যেত। মুরুব্বীরা চা খেতে খেতে নানা গল্পে মজে থাকত। এভাবে দশটা বাজলে আবার আস্তে আস্তে সব বন্ধ হয়ে আসত। এটি ভাষানটেকের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নয়-অনেক কথা থাকতে পারে। তবে ১৯৬৫ সালে যেখানে বসতবাড়ি ছিল নগণ্য তার আগে জনমানবহীন জায়গায় কিইবা ইতিহাস থাকতে পারে। যতটুকু সম্ভব লেখার চেষ্টা করা হলো।
১৯৯৬ সালের পর থেকে ভাষানটেকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ উন্নত হতে থাকে। বাইরে থেকে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অভিজাত ফ্যামিলির লোকরাও আসতে শুরু করে। এখন ভাষানটেক ঘনবসতি। যেখান দিয়ে হাঁটা যাক পায়ে পায়ে বাড়ি খাওয়ার মতো। সকালে মানুষের ঢল নামে। চেহারা, পোশাক-আশাক দেখলে বোঝাই যায় এরা বড় বড় অফিসে যাচ্ছে। ভাল স্কুল, কলেজ কিংবা ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু রাস্তাঘাট যাই থাকুক, যানবাহনের অবস্থা খুবই করুণ। এখানে যাত্রিবাহী কোন বাস নেই। ‘মাই লাইন’ নামে একটি বাস সার্ভিস দীর্ঘদিন চালু থেকে অজ্ঞাত কারণে আবার বন্ধ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে আবার দেখাও যায়। কিন্তু খুবই করুণ। এখানে সিএনজি, রিক্সা, ট্যাক্সি ক্যাব, মিশুক একমাত্র অবলম্বন। ফলে জনসাধারণের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। মিরপুরম, ফার্মগেট, গুলিস্তান প্রভৃতি জায়গায় বাধ্যতামূলকভাবে খুব কষ্ট করে যেতে হচ্ছে। বর্ষায় কষ্টের সীমা থাকে না।
তাই এ থানায় এখনই দরকার যাতায়াতের জন্য একাধিক ভাল বাস সার্ভিস এবং ব্যাংক। এরপর হাসপাতাল, পোস্ট অফিস ও অন্যান্য অফিস। একটি থানায় এসব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এটি ছাপা হলে, কাকতালীয়ভাবে যদি আগের মতো বাস্তবে রূপ নেয় তাহলে এলাকাবাসী সত্যিই উপকৃত হবে। ভাষানটেক একটি আধুনিক থানায় হিসেবে গড়ে উঠুক এই প্রত্যাশা সকলের।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আনোয়ার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
পশ্চিম ভাষানটেক, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.