যৌতুক আন্তন চেখভ- অনুবাদ : আবু বকর সিদ্দিকী

জীবনে হরেক রকমের বাড়িঘর চোখে দেখেছি, ক্ষুদ্রাকার কিংবা বৃহদাকার, কাঠের কিংবা ইটের, নতুন বাড়িÑ পুরনো বাড়ি, তবে একটা বাড়ির ছবি আমার হৃদয়ের গভীরে দাগ কেটে আছে। অবশ্য বাড়িটাকে কুটির নামে অভিহিত করাটাই যুক্তিসঙ্গত হবে।
তিনটি জানালাযুক্ত একটা ক্ষুদ্রাকার কুটিরÑ দূর থেকে দেখলে মনে হবে, মাথায় টুপি পরিহিতা একজন কুঁজোবুড়ি দাঁড়িয়ে। বর্তমানে বাড়িতে বাসরত লোকজনের পিতা-প্রপিতামহদের লাগানো মালবেরী ঝোপ, আকাশমণি ও পপলার শোভিত সবুজ শ্যামলিমার মাঝে শুভ্রকায় আবাসস্থলটির টাইলের ছাদ এবং চিমনিটি জরাজীর্ণ। পত্রপল্লবের আধিক্যের কারণে বাসস্থানটি ঢাকা পড়েছে। এত শ্যামলিমার আবরণ সত্ত্বেও বাড়িটাকে শহুরে বলেই মনে হয়, পাশেই আছে প্রশস্ত সবুজ মাঠÑ যাতে একটা ছোট রাস্তাও সংলগ্ন। রাস্তাটা দিয়ে যদিও কিছু লোকজন যাতায়াত করে কোন ঘোড়ার গাড়ি দেখা যায় না বললেই চলে।
কুটিরের সমস্ত জানালাগুলো বন্ধ স্থায়ীভাবে, অধিবাসীদের আলোর কোন প্রয়োজন নেই। এমনকি তাদের কাছে মুক্ত বাতাসের প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়েছে। মালবেরী, আকাশমণি ও বুরডক বৃক্ষের ুশ্যামলীমায় বসবাসরত লোকজন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি উদাসীন। সৃষ্টিকর্তা শহরের লোকদেরই কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মূল্যায়ন শিখিয়েছে। বাকি সকল মানুষ যারা প্রকৃতি প্রদত্ত সৌন্দর্যের গভীরে ডুবে থাকে তারা এসবের মূল্যায়নে প্রকৃতই অবিদিত। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, যে সম্পদে মানুষের প্রাচুর্য্য তার মূল্যায়নে সে অসম্মত কিংবা ব্যর্থ।
কুটিরটির চারদিকে পার্থিব স্বর্গের ছড়াছড়ি। সেখানে আছে সবুজের আধিক্য আর পাখির কুজন অথচ এর অভ্যন্তরে কি দুরবস্থা। গ্রীষ্মের সময় অসম্ভব গুমোট আর শীতের সময় ভ্যাপসা দমবন্ধ গরমÑ অসহ্য।
অনেকদিন পূর্বে আমি প্রথমবারের মতো এ কুটিরে পদার্পণ করেছিলাম একটা কারণে। এ বাড়ির মালিক কর্নেল চিকামাসভের সুখবর বহন করে এনেছিলাম তার স্ত্রী ও কন্যার উদ্দেশে। ঘটনাটি আমার খুব স্পষ্টভাবে মনে আছেÑ যা ভুলে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব না।
ভেবে দেখুন, আপনি যখন বাড়ির বহিঃদরজা থেকে ভিতরের দিকে প্রবেশ করছেন তখন চল্লিশ বছরের একজন পৃথুলা ছোটখাটো মহিলা ভীতি-মিশ্রিত আশ্চর্য চোখে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। আপনি বহিরাগত একজন অচেনা যুবকÑ স্বভাবতই সে এভাবেই আপনার দিকে তাকাবে। আপনার হাতে কোন মুগুর কিংবা কুঠার নেইÑ না আছে কোন রিভলভার। মুখে আপনার বিনয়ী হাসি থাকলেও সতর্কতার সাথেই আপনাকে গ্রহণ করা হবে।

গৃহমাতা নিজেকে চিকামাসোভা বলে পরিচিতি দিয়ে কম্পিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন কার সাথে আপনি দেখা করতে চান?
আমি আমার পরিচয় ও আসার উদ্দেশ্য বলার সাথে সাথেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারাটাতে আনন্দের প্রকাশ দেখা দিলÑ সাথে সাথে, একটা আনন্দ ধ্বনি বেরিয়ে এলোÑ আহ, আর, সাথে চোখের ঘূর্ণন। তার আহ্ শব্দটা প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল বাড়ির বহিঃদরজা থেকে ভিতরের ঘরগুলোতে-ড্রইংরুম থেকে ভিতরে রুমে-সেখান থেকে রান্নাঘরে-ভাঁড়ার ঘরে-সমস্ত বাড়িটা ‘আহ’ শব্দে উদ্বেলিত। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ড্রইংরুমের নরম-উষ্ণ ডিভানে বসতে বসতে আমার মনে হতে লাগলÑ মস্কোর সমস্ত রাস্তাগুলোতে ‘আহ’ ধ্বনিটি ছড়িয়ে পড়েছে।
ঘরের ভিতর চেয়ারের ওপর রাখা রুমালে বাঁধা একজোড়া নতুন সোয়েল জুতার গন্ধের সাথে ন্যাপথালিনের গন্ধ মিলেমিশে নাকে প্রবেশ করছে। ফুলশোভিত মসলিন কাপড়ের পর্দা জানালায় ঝুলছে, যেখানে আশ্রয় নিয়েছে পুরুষ্ট মাছি সকল। দেয়ালে দেখা যায় একজন আর্চবিশপের তৈলচিত্র, ছবিটির একটা কোনা ভাঙ্গা। আর আর্চবিশপের পাশেই টানানো আছে পরিবারের পূর্বপরুষদের লেবু-হলুদ রঙের ছবিগুলো। টেবিলের ওপর একটা আংগুষ্টান। একটা সুতার রিল আর আংশিক বোনানো একটা মোজা। মেঝেতে ছিল কালো একটা জ্যাকেট যার বিভিন্ন অংশগুলো টাক দিয়ে রাখা। তাছাড়া ছিল বিভিন্ন প্যাটানের স্তূপ। পাশের রুমে দুজন সচকিত বৃদ্ধা মেঝে থেকে বিভিন্ন প্যাটার্ন ও লাইনিংকাপড় কুড়াতে ব্যস্ত।
ক্ষমা করবেন, পুরো ঘরটাই বিশ্রী রকমের এলোমেলো হয়ে আছে, বলছেন চিকামাসোভা।
পাশের রুমটার বন্ধ দরজার দিকে দৃষ্টি রেখে লজ্জামাখা চেহারায় কথা বলছিল আমার সাথে। রুমটার ভিতরে তখনও গোজগাছ চলছিল; হঠাৎ দরজাটা একটু খানি খুলে আবার বন্ধ হয়ে গেল।
‘তা, ব্যাপারটা কি’ দরজার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল চিকামাসোভা। ‘কুরস্ক থেকে রাবা যে টাইটা পাঠিয়েছিল। সেটা পাচ্ছি না’, ফরাসী ভাষায় উত্তরটা শুনতে পেলাম।
‘লুকেরিয়াকে খুঁজে দিতে বল’ বললেন চিকামাসোভা, ফরাসী ভাষায়। কত স্বাচ্ছন্দ্যে আমরা ফরাসী ভাষার কথা বলতে পারঙ্গম চিকামাসোভার আনন্দঘন চোখের ভাষার সেটাই বিচ্ছুরিত হচ্ছিল যেন।
রুমের দরজাটা খুলে গেল দীর্ঘকায় ও হালকা-পাতলা গড়নের প্রায় উনিশ বছর বয়সী একজন তরুণী বেরিয়ে এলো গায়ে তার মসলিনের পোশাক কোমরে সোনার বেল্ট। সামনে এসে সে সৌজন্যতা প্রকাশ করতেই মুখম-ল, আরক্তিম হলো প্রথমে তার লম্বাটে মুখে হালকা বসন্ত দাগ বিশিষ্ট নাসিকায় লালাভ রঙ ছড়ালÑ সেখানে থেকে চোখে এবং শেষ অবধি কানদ্বয় পর্যন্ত লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল।
‘আমার কন্যা মানচ্কো’ চিকামাসোভা পরিচয় করিয়ে দিলেন ‘আর এ যুবক হলেন...’
আমি আমার পরিচয় দিলাম এবং ঘরের ভিতরে রক্ষিত কাপড় চোপড়ের আধিক্য বিস্ময় প্রকাশ করলাম। এতে মা ও মেয়ে উভয়েই অধোবদন হলো।
‘ধর্মীয় পরব উপলক্ষে এখানে কিছুদিনের মধ্যে একটা মেলা বসবে’, মা বললেন, ‘সে মেলা থেকে আমরা কাপড়-চোপড় কিনে রাখি সারা বছরের পোশাকের জন্যÑ যা নিজেরাই সেলাই করে থাকি। আমার স্বামী সেমিওনোভিচ যে পরিমাণ টাকা পাঠায় তা দিয়ে কোন রকম বিলাসিতা করা সম্ভব নয়Ñ নিজেদের পোশাক নিজেদেরই সেলাই করতে হয়।
‘কিন্তু মানুষতো আপনারা মাত্র দুজনÑ এত কাপড়-চোপড়...’ ‘ওহ ঐ কাপড় চোপড়গুলো আমাদের পরিধানের জন্য নয়, ঐগুলো সব যৌতুক।’
‘কি যে বলো মা।’ বলে মেয়েটির মুখ আরক্তিম হলো, তারপর বলল, ‘ভদ্রলোক কী ভাববে বলত... তবে বিয়ে আমি কিছুতেই করবে না। কখনই নয়।’
কথা বলার সময় বিয়ে শব্দটা উচ্চারণের সাথে তার চোখ দুটোতে আলোর বিচ্ছুরণ হলো।
চা পরিবেশন করা হলো সাথে এলো বিস্কুট, জ্যাম মাখন অতঃপর ক্রিমযুক্ত রাসবেরিও পরিবেশিত হলো। সন্ধ্যা ৭টায় আপ্যায়িত করা হলো ৬ পদবিশিষ্ট রাতের খাবার। ভোজন গ্রহণকালে পাশের রুম থেকে একটা উচ্চ-শব্দে হাই তোলার আওয়াজ শুনতে পেলাম।
আমার চমকিত চেহারা দেখে চিকামাসোভা বললেন, এটা হলো পিয়তর সেমিওরোভিচের ভাই ইগর সেমিওনোভিচÑ সে এক বছর হলো আমাদের সাথে বাস করছে। তাকে আপনার ক্ষমা করতেই হবেÑ কেননা সে আপনার সামনে আসতে পারছে না। সে অত্যন্ত লাজুক একজন মানুষÑ কোন অচেনা মানুষের সামনে যায় না। সে কোন গির্জায় যোগদানে আগ্রহী। চাকরি করতে গিয়ে সে একটা আঘাতের মুখোমুখি হয়ে বর্তমানে খুবই হতাশাগ্রস্ত।
সান্ধ্য খাবারের পরে চিকামাসোভা ইগর সেমিওনোভিচের অর্ধ সেলাইকৃত আলখিল্লাটা আমাকে দেখালÑ যা পরবর্তীতে গির্জায় দান করতে ইচ্ছুক। মানেচ্কা তার লজ্জাটাকে মুহূর্তের জন্য দূরে সরিয়ে বাবার জন্য তার তৈরি করা একটা সিগারেটের বাক্স আমাকে দেখালÑ যা দেখে আমি অবাক হওয়ার ভান করলাম। এতে পুনরায় সে ব্লাশ করল এবং মার কানে কী যেন বলল। কথা শুনে মায়ের চেহারায় উজ্জ্বলতা ছড়াল এবং সে আমাকে স্টোর রুমে যেতে আহ্বান জানাল। সেখানে প্রবেশ করে পাঁচটা আলমারি, অনেক সুটকেস আর বাক্স দেখতে পেলাম। ‘এগুলোতে ভরা সমস্ত কাপড় চোপড়সমূহ আমরাই তৈরি করেছি, আর এ সমস্ত সবই যৌতুক’, মা আমাকে জানাল। আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে সবকিছু দেখলাম। অতঃপর অতিথিপরায়ণ মহিলাদ্বয় থেকে বিদায় নিতে চাইলেÑ তারা পরবর্তীতে আবার আসতে আমাকে অনুরোধ করলÑ আমি কথা দিলাম।
এ প্রথম ভ্রমণের সাতটি বছর পর দেয়া কথা রাখার সুযোগটা পাওয়া গেল যখন আমাকে একটা আইনের ওপর বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটা ছোট্ট শহরে নিযুক্তি দিয়েছিলেন। আমি পরিচিত বাড়িটিতে প্রবেশ করার সাথে সাথে তারা আমাকে চিনতে সক্ষম হলো এবং সাথে সাথে সেই ‘আহ’ ধ্বনি শুনতে পেলাম।
আমাকে চিনতে তাদের কোন অসুবিধা হয়নি। তাছাড়া আমার প্রথমবারের আসাটা তাদের স্মৃতিতে স্বাক্ষর রেখেছে। মনে হয় তাদের বাড়িতে কম লোকজন আসে বলেই ঘটনাটা তারা ভুলতে পারেনি। ড্রইংরুমে প্রবেশ করেই দেখতে পেলামÑ চিকামাসোভা আরও স্থূলকায় হয়েছেÑ চুল শুভ্রত। ধারণ করেছে, হামাগুড়ি দিয়ে গাঢ় নীল রঙের কাপড় কাটায় ব্যস্ত আর তার মেয়ে ডিভানে বসে ্এমব্রয়ডারি কাজে রত। সেই একই ডিজাইন, সেই ন্যাপথালিনের গন্ধÑ ঘরে টানানো সেই ছবিগুলোÑ সেই আর্চবিশপের ছবির কোনাটা ভাঙ্গাÑ তবে এতকিছুর মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা গেল। আর্চবিশপের ছবিটার পাশে পিয়তর, সেমিওনোভিচের একটা ছবি টানানো আর দুজন মহিলাই শোকের পোশাক পরিহিত জেনারেল পদে পদোন্নতির এক সপ্তাহ পরেই পিয়তর সেভিওনোভিচ মৃত্যুবরণ করেছেন।
স্মৃতিচারণ করতেই জেনারেল– পতœী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ‘অনেক বড় লোকসান হয়ে গেছে আমাদের আপনার পরিচিত পিয়তর সেমিওনোভিচ আমাদের মাঝে নেই আমরা একা হয়ে পড়েছিÑ আমাদের দেখার আর কেউ নেই। ইগর সেমিওনোভিচ যদিও এখন ও বেঁচে আছেÑ তবে তার সম্পর্কে তেমন ভাল কিছু বলার নেই। যাজক সম্প্রাদায় তাকে বের করে দিয়েছে তার মাদকাসক্তির কারণে। আর বর্তমানে সে দুঃখ দূর করার জন্য মদ্যপান আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তার সমন্ধে মার্শালের কাছে আমি অভিযোগ পেশ করতে চাই। সে কয়েকবার মানেচ্কার যৌতুকের ট্রাংক খুলে পোশাক বিক্রি করেছে। সে দুটো বাক্স একদম খালি করে ফেলেছে। এভাবে চলতে থাকলে মানেচ্কার বিয়েতে যৌতুক দেয়ার মতো কিছুই থাকবে না।’ চিকামাসোভা বললেন।
‘তুমি কি বলছো মা’, ‘মানেচ্কা লাজুক স্বরে বলে উঠল, ‘আহা ভদ্রলোক কী মনে করছে... আর আমিতো কখনই বিয়ে করব না।’
কথাটা বলে মেয়েটা ছাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলÑ মনে কোন আশা ছিল বলে মনে হলো। তার দৃষ্টি দেখে মনে হলো সে যা বলল তা সে বিশ্বাস করে না।
সামনের রুমের দিকে দৃষ্টি গেলে সেখানে বৃহৎ টাকবিশিষ্ট একজন ক্ষুদ্রাকার লোক দেখতে পেলাম। পরনে তার বাদামী রঙের লম্বা কোট, লম্বা রবারের জুতা (বুটের পরিবর্তে)। একটা এস্ত ইঁদুরের গতিতে সে পালিয়ে গেল।
‘লোকটা অবশ্যই ইগর সেমিওনোভিচ’ আমি ভাবলাম। এরপর মা ও মেয়ের দিকে তাকালাম, তাদের উভয়েরই যেন বয়সটা অনেক বেড়ে গিয়েছে। মায়ের চুল রুপালি শুভ্র আর মেয়েটা বিবর্ণ, কুঞ্চিত হয়ে গেছে। মেয়ের বয়সের পার্থক্য পাঁচ বছরের অধিক বলে মনে হয় না।
‘আমি মার্শালের কাছে অভিযোগ করতে ইচ্ছুক’ বৃদ্ধা পুনরায় বললেন, পূববর্তী উল্লেখের কথা ভুলে গিয়ে ‘আমি অভিযোগ করতে চাই যে, ইগর সেমিওনোভিচ আমাদের সেলানো সমস্ত কাপড়- চোপড় নিয়ে তার আত্মার সদরগতির জন্য দান করে দিচ্ছেন। আমার মানেচ্কার জন্য কোন যৌতুক আর অবশিষ্ট থাকবে না।’
মানেচ্কার মুখম-ল রক্তিমাভ হলো তবে কোন কথা বলা থেকে বিরত থাকল।
‘আমাদের আবার সেলাই শুরু করতে হবে প্রথম থেকে, তবে আমরাতো ধনী নইÑ সবাই জানে, তাছাড়া আমাদের একটা বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে।’ চিকামাসোভা বলল।
‘হ্যাঁ, আমাদের একটা বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে!’ মানেচ্কা কথাটার পুনরুক্তি করল।
গত বছর ভাগ্য আমাকে পুনরায় সেই পরিচিত কুটিরটিতে নিয়ে গিয়েছিল। ড্রইংরুমে প্রবেশ করতেই বৃদ্ধা চিকাসোভাকে দেখা গেল সম্পূর্ণভাবে কালো কাপড়ে আবৃতা শোকার্ত পোশাকে, ডিভানে বসে সেলাই কাজে ব্যস্ত। তার পাশে উপবিষ্ট ক্ষুদ্রাকারের এক বৃদ্ধ গায়ে বাদামী রঙের লম্বা কোট, পায়ে রবারের জুতা। আমাকে দেখামাত্র সে লাফ দিয়ে উঠে ড্রইংরুমের বাইরে চলে গেল।
আমার অভিবাদনের উত্তরে বৃদ্ধা হেসে বলল, ‘আপনাকে দেখতে পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত।’ কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী সেলাই করতেছেন?’ ‘এটা একটা শার্ট, এটা সেলাই সম্পন্ন হলে গির্জার যাজকের কাছে নিয়ে লুকিয়ে রাখতে বলব, না হলে ইগর সেভিওনোভিচ চুরি করে নিয়ে যাবে। আমি এখন সবকিছুই যাজকের কাছে নিয়ে লুকিয়ে রাখি, ফিস ফিস করে উচ্চারণ করল চিকামাসোভো।
তার সামনে রাখা টেবিলটাতে মেয়ের ছবিটার দিকে দৃষ্টিপাত করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলে উঠল।
‘আমাদের একটি ক্ষতি হয়ে গেছে আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন।’ আমি আর জিজ্ঞাসা করলাম নাÑ তার মেয়েটা কোথায়Ñ মানেচ্কা নাই কেন? গভীর শোকে আচ্ছন্ন মহিলাটিকে কোন প্রশ্ন করতে পারলাম না। বাড়ি থেকে বিদায় গ্রহণ পর্যন্ত অনেকটা সময় নীরবে কাটল। মানেচ্কাকে আর দেখতে পেলাম না...। শান্ত ও লাজুক পদক্ষেপে বের হয়ে নিম্ন স্বরে কথা বলার মেয়েটি আর এলো না আমার দৃষ্টির সীমানায়...। সবকিছু বুঝলাম এবং হৃদয়টা ছেয়ে গেল গভীর বিষাদে।

No comments

Powered by Blogger.