বিদ্যালয়ে মধ্যাহ্নভোজন ও প্রাসঙ্গিক বিষয় by এ এম এম শওকত আলী

একটি ইংরেজি দৈনিকের সংবাদে দেখা যায় যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য মধ্যাহ্নভোজ দেওয়ার উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি। এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য ছিল ছাত্রছাত্রীরা যাতে বিদ্যালয় ছেড়ে না দেয়। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ড্রপ আউট (Drop out)। অন্য উদ্দেশ্য ছিল, বিদ্যালয়ে পড়াশোনায় অন্যদের অধিকতর আগ্রহী করা।


অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের ড্রপ আউটের সংখ্যা ৪০ শতাংশ। এ থেকে অনুমান করা যায়, অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। আরো অনুমান করা যায় যে বৃহৎ মাত্রার ড্রপ আউট সরকারি কোনো সমীক্ষার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে উদ্যোগটি গ্রহণ করা হয়েছে। এ অনুমান যদি সত্যি হয় তাহলে বলা যায়, একমাত্র মধ্যাহ্নভোজ ব্যবস্থার অভাবই ড্রপ আউটের আধিক্যের কারণ নয়। জাতীয় ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাও এমন কারণ বলেনি। যা বলেছে তা হলো, এর কারণ একাধিক। জাতীয় পরিকল্পনায় এসব কিছু কারণেরও উল্লেখ রয়েছে। তবে মধ্যাহ্নভোজ এর মধ্যে নেই।
অতীত ও বর্তমানের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, দুপুরে ছাত্রছাত্রীদের খাবার ব্যবস্থার বিষয়টি টিফিন নামে বহুল পরিচিত। এখনো কিছু বিদ্যালয়ে এ প্রথা চালু আছে। এ নামের কারণ মধ্যাহ্নভোজ বিরতি নয়। টিফিনের সময় (পিরিয়ড) হলো কিছু সময়ের জন্য কোনো ক্লাস হবে না। বর্তমানে কিছু বিদ্যালয় স্ব-উদ্যোগে এ ব্যবস্থা করে থাকে। কোনো কোনো বিদ্যালয় প্রতি মাসে টিফিন ফিও নিয়ে থাকে। তবে এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য মূলত স্বল্প খরচে টিফিন ব্যবস্থা চালু করা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় একটি স্কুল কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ শিক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়। এ নির্দেশে বলা হয়, প্রতিটি বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের এ বিষয়ে চাঁদা দেওয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অনেক সরকারি আদেশের মতো এ আদেশও ছিল রুটিনমাফিক। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না বলে প্রতীয়মান হয়। ওপর থেকে জারি করা আদেশ-নির্দেশ সব সময়ই বাস্তবমুখী হয় না। ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক বা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে মতামত গ্রহণ করা হয়েছিল কি না তা অজানা। এ ছাড়া রয়েছে ছাত্রছাত্রীদের মতামত। তারাই বলতে পারবে, স্কুল ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতার প্রধান কারণ কী?
প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কতজন চাঁদা দিতে সক্ষম ও ইচ্ছুক, এর কোনো তথ্য গ্রহণ করা হয়নি। তারা কোথায় বর্তমানে বসবাস করছেন, সে তথ্যও প্রাসঙ্গিক। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এ খবর রাখে কি না বলা দুষ্কর। কারণ তাঁদের মধ্যে যাঁরা সামর্থ্যবান, তাঁরা হয় অন্য কোনো বড় শহরে অথবা বিদেশে বসবাস করছেন। এসব তথ্য অবশ্য বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সংগঠনই দিতে পারবে। তবে এদের সংখ্যাও বেশি নয়। এ ছাড়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাভেদে বিনা মূল্যে টিফিন দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের তারতম্য থাকা স্বাভাবিক।
অতীতে সদাশয় মার্কিন সরকার বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের টিফিনের জন্য গুঁড়া দুধ ও বিস্কুট দান করত। বর্তমানে এমনটি দেখা যায় না। তবে কিছু বিদ্যালয়ে এনজিওগুলোর মাধ্যমে বিনা মূল্যে টিফিন ব্যবস্থা চালু আছে বলে জানা যায়। সংখ্যায় খুব কমই হবে। বিদেশি সাহায্য কখনো স্থায়ী হয় না, হতেও পারে না। বর্তমান অবস্থাই এর একটি প্রমাণ। জানা যায়, গত বছর মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট নির্দেশ জারি করেছিল। উদ্যোগ ফলপ্রসূ না হওয়ায় এখন নির্দেশ আবার পাঠানো হয়েছে। এ জন্য সব মন্ত্রণালয়কেই এই বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। প্রথমে হয়েছিল ওপর থেকে নিচে, অর্থাৎ মাঠপর্যায়ে। বর্তমানে এ নির্দেশ সব মন্ত্রণালয়েই দেওয়া হয়েছে বলে শোনা গেছে। অর্থাৎ পথ পরিবর্তন করে নির্দেশটি ওপরেই রয়েছে, এই আশায় যে এটা আবার মাঠপর্যায়ে যাবে অন্যান্য মন্ত্রণালয় থেকে। বলা বাহুল্য, অন্য মন্ত্রণালয়ের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা এ নির্দেশ রুটিন হিসেবে গণ্য করবেন। শুধু অবগতির জন্য, এ কাজটি তাঁদের কার্যপরিধির অন্তর্ভুক্ত নয়।
সংশ্লিষ্ট ইংরেজি দৈনিক নির্দেশের ফলাফল জরিপ করেছে। এ জরিপে ৫০টি বিদ্যালয় রয়েছে। ফলাফলে দেখা যায়, পঞ্চাশের মধ্যে মাত্র একটি বিদ্যালয় নির্দেশ বাস্তবায়নে সক্ষম হয়েছে। তবে এর স্থায়িত্ব সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, ওপর থেকে জারি করা নির্দেশ সাময়িকভাবে ফলপ্রসূ হলেও কখনো স্থায়িত্ব লাভ করে না। মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা উৎসাহিত হয়ে কাজ শুরু করলেও সময়ের ব্যবধানে সে উৎসাহ স্তিমিত হয়।
অধ্যয়নের সুযোগ, ড্রপ আউট ও সমতা
ড্রপ আউটের আধিক্য ছাড়াও চলমান পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ, সমতা ও শিক্ষার মানের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় এ বিষয়গুলোকেই প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরিসংখ্যানে বলা হয় যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রী হলো মোট সংখ্যার ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ বাকি ৫৫ শতাংশ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি। কারণ একাধিক। প্রধান কারণ- দারিদ্র্য ও শিশুশ্রমিক প্রথা। এরা একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বৃত্তি দেওয়ার প্রথা চালু থাকা সত্ত্বেও এ বিষয়টি দৃশ্যমান। মেয়েদের ড্রপ আউটের সংখ্যাও অত্যধিক। ফলে নারী উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। এদের মধ্যে উচ্চশিক্ষাগামীর হার ৩২ শতাংশ। বাস্তবতা হলো, গরিব পরিবারের বিদ্যালয়গামী ছাত্রছাত্রীরা অন্য কোনো কাজ করে পরিবারের জন্য বিকল্প আয়ের পথ অবলম্বন করতে বাধ্য হয়।
সরকার এখন শিক্ষা ক্ষেত্রে দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এক. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি। দুই. অধিক মাত্রায় ড্রপ আউট হ্রাস। এর সঙ্গে শিক্ষার গুণগত মানের বিষয়টিও জরুরি। জাতীয় পরিকল্পনার নীতিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ভর্তুকি দেওয়ার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য শিক্ষার চাহিদা সৃষ্টি, বিশেষ করে গরিবের জন্য। কৌশল হিসেবে মেয়েদের জন্য আর্থিক সাহায্যের কথাও বলা হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, নব্বইয়ের দশকে প্রথম কিছুসংখ্যক উপজেলায় ছাত্রীদের বিদ্যালয়ে অধ্যয়নে আকৃষ্ট করার জন্য ছাত্রীবৃত্তি প্রথার বাস্তবায়ন করা হয়। নরওয়েসহ নর্ডিক অঞ্চলের কিছু দেশ এ জন্য অর্থ সাহায্য দেয়। সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে প্রায় ৪০টি উপজেলা প্রকল্পভুক্ত করা হয়। চূড়ান্ত অনুমোদনের সময় সরকারি নীতিনির্ধারকরা নির্বাচিত উপজেলার ব্যাপক রদবদল করেন। যাঁরা এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁদের একটিই যুক্তি ছিল- উপজেলা ঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাঁরা এটা এমনভাবে করলেন, তাতে নিজেদের নির্বাচনী এলাকাই চিহ্নিত হলো। উপজেলার গরিবের সংখ্যা এবং অনগ্রসরতা আমলে নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে একজন ক্ষোভ করে বলেছিলেন যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে এ সুযোগ দেওয়ার জন্যই উপজেলাগুলোর আমলারা উন্নয়ন সহযোগীদের সুপারিশ করেছেন। নব্বইয়ের দশকের পরও এ প্রথা স্থায়ী হয়। সরকারি অর্থায়নেরও ব্যবস্থা হয়। তবে এখনো চিহ্নিত চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি। জাতীয় পরিকল্পনায় এ কথা স্বীকৃত।
বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাপনা
শিক্ষাব্যবস্থাপনা অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত। এ ব্যবস্থাপনার বিকেন্দ্রায়ন অন্য একটি চ্যালেঞ্জ। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এর জন্য কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব-পরিধির মধ্যে রয়েছে নীতিনির্ধারণ, অর্থায়ন, গুণগত মান নির্ধারণ, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন। পরবর্তী স্তরের সরকারের দায়িত্ব-পরিধি হবে ব্যবস্থাপনা। পরবর্তী স্তরের সরকার মানে স্থানীয় সরকার। এ ছাড়া তো এ স্তরে আর কোনো কিছু নেই। স্থানীয় সরকার জেলা ও তৎপরবর্তী প্রশাসনিক একাংশে রয়েছে। একই সঙ্গে নগর অঞ্চলের জন্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাও রয়েছে। এটাই যদি ব্যবস্থাপনা নীতিসংক্রান্ত দিকনির্দেশনা হয় তাহলে বলতে হবে, এ ধরনের নীতি ফলপ্রসূ না হওয়ারই আশঙ্কা বেশি। ব্যবস্থাপনা ফলপ্রসূ করতে হলে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটিকেই দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে। এ দায়িত্ব বিদ্যমান নীতির আওতাভুক্ত হলেও বিভিন্ন কারণে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সার্বিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় সুশাসনের বিষয়টি দারুণভাবে অবহেলিত। সুশাসনের জন্য প্রয়োজন হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর যাতে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ না করে এবং বহিরাগত প্রভাব বন্ধ করে।

লেখক : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.