শেকড়ের ডাক-মাৎস্যন্যায় গণতন্ত্র ও আলু-পটোলের জীবনমান by ফরহাদ মাহমুদ

অভিধানে মাৎস্যন্যায় শব্দটির অর্থ লেখা আছে, বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে খায় তেমনই বলবান কর্তৃক দুর্বলের ওপর অত্যাচার। নৈরাজ্য, যথেচ্ছাচার। বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা ব্যাখ্যা করার জন্য এই একটি মাত্র শব্দই কি যথেষ্ট নয়? আর বলা হয়, সেই বাংলাদেশে এখন 'গণতন্ত্র' বিদ্যমান। কিন্তু সুশাসন বা আইনের শাসন যদি কোনো দেশে না থাকে,


সেই দেশে কি গণতন্ত্র থাকতে পারে? তাই বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে 'মাৎস্যন্যায় গণতন্ত্র' বলাটাই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি যৌক্তিক হবে। যদিও এই গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মায়াকান্নার কোনো অভাব নেই। আগামী নির্বাচন নির্বাচিত নাকি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে, তা নিয়ে কত ধরনের বিতর্ক শুনতে হচ্ছে।
আমাদের আইনের শাসন কোন পর্যায়ে আছে, তা অনুধাবন করার জন্য পত্রিকা পড়তে হয় না, বক্তৃতা শুনতে হয় না, কেবল চোখ-কান খোলা রাখলেই চলে। এর পরও এই লেখাটি লেখার সময় আমার সামনে থাকা একটি মাত্র পত্রিকার মাত্র একটি দিনের (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ৮ আগস্ট) কয়েকটি শিরোনাম তুলে ধরছি। 'মহাখালীতে গুলিতে ব্যবসায়ী নিহত ও আদাবরে বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যা', 'মায়ের সামনে ছেলেকে গুলি করে হত্যা, প্রতিবাদে রূপগঞ্জে সড়ক অবরোধ, আসামির বাড়িতে হামলা', 'গাজীপুরে সেপটিক ট্যাংক থেকে শিশুর লাশ উদ্ধার', 'দুমকিতে (পটুয়াখালী) ব্যবসায়ীকে হত্যা', 'চাঁদপুর সিরাজগঞ্জ কুষ্টিয়া বগুড়ায় চার খুন', 'রাজবাড়ীতে স্কুলছাত্র শিপন হত্যা, চাচাত দাদি ও চাচি জড়িত'। এতগুলো হত্যা ছাড়াও দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লুটপাট, ছিনতাইয়ের বেশ কিছু খবর রয়েছে। তার মধ্যে আছে, 'রূপগঞ্জে ইফতার নিয়ে ছাত্রদলের সংঘর্ষ, আহত ১২' এবং 'শৈলকুপায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ৩০'। এ দুটি হাঙ্গামার কথা উল্লেখ করলাম এ কারণে যে এরা আবার বিশেষ আদর্শের বা বিশেষ ব্যক্তির 'সৈনিক' হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়। এরাই আবার আমাদের গণতন্ত্রের ধ্বজা উর্ধ্বে তুলে ধরে। অথচ এদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধ দেখতে দেখতে দেশবাসী আজ চরম হতাশাগ্রস্ত। এখানে একই পত্রিকার আরেকটি খবরের কথা না বললেই নয়। বগুড়ায় আয়োজিত 'আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা' চত্বরে অবৈধভাবে নেওয়া বিদ্যুৎ লাইন কাটতে গিয়েছিলেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন উপসহকারী প্রকৌশলী জুলফিকার আলী তালুকদার। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শহর আওয়ামী লীগের নেতা শাহাদৎ আলম শাহীন দলবল নিয়ে প্রকৌশলী ও তাঁর সহকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। জুলফিকার জানান, একপর্যায়ে মুক্তা নামে একজন কর্মী তাঁকে ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় এই প্রকৌশলী এখন বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হায়রে প্রতিশ্রুতি! 'আপনারা নির্ভয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন।' এখন এই প্রকৌশলী দেশের দায়িত্ব দূরে থাক, তাঁর পরিবারের প্রতি যে দায়িত্ব সেটিও পালন করতে পারছেন না।
৮ আগস্টের অন্যান্য পত্রিকায় আরো অনেক অঘটনের খবর আছে। এই নিবন্ধে সব উল্লেখ করা সম্ভব নয়। আর কয়েক দিনের কাগজের অঘটনের খবর তুলে ধরার তো প্রশ্নই ওঠে না। প্রয়োজনও নেই। পত্রপত্রিকা যাঁরা পড়েন, তাঁরা এসব খবর পড়তে পড়তে এমনিতেই তিতিবিরক্ত হয়ে আছেন। মন বিষানো এসব খবর দিয়ে নতুনভাবে বিরক্ত করার কোনো মানে হয় না। আর কোনটা রেখে কোনটা বলব? সামনে ঈদ। নাড়ির টানে অনেকেই ঈদে পরিবার-পরিজন কিংবা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিলিত হতে চায়। গ্রামে যেতে চায়। কিন্তু রাস্তাঘাটের যে অবস্থা, তাতে প্রাণটা হাতে নিয়েই হয়তো বাড়ি ফিরতে হবে। এর পরও ট্রেন, বাস, লঞ্চের টিকিট পাওয়া গেলে তো! সারা রাত লাইন দিয়েও সকালে খালি হাতে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে অনেককে ফিরে আসতে হয়েছে। গ্রামে ফিরেও কি শান্তি আছে! চোর-ডাকাতের উপদ্রব এতটাই বেড়ে গেছে যে ভয়ে-আতঙ্কে বিনিদ্র রাত কাটাতে হবে। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই যে দুরবস্থা এবং যেভাবে দিন দিনই পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে- এর শেষ কোথায়? কেন এমন হচ্ছে? এর জন্য দায়ী কারা? ক্ষমতাসীনদের এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ আছে বলেও মনে হয় না।
কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে যদি অন্যায়ের বিচার না হয়, তাহলে সেই সমাজে কখনো শান্তি আসে না। আসতে পারে না। অপরাধী, খুনি, লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, জুলুমকারী- এরাই তখন সমাজের হর্তাকর্তা বনে যায়। সমাজের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। তা-ই কি হচ্ছে না বর্তমান বাংলাদেশে? কী বিএনপি, কী আওয়ামী লীগ- সব সরকারের আমলেই আমরা দেখেছি, জেল থেকে হাজার হাজার অপরাধীকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ছেড়ে দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত খুনিকেও ছেড়ে দেওয়া হয়। দণ্ড মাফ করে দেওয়া হয়। অপরাধের তদন্ত এগোয় না, তদন্ত বেপথু হয়। ক্ষমতাসীনরা নানাভাবে হস্তক্ষেপ করে। ছয় মাস পার হলেও ঢাকা শহরে খুন হওয়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য রহস্যজনক কারণে অনুদ্ঘাটিতই থেকে যায়। বিষাক্ত প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে কয়েক শ শিশু মারা গেলেও এসব উৎপাদনকারী বা বিক্রেতার কোনো সাজা হয় না। নিম্নমানের ওষুধ ও ভেজাল খাবারে বাজার সয়লাব হয়ে যায়। এসব খেয়ে হাজার হাজার মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। কিংবা কিডনি, লিভার অকেজো হয়ে মারা যায়। এতেও ক্ষমতাসীনদের কিছু আসে যায় না। তারা তেলে মাথায় তেল ঢালে। এ কেমন গণতন্ত্র?
গণতন্ত্র থাকলে, সরকারের জবাবদিহি থাকলে, দুর্নীতি এমন সর্বগ্রাসী রূপ নেয় কী করে? এমন কোনো সরকারি, আধাসরকারি অফিস বা সেবা সংস্থা আছে, যেখানে ঘুষ ছাড়া কাজ করা যায়? স্থানীয় সরকারগুলোর অবস্থাও যাচ্ছেতাই। স্কুল-কলেজেও অবাধে চলছে নিয়োগবাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য। আর এসবই ঘটে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায়। সরকারি কাজের টেন্ডার থেকে শুরু করে জলমহাল, খাসজমির ইজারা- কোথায় নেই এই ছায়া? ক্ষমতাসীন মূল দল, অঙ্গসংগঠন কিংবা দলীয় পেশাজীবী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মুখের দিকে তাকালেই তাতে লোভ-লোলুপতা চুইয়ে পড়তে দেখা যায়। তারা যেন হাঁ করেই আছে, কোথায় কী সুবিধা পাওয়া যায় তা গলাধঃকরণ করার জন্য। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এসব চলে কী করে?
দেশে বিদ্যুতের বেহাল অবস্থা। রেন্টালের চাপে চিঁড়েচ্যাপ্টা হওয়ার জোগাড়। রেন্টালের ভূত এ সরকারের আমলে ছাড়বে বলেও মনে হয় না। রাস্তার বেহাল অবস্থা। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে তো বাড়ছেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক। থাকার মধ্যে একটি জিনিসই আছে, তাহলো বক্তৃতাবাজি। এই যদি হয় গণতন্ত্র আর নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ববোধ, তাহলে আমাদের মুক্তি কোথায়? ভাগ্যিস, গণতন্ত্রের আত্মহত্যা করার সুযোগ নেই, থাকলে হয়তো তাই করত।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.