লঞ্চের টিকিট কালোবাজারে by জসীম রেজা

রাজধানী থেকে দক্ষিণ অঞ্চলে ঘরমুখো প্রায় চার লাখ লোক পড়েছে বেশ দুশ্চিন্তায়। তাদের বেশির ভাগই স্বল্প আয়ের মানুষ। ঈদে তাদের বাড়ি যাওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে গতকাল বৃহস্পতিবার বিভিন্ন লঞ্চ কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টিকিট নেই, সব বিক্রি হয়ে গেছে! যদিও অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার কথা আজ শুক্রবার থেকে।


অভিযোগ পাওয়া গেছে, লঞ্চ মালিকদের একটি দল ও অসাধু কর্মচারীরা টিকিট কালোবাজারিদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। এই অপকর্ম দেখার কেউ নেই। তবে লঞ্চ মালিক সমিতি বলছে, ১৪ আগস্ট থেকে যাত্রীদের সেবায় প্রচলিত রোটেশন পদ্ধতি ভেঙে দেওয়া হবে। এতে যাত্রীরা প্রয়োজন অনুযায়ী লঞ্চ সাভির্স পাবে।
জানা গেছে, ঈদ উপলক্ষে যাত্রীসেবা নিয়ে সরকার ও মালিক পক্ষ গত ৪ ও ৬ আগস্ট আলোচনা করে। বৈঠকে অংশ নেন নৌসচিব, ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সদরঘাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ, র‌্যাব ১০-এর এসপি এবং বিআইডাব্লিউটিসি ও বিআইডাব্লিউটিএর ঊর্ধ্বতন কর্মকতারা। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, স্টিমারের টিকিট ৮ আগস্ট এবং লঞ্চের টিকিট ১০ আগস্ট বিক্রি শুরু হবে। গতকাল দেখা গেছে, টিকিটের খোঁজে লোকজন সদরঘাট টার্মিনালের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটছে। আর কালোবাজারিরা টিকিটের দাম হাঁকছে দুই থেকে তিন গুণ। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে যাত্রীরা।
এই প্রতিবেদক যাত্রী সেজে সুন্দরবন, সুরভি, কীর্তনখোলা, আঁচল, পারাবত, রাজদূত-৭ লঞ্চসহ ঢাকা-বরিশাল, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন নৌপথের লঞ্চের কেরানিদের (টিকিট বিক্রেতা) সঙ্গে কথা বলেন। সবাই জবাব দিয়েছেন, তাঁদের কাছে কোনো টিকিট অবশিষ্ট নেই। পারাবত লঞ্চে গিয়ে দেখা গেল কেরানি মো. রহমান মোবাইল ফোনে কেবিন বুকিং বিষয়ে কথা বলছেন। ১১ আগস্ট একটি ডাবল কেবিন বুকিং দিলেন পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে। এই প্রতিবেদক টিকিট আছে কি না জিজ্ঞেস করলে তিনি 'না' জবাব দেন। এরপর কালের কণ্ঠের পরিচয় দিয়ে তাঁকে ফোনে বেশি দামে বুকিং দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'সচিব ও এমপি-মন্ত্রীদের নামে কয়েকটি কেবিনের টিকিট রাখা হয়েছে, সে বিষয়ে কথা হচ্ছিল। আমাদের কাছে বিক্রি করার মতো কোনো কেবিনের টিকিট নেই।'
পাশেই আবদুল হক নামের এক যাত্রী বলেন, 'এই কেরানি (রহমান) আমার কাছে ৮৫০ টাকা দরের সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া চেয়েছে এক হাজার ৮০০ টাকা। সব লঞ্চে একই অবস্থা।' অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা ইসরাত নাজনীন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মিডিয়ায় শুনেছিলাম শুক্রবার থেকে লঞ্চের টিকিট বিক্রি শুরু হবে। আজ (বৃহস্পতিবার) অফিস বন্ধ থাকায় খোঁজ নিতে এসেছি। সব লঞ্চেই নাকি টিকিট বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। এখন কিভাবে বাড়ি যাব বুঝতে পারছি না।'
এ প্রসঙ্গে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (যাত্রী পরিবহন) মাহাবুব উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম বলেন, '১০ আগস্ট টিকিট ছাড়ার অর্থ এই নয় যে এর আগে টিকিট বিক্রি করা যাবে না। যার প্রয়োজন সে আগে এসেই টিকিট নেবে। প্রক্রিয়াটি যত দ্রুত শেষ হবে ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।'
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজমুল আহসানের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীতে। এসেছেন কেবিন বুকিং দিতে। তিনি কেবিন না পেয়ে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রনেতাকে কেবিন পাওয়ার জন্য ফোন দিলেন। নাজমুল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতিবছর ঈদ এলেই লঞ্চ মালিক সমিতি টিকিট সংকটের নামে নাটক সাজায়। প্রকৃতপক্ষে টিকিট ঠিকই থাকে। আসলে নির্দিষ্ট দামের তিন গুণ ভাড়া আদায়ই তাদের মূল লক্ষ্য।'
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সদরঘাট শাখার (ট্রাফিক) সিনিয়র উপপরিচালক মো. সাইফুল হক খান বলেন, 'লঞ্চের টিকিট বিক্রির বিষয়টি লঞ্চ মালিক সমিতির বিষয়। এতে আমাদের কিছু করার নেই। আগামী ১৬ আগস্ট চাঁদাবাজ ও বিভিন্ন অপকর্ম রোধে দুটি মোবাইল কোর্ট ও অতিরিক্ত ফোর্স বসানো হবে।' টিকিট কালোবাজারি কি অপরাধ নয়- এ প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে যান। তবে সদরঘাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ গোলাপ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'অবশ্যই টিকিট কালোবাজারি করা অপরাধ ও আইনবিরোধী। আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ এলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
লঞ্চ মালিক সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দীন মিলন নির্ধারিত তারিখের আগেই অগ্রিম টিকিট বিক্রির কথা স্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতিবছরই স্থানীয় প্রভাবশালীদের জন্য কিছু কেবিন অগ্রিম রাখা হয়। আমাদের লঞ্চগুলোতে মাত্র দুই হাজার ৫০০ কেবিন আছে। অথচ ঈদের সময় যাত্রীদের প্রয়োজন হয় ১০ হাজার কেবিন। তাই দুই-তিন মাস আগেই কেবিন বুকিং হয়ে যায়। ১০ বছর ধরে এমন রীতিই প্রচলিত রয়েছে।'
প্রতিবছর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ৯৯টি নৌপথে প্রায় চার লাখ মানুষ প্রিয়জনদের কাছে বাড়িতে ছুটে যায়। বাড়তি চাপ সামলাতে আগামী ১৪ আগস্ট থেকে দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত লঞ্চ ও স্টিমার, যা চলবে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত। এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের (যাত্রী পরিবহন) চেয়ারম্যান মাহাবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আমাদের অতিরিক্ত লঞ্চ প্রস্তুত রয়েছে। ১৪ আগস্ট থেকে যাত্রীদের সেবার জন্য প্রচলিত রোটেশন পদ্ধতি ভেঙে দেওয়া হবে। এতে যাত্রীদের প্রয়োজন অনুযায়ী লঞ্চ সাভির্স দেওয়া যাবে।'

No comments

Powered by Blogger.