বিলেতের স্ন্যাপশট- অলিম্পিকের গল্প by শামীম আজাদ

অলিম্পিক উদ্বোধনীর আগে ৭০ দিন ধরে আট হাজার মাইল নদী, পর্বত, সড়ক, প্রান্তর, লোকালয়, লেক, সেতু পেরিয়ে বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করে সাধারণ ও অসাধারণ ন্যাশনাল আইকন, জাতীয় হিরো এমন মানুষদের স্পর্শে স্পর্শে এগিয়ে এসেছে অলিম্পিক মশাল। যাঁরা ছিলেন বর্ণবাদে সন্তান হারানো মা, লিউকেমিয়া আক্রান্ত অবসরপ্রাপ্ত


খেলোয়াড়, প্রতিবন্ধী যুদ্ধফেরত সেনা, স্থানীয় উজ্জীবক, সেবক, পুরোনো দিনের রোল মডেল, দাতব্য সংগঠনের কর্মী, ক্যানসারজয়ী প্রণোদাত্রী এবং এমনকি অসাধারণ অবদানে জীবন রক্ষা করে চলেছে এমন সব মানুষ।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বিশাল লাইভ শো এই অলিম্পিক উদ্বোধনী। এতে অভিনয় করেছেন দেড় হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, গবাদিপশু-পাখিসহ তাদের রক্ষক, যানবাহক এমনকি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও। গোলাপি জামা পরে যেন তিনি নিত্যদিনের মতো তাঁর ডেস্কে বসে চিঠিপত্রের উত্তর দিচ্ছিলেন, সেখান থেকেই চূড়ান্ত এক নাটুকেপনায় ব্রিটিশ হিরো বন্ডের হেলিকপ্টারে করে কোনো মুকুট বা হ্যাট ছাড়াই উড়ে এলেন উদ্বাধনী মাঠে।
এমন পরিকল্পনা অস্কারজয়ী ব্রিটিশ চলচ্চিত্রনির্মাতা স্লামডগ মিলিয়নিয়ার খ্যাত ড্যানি বয়েলের আর তাই অনেকটা ট্র্যাডিশনাল স্টোরি টেলিং স্টাইলে বলে গেলেন ‘আইলস অব ওয়ান্ডার’-এর গল্প। একের পর এক উন্মোচিত হতে লাগল দ্বীপের দেশ যুক্তরাজ্যের শৌর্যবীর্য, সবুজ ও স্বাভাবিক মানুষের কাহিনি। চার দশকের ‘বেস্ট অব ব্রিটিশ অ্যাচিভমেন্ট’ উঠে এল প্রিয় পরিচিত সংগীত, অভিনয়, চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারিতে। বিটলস, মিস্টার বিন, বন্ড, ইটি, ম্যারি পপিন্সের ম্যাজিক যেমন বাদ গেল না, তেমনি বাদ গেল না বিলেতের কষ্টার্জিত শিল্পবিপ্লব, শিশুদের হাসপাতাল গ্রেট অলমন্ড স্ট্রিট ও ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস, নারী ভোটাধিকার আন্দোলন ও পূর্ব লন্ডনের স্লাম থেকে বেড়ে ওঠা র‌্যাপার ডিজে রাসেল পর্যন্ত। শেক্সপিয়ারের টেম্পেস্ট থেকে উৎকলিত শিরোনামের সঙ্গে সংগতি রেখেই সাহিত্য এসে থামল জে কে রাউলিংয়ের হ্যারি পটারে। মনে হলো সিনেমাই দেখছি। কী করে শিল্পবিপ্লবের সময় মাঠ থেকে ধাই ধাই করে সুউচ্চ সব চিমনি উঠে গিয়ে সারা মাঠ ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে গেল সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। আর মাঠে তখন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বর্তমান বিশ্বের খ্যাতনামা নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার আকরম খানের নির্দেশনায় এসে গেল এক অসাধারণ নাচ। এ কোনো বিশ্বখেলার প্রারম্ভ নয়, এ এক আশ্চর্য দীপাবলির গল্প।
এ এমনই এক শো ছিল যে তা চলার সময়ে আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম, এখানে যে ব্রিটেন দেখছি সে ব্রিটেন আমাদের নয়। এ হচ্ছে গলাবাজ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরুনের তথাকথিত ‘কুল’ ব্রিটেন। অনুষ্ঠানের আনন্দে আত্মহারা আমরা পুরো সময়টায় হাঁ হয়ে থাকলাম। অথচ বুলিংডন ক্লাবের মেম্বার ও মহা উচ্চবিত্ত চ্যান্সেলর জর্জ অসবোর্ন ‘ব্যয়সংকোচ’ নীতির নাশকতায় সাধারণ জনসাধারণকে চেপে চিপসে করে ফেলছে। এ অলিম্পিক চলাকালেই এ দেশ গোপনে ‘ডাবল ডিপ’ অর্থমন্দায় প্রবেশ করেছে। আর বিলেতের এনএইচএস পর্বে এই মাত্র যেখানেই শত শত হাসপাতালের নার্স, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা স্বেচ্ছাসেবক হয়ে অভিনয় করে গেলেন, সেখানে এ মাসেই চাকরি হারাচ্ছেন ৫০ হাজার মানুষ।
২০০৭ সালে অলিম্পিক হোস্ট হওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্রিটেন ফ্রান্সকে হারায়। তারপর সরকার প্রায় নয় বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করে এই পূর্ব লন্ডনের স্ট্রাটফোর্ডের ডোবা ভরাট করে চকচকে অলিম্পিক পার্ক, স্টেডিয়াম ও ভিলেজ বানিয়েছে। এর মধ্যে লন্ডন নগরের নগরপালের বদল ঘটেছে, বাঙালি ঘনবসতিপূর্ণ অলিম্পিক বেল্টের বারাতে নির্বাচিত বাঙালি মেয়র হয়েছেন, লেবার দলের পতন ঘটেছে—এসেছে কনজারভেটিভ ও লিবারেল ডেমোক্রেটিকের কোয়ালিশনের সরকার। আর এখনো লম্ফ দিয়ে বলছে, এ অলিম্পিকেই লাভ তুলে নেবে ১৩ বিলিয়ন। একটা কথা হলো?
আজ যেখানে এই অলিম্পিক ভিলেজে সারা বিশ্বের চোখ, সবচেয়ে বড় ম্যাকডোনাল্ড আর শপিং মল যেখানে, সেখানে যাদের এলাকা তারা কজন তা দেখতে পাচ্ছে? টিকিট কিনতে গেলে লাগছে কমপক্ষে ৫০ পাউন্ড। খেলা দেখার সময় বাড়ি থেকে কোনো খাবার দূরের কথা পানিও নেওয়া যায় না। ওখানে একটি খাবার দোকানের ক্যাশিয়ার রুমেনা। তাঁর কাছে খাবারের দাম শুনে আমি হতবাক! একটি হ্যানিকেন বিয়ারের ক্যান, স্টেক পাই বা ছোট পানির বোতল যেখানে বাইরে যথাক্রমে ১.৩০ পেনি, ১.৫০ পেনি ও ৭৫ পেনি, অলিম্পিক ভিলেজে তা ৮.৩০ পে., ৫.৫০ পে. এবং ১.৬০ পে.। আর ব্রিটিশ ন্যাশনাল ডিশ ফিশ অ্যান্ড চিপস সাড়ে সাত পাউন্ড। ভাবা যায়! আনন্দময় হুলস্থুলে লন্ডনের এ এলাকার গরিবেরা এখন দিনশেষে দূরদেশের মতোই তা টেলিভিশনে দেখছে। তবে এ অলিম্পিকে যুক্ত নেই এমন কথা খুব কম মানুষই বলতে পারেন। এ সত্যি এক অদ্ভুত ব্যাপার।
কোনো জাতির যাত্রার ইতিহাস দীর্ঘ হলে, তার একটা ধারাবাহিকতা থাকলে, সে দেশের অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত কারণেই সাধারণ মানুষও তার জাতীয় কর্মকাণ্ডগুলোতে যুক্ত হতে পারে। সিস্টেমের কারণেই তার একটা সুযোগ হয়ে যায়। সে বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ বাংলাদেশি আকরম খান থেকে শুরু করে একেবারে পারফরমার পর্যায়ে আরফুমান, মতিউর তাজ, হিমানীষ গোস্বামী, দিয়া চক্রবর্তী, তাসনীম ইসলাম, প্রিয়মসহ স্কুলের ছেলেমেয়েরা। এরা সবাই দু-দুবার অডিশন দিয়ে ১৬৫ ঘণ্টার মতো চর্চা প্রতিযোগিতা করে তবে টিকেছে।
মূল খেলায় বাংলাদেশ থেকে মাত্র পাঁচজন বাঙালি এ অলিম্পিকে যোগ দিলেও বাংলাদেশি ব্রিটিশ বাঙালির সংখ্যা কিন্তু ৫০ বা আরও বেশি। এবং তারা খেলোয়াড়, পারফরমার, স্বেচ্ছাসেবক, গেইম মেকার এমনকি চিকিৎসকও আছেন। এ ছাড়া টর্চ বহন করা থেকে খেলা চলার সময়ে আমার মতো নগণ্য শিল্পীও ‘কালচারাল অলিম্পিয়াডের’ অংশ হয়ে ব্রিটেনের মিউজিয়াম, শিক্ষালয়, শিল্প ভবনে করে যাচ্ছেন তাঁদের প্রদর্শনী। ছাত্র, ঠিকাদার, চিকিৎসক, আর্কিটেক্ট, গায়ক, পাচক, চালক, মালী কেউ বাকি নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো অলিম্পিকে এত অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে কখনোই অংশ নেয়নি। এ অলিম্পিক আমাদের সাধারণ মানুষকে এক আচানক অভিজ্ঞতার সুযোগ এনে দিয়েছে। একটা লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট। লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট মনে করছে যারা অলিম্পিক ভিলেজে এবং অলিম্পিক কর্মকাণ্ডে খণ্ডকালীন চাকরি বা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ পেয়েছে তারাও। এই সাধারণ কর্মীরাই বিলেতের ভাবমূর্তিকে অনেক ওপরে নিয়ে গেছে। এরাই ব্রিটেনের মূল শক্তি। অলিম্পিক ছাড়াও তারা কাজ করে চলেছে নিরন্তর। বয়স্করা পুরো জীবনের অভিজ্ঞতা দিতে আসেন আর নবীনেরা এই স্বেচ্ছাসেবা দানে সঞ্চয় করে অভিজ্ঞতা এবং নিজেকে ঋদ্ধ করে তোলে দেওয়ার মন্ত্রে।
শামীম আজাদ: কবি ও সাংবাদিক।
shetuli@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.