ঈর্ষণীয় সফলতাই মুজিব হত্যার কারণ by সরদার সিরাজুল ইসলাম

(পূর্বপ্রকাশের পর) যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে স্বল্পতম ৩ বছর সময়ে (চীনের লেগেছে ১১ বছর তাও সোভিয়েত বর্ডার খোলা রেখে সাহায্য নিয়ে) স্বাভাবিক পর্যায়ে এনে যখন উপলব্ধি করলেন যে কলোনিয়াল পদ্ধতিতে গতানুগতিক ধারায় সস্তা জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় থাকা যায়, কিন্তু দেশের ৯৫ শতাংশ সাধারণ মানুষের মঙ্গল করা যায় না।


তাই তিনি নিজের জনপ্রিয়তার ঝুঁকি নিয়ে সমাজ ব্যবস্থায় আমূল রিফর্মের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সংসদে চতুর্থ সংবিধান সংশোধনীর ওপর ২৫ জানুয়ারি ৭৫ অলিখিত ও আবেগ উৎসারিত কিন্তু সুস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন যে ভাষণ বঙ্গবন্ধু দেন তা খুবই কম লোকই জানে। প্রয়োজন এই ভাষণটির (ধারণকৃত টেপটি যদি পাওয়া যায়) ব্যাপক প্রচার। রেডিও টিভি ছাড়াও। কেননা সে ভাষণে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর একদলীয় (বস্তুত একটি জাতীয় দল) শাসনব্যবস্থার পদক্ষেপ নেয়ার অন্তর্নিহিত সত্য। সুদীর্ঘ সে ভাষণটি থেকে নমুনা হিসেবে সামান্য উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে।
“আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই। যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড় বড় অর্থশালী লোক, যারা বিদেশ থেকে ভোট কেনার জন্য পয়সা পায় তাদের গণতন্ত্র নয়Ñশোষিতের গণতন্ত্র।
তুমি কি ফেরত দিয়েছ বাংলার দুখী মানুষকে, যে না খেয়ে মরে যায়? যে মানুষের কাপড় নাই, যে মানুষ বন্ধু খুঁজে পায় না, যার বস্ত্র নাই, শার্ট নাই, বুকের হাড়গুলো পর্যন্ত দেখা যায়, তাকে আজকে তোমরা কি দিয়েছ?
করাপসন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। আমরা যে ৫ পার্সেন্ট শিক্ষিত সমাজ আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপ্ট পিপল, আর আমরাই করি বক্তৃতা। আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরা বড়াই করি।
স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। যে মানুষ ভিক্ষা করে তাতে তার যেমন ইজ্জত থাকে না, যে জাতি ভিক্ষা করে তারও ইজ্জত থাকে না। ভিক্ষুকের জাতির নেতৃত্ব আমি করতে চাই না। আমি চাই আমার দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক এবং সেই জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। (এ সব উক্তির পরে কি তাকে লুটেরারা ছেড়ে দেবে?)।
এছাড়া ২৬ মার্চ, ৭৫ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায়, ১৬ জুন এবং বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে এবং ২১ জুলাই ৭৫ নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী ভাষণে দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণসমূহের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন, কিন্তু চূড়ান্তভাবে সে পদ্ধতি চালু করার পূর্বেই তাকে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে যে সব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য চিহ্নিত করেছিলেন তা হচ্ছেÑ
ক) জাতীয় ঐক্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে
খ) দুর্নীতি উচ্ছেদ
গ) উৎপাদন বৃদ্ধি
ঘ) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
ঙ) বাধ্যতামূলক সমবায়
বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবিত দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচির মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সচিব অথচ পরবর্তীতে বিরুদ্ধাচরণকারী মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল গ্রন্থে (প্রকাশ ১৯৮৩) বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল সম্বন্ধে প্রচুর সমালোচনা করলেও উক্ত গ্রন্থের ৩৩৮-৩৯ পৃষ্ঠায় যে মন্তব্য করেছেন তা থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দেয়া যাকÑ
“শেখ মুজিবের এ সমস্ত পদক্ষেপ ভালো বা মন্দ যাই হোক না কেন, তাঁর চিন্তাধারা অনুসারে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে তা যথার্থ হোক বা না হোক কিংবা তার নেতৃত্বে এর বাস্তবায়ন সম্ভব কিংবা অসম্ভব যাই হোক না কেন, মোদ্দাকথা দাঁড়িয়েছিল এই যে শেখ মুজিবের গৃহীত পরিকল্পনা সাধারণ মানুষকে দ্বিধান্বিত করে এবং সমাজের অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি অংশ এতে আতঙ্কিত বোধ করে। প্রকৃতপক্ষে তার ব্যাপক কর্মসূচিতে সমাজের প্রতিটি প্রভাবশালী শ্রেণীরই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছি। গ্রামীণ এলিট শ্রেণী সমবায় ব্যবস্থাধীনে জমির মালিকানা হারাবার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আমলারাও তাদের ওপর স্থাপিত একক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে মেনে নিতে পারেননি। বাঙালী-অবাঙালী শিল্পপতি/পত্রিকা মালিক তাদের সম্পত্তি হারিয়ে আগেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। জেলা প্রশাসন, বাধ্যতামূলক সমবায় গঠন, থানা ম্যাজিস্ট্রি স্থাপন ইত্যাদি গুটি কয়েক ব্যাপারে তিনি যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন পরবর্তী ঘটনা তা এক সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছিল।
“একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা শেখ মুজিবের হাতে ন্যস্ত করার পর জনমনে নতুন আশা উদ্দীপনার সঞ্চার ঘটেছিল। জনগণের প্রত্যাশা ছিল জনজীবনে জানমালের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবনধারা উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে। (পৃষ্ঠা ৩৪৭)
বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বাকশাল করেছিলেন বলে অনেকের ধারণা, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার ক্ষমতা কি কম ছিল? বিপরীত ধারার মতামত বিধৃত রয়েছে মওদুদ আহমদের গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৩৪৬)। (চলবে)
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.