ধর্ম- ইসলামে জাকাত আদায়ের পদ্ধতি by আবদুস সবুর খান

নামাজ-রোজাসহ অন্যান্য ফরজ ইবাদত আদায় করার পদ্ধতি যেমন কোরআন-হাদিসে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, তেমনি জাকাত আদায়ের পদ্ধতি অর্থাৎ জাকাত ব্যয় করার খাতগুলোও পবিত্র কোরআনে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। নির্ভরযোগ্য তথ্যমতে, মক্কায় ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় জাকাত ফরজ হওয়ার আদেশ নাজিল হয়।


তাফসিরে ইবনে কাসিরের ভাষ্যমতে, সূরা মুয্যাম্মিলের ২০ নম্বর আয়াতের এই অংশ ‘সুতরাং নামাজ কায়েম করো ও জাকাত আদায় করো’—দ্বারা তা-ই প্রমাণিত হয়। কারণ, এই সূরা ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় নাজিল হয়েছে। তবে বিভিন্ন হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় যে ইসলামের শুরুতে জাকাতের বিশেষ নেসাব বা বিশেষ হার নির্ধারণ করা হয়নি, বরং প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা থাকত, মুসলমানরা মুক্তহস্তে তা আল্লাহ্র রাহে দান করে দিতেন। হিজরতের পরে মদিনা শরিফে জাকাতের নেসাব ও হার নির্ধারণ করা হয় এবং মক্কা বিজয়ের পর সদকা ও জাকাত আদায়ের সুষ্ঠু নিয়মনীতি প্রবর্তন করা হয়। পবিত্র কোরআনে জাকাত ব্যয়ের নির্ধারিত আটটি খাতের কথা উল্লেখ করে এরশাদ হয়েছে, ‘জাকাত হলো কেবল ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন—তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহ্র পথে জেহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য—এই হলো আল্লাহ্র নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা তাওবা, আয়াত ৬০)
উপরিউক্ত আটটি খাতের ব্যাখ্যায় মুফাসিসররা বলেন, ফকির হলো যার সহায়-সম্বল কিছুই নেই এবং মিসকিন হলো যে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয়। অর্থাৎ যার কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ অর্থ নেই, তাকে জাকাত দেওয়া যাবে এবং সে-ও তা গ্রহণ করতে পারবে। এ আয়াতের ভিত্তিতে নবী করিম (সা.) অনেক সাহাবাকে বিভিন্ন স্থানে জাকাত আদায়ের জন্য প্রেরণ করেছিলেন এবং আদায়কৃত জাকাত থেকেই তাঁদের পারিশ্রমিক দিতেন। এসব সাহাবির অনেকে ধনীও ছিলেন। চতুর্থ ব্যয় খাত হলো ‘মুআল্লাফাতুল কুলুব’। সাধারণত তারা তিন-চার শ্রেণীর বলে উল্লেখ করা হয়। এদের কিছু মুসলমান, কিছু অমুসলমান। পঞ্চম ও ষষ্ঠ ব্যয় খাত হচ্ছে দাস-মুক্তি এবং ঋণগ্রস্তের ঋণ-মুক্তির কাজে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা। সাধারণত জাকাতের অর্থ ফকির-মিসকিনকে দান করার চেয়ে এই দুই খাতে দান করা উত্তম। তবে শর্ত হচ্ছে, সে ঋণ যেন কোনো অবৈধ কাজের জন্য গৃহীত না হয়ে থাকে। সপ্তম ব্যয় খাত আল্লাহ্র পথে জেহাদকারীর ব্যাখ্যায় মুফাসিসররা বলেছেন, সেসব গাজি ও মুজাহিদ, যাঁদের অস্ত্র ও জেহাদের উপকরণ ক্রয় করার ক্ষমতা নেই অথবা ওই ব্যক্তি যাঁর ওপর হজ ফরজ হয়েছে, কিন্তু এখন আর তাঁর কাছে এমন অর্থ নেই যাতে সে ফরজ হজ আদায় করতে পারেন। এমনিভাবে ফেকাহবিদরা ছাত্রদেরকেও এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। (রুহুল মা’আনী)
জাকাতের অষ্টম ও সর্বশেষ ব্যয় খাত ‘ইবনুস সাবিল’ বা মুসাফির বলতে এমন মুসাফির বা পথিককে বোঝানো হয়েছে, যাঁর কাছে সফরকালে প্রয়োজনীয় অর্থ-সম্পদ নেই, স্বদেশে তাঁর যত অর্থ-সম্পদই থাকুক না কেন। এমন মুসাফিরকে জাকাতের সম্পদ দেওয়া যেতে পারে, যাতে করে তিনি তাঁর সফরের প্রয়োজনাদি সমাধা করতে পারবেন এবং স্বদেশে ফিরে যেতে সমর্থ হবে। তবে শর্ত হলো তাঁর এই সফর প্রয়োজনীয় বা বৈধ হতে হবে। কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে অথবা উদ্দেশ্যহীন, নিছক আনন্দ উপভোগের জন্য সফরে বের হয়েছেন এমন মুসাফিরের জন্য এই বিধান প্রযোজ্য নয়।
রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যাকে আল্লাহ্ সম্পদ দিয়েছেন অথচ সে তার জাকাত আদায় করে না, কিয়ামতের দিন তার ওই সম্পদ একটি ভয়াবহ বিষধর সাপের রূপ ধারণ করবে, যার মাথায় থাকবে দুটি কালো বর্ণের ফোঁটা (কালো ফোঁটা হলো অত্যধিক বিষধর সাপের চিহ্ন)। ওই সাপ তার গলায় হাঁসুলির মতো জড়িয়ে দেওয়া হবে আর সে ওই ব্যক্তির দুই চোয়াল কামড়িয়ে ধরে বলতে থাকবে, আমি তোমার পুঞ্জীভূত সম্পদ, আমি তোমার পুঞ্জীভূত সম্পদ।’ (বুখারি)
জাকাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে ধনী-গরিবের পার্থক্য দূর করে একটি অর্থনৈতিক ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং ধনী-গরিবের মধ্যে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা। কারণ, বিত্তবান লোকেরা যদি স্বেচ্ছায় তাদের সম্পদের একটি নির্ধারিত অংশ গরিবের মধ্যে বণ্টন করে দেয়, তা হলে স্বাভাবিকভাবেই গরিবদের মধ্যে ধনীদের প্রতি একধরনের কৃতজ্ঞতাবোধ ও হূদ্যতা সৃষ্টি হওয়ার কথা। অপর দিকে জাকাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তিদের স্বাবলম্বী করে তুলতে পারলে সমাজে বেকার ও পরনির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে একটি সুখী-সুন্দর সমাজ গড়ে ওঠে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমরা হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলেই দেখতে পাই। অথচ আমাদের দেশে প্রতিবছর রমজান মাস এলেই কিছু কিছু দোকানে সাইনবোর্ড দেখা যায়, ‘এখানে জাকাতের শাড়ি ও লুঙ্গি পাওয়া যায়।’ আমরা বলতে চাচ্ছি না যে এসব দান করলে জাকাত আদায় হবে না। তবে জাকাতের যে মূল লক্ষ্য ‘অসচ্ছল মানুষদের স্বাবলম্বী করে তোলা’ সেটি কিন্তু এর মাধ্যমে সম্ভব নয়। সুতরাং, জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে। রাসুল (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগে যেভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় জাকাত আদায় করা হতো, আমরা বর্তমানেও সেভাবে জাকাত আদায় করতে পারি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে গঠিত জাকাত বোর্ডকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করা যেতে পারে।
ড. আবদুস সবুর খান: সহযোগী অধ্যাপক, ফারসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
masaburk@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.