নারীর ওপর নৃশংসতা

পত্রিকা খুললেই নারীর ওপর নানান ধরনের সহিংসতার খবর আমরা প্রায়ই পড়ে থাকি। এসব খবর পড়লেই আমরা বুঝতে পারি যে, এখনও নারীরা এ সমাজে কতটা অনিরাপদ। খুব সামান্য কারণে নারীকে প্রাণ দিতে হয় পুরুষের হাতে। অনেক নিষ্ঠুর পুরুষ ঝলসিয়ে দেয় নারীর শরীর অথবা সমাজের চাপে নারী বাধ্য হয় আত্মহননে।


প্রায়ই শোনা যায় যৌতুকের জন্য গৃহবধূর ওপর শ্বশুরবাড়ির অকথ্য অত্যাচারের ঘটনা। বখাটেরা তুলে নিয়ে গেছে কোন স্কুলছাত্রীকে- এমন ঘটনা শুনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের খুব চেনা খবরগুলোর একটি হচ্ছে লম্পট শিক্ষকের হাতে শ্লীলতা হারিয়েছে কোন ছাত্রী। নারীর ওপর এমন নৃশংসতা সকলেরই জানা বিষয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন এমন নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। আসলে মানুষের নীতি-নৈতিকতা বা মানবিক মূল্যবোধ এতই কমে গেছে যে অতি তুচ্ছ কারণেই আরেকজনের জীবন কেড়ে নেবার মতো জঘন্য অপরাধ করতেও অনেকে দ্বিধাবোধ করে না। খুব সম্প্রতি জুলাই মাসেই রাজধানী ঢাকার দারুস সালাসে এক গৃহবধূকে জবাই করে হত্যা করেছে পাষ- স্বামী। লাশের সারা শরীরে ধারালো অস্ত্রের চিহ্ন রয়েছে। ক’দিন পরে পুলিশ ঘর থেকে পচাগলা লাশটি উদ্ধার করে। অনুমান করা যাচ্ছে যে, হত্যাকা-টি কয়েকদিন আগে ঘটিয়ে স্বামী পালিয়ে গেছে। এই বছরের মে মাসে বাঘেরহাটের শীতলা পূজা অনুষ্ঠানে গান শুনে বাড়ি ফেরার পথে গণধর্ষণের শিকার হয় এক নববধূ। এ বছরের এপ্রিলে কন্যা সন্তান জন্ম দেবার জন্য শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনে প্রাণ দিতে হয়েছিল ফারজানাকে। ওই একই মাসে স্ত্রীকে কেটে চার টুকরো করে বাক্সে ভরে নিয়ে যাবার সময় ফেনীতে ধরা পড়ে পাষ- স্বামী সাইফুল। বাকি অর্ধেক লাশ সে ভরে ফ্রিজে। এ বছরের মে মাসে রাজশাহীর তানোরে এক কিশোরীকে অপহরণ করে ধর্ষণের চেষ্টা করার সময় স্থানীয় লোকজন মেয়েটিকে রক্ষা করে। গত জুনে জীবন দিয়ে যৌতুকের দাবি মেটালেন গৃহবধূ সাবিনা। যৌতুকের দাবিতে স্বামীর অত্যাচার আর সহ্য করতে না পেরে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন দেন তিনি। এই বছরের শুরুতে মার্চে যৌতুকের জন্য সাভারে পুড়িয়ে মারা হয় নববধূ শাবানা খাতুনকে। গত বছরে গহনা পরানোর জন্য চোখ বন্ধ করতে বলে পাষ- স্বামী স্ত্রী জুঁইয়ের হাতের কব্জি কেটে নেয়। জুঁই স্বামীর মতের বিরুদ্ধে লেখাপড়া করায় এমন শাস্তি দিয়েছে স্বামী। কিন্তু পড়ালেখার প্রতি অদম্য টান থাকায় কব্জি কেটেও জুঁইয়ের গতি রোধ করতে পারেনি তার নরপিশাচ স্বামী। সে তার নির্ধারিত সময়েই এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারী সংস্থা তাদের গবেষণার প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে এদেশে গত বছরে গড়ে ৫৩ শতাংশ নারী বিভিন্নভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। আরও উল্লেখ করা হয় এই সহিংসতারোধে আইন আছে এবং তার প্রয়োগও আছে এমনকি এখন জেলা উপজেলায় মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাও রয়েছে। কিন্তু কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। এক মানবাধিকার সংগঠনের ২০১১ সালের জন্য প্রণীত প্রতিবেদনে জানা যায় যে, ওই সালে এই ধরনের পাশবিকতার শিকার হয়ে নারী মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। গত বছর ৯৭ জন এ্যাসিড দগ্ধ হয়েছে, ৪৫৮ নারী যৌতুকের জন্য নির্যাতিত হয়েছে, ৬৭৫ জন ধর্ষিত হয়েছে এবং ৬৮৪ জন যৌন হয়বানির শিকার হয়েছে। ২০১১ সালে যদি নারী নির্যাতন আশঙ্কাজনক অবস্থায় থাকে তবে এ বছরের শুরু থেকেই নারী নির্যাতনের যে পরিমাণ ঘটনা প্রতিদিন পত্রপত্রিকায় আসছে তাতে ধারণা করা যায় যে, এ বছর এই নির্যাতন অতীতের সব সীমা অতিক্রম করবে। এ নারী নির্যাতনরোধে প্রতিদিন লেখালেখি হচ্ছে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রায়ই এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে কিন্তু কোন কিছুতেই কোন ফল হচ্ছে না। তবে এই ধরনের ঘটনা কেবল যে বাংলাদেশেই ঘটছে তা নয়। নারীর ওপর সহিংসতা সারা বিশ্বব্যাপী চলছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টাভিত্তিক সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এ্যান্ড প্রিভেনশনের এক জরিপের ফলে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে একজন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। আর প্রতি চারজন নারীর মধ্যে একজন স্বামী বা স্বজনের হাতে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়। ওই দেশে বছরে তেরো লাখ নারী ধর্ষণের বা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। নারীদের ওপর এই নৃশংসতার চিত্র রীতিমতো ভয়াবহ। এই জরিপ পরিচালনাকারী সংস্থা জানায় নারী নির্যাতনের যে এত ভয়াবহ চিত্র তা তাদের ধারণার বাইরে ছিল। টেলিফোনে চালানো এই জরিপে অংশ নেয় নয় হাজার ৮ জন নারী। আসলে মানুষের মধ্যকার মানবিক বোধগুলো ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছে। তাই নারী নির্যাতন রোধে কেবল কঠিন আইন করে তা বাস্তবায়ন করলেই চলবে না, আইনের কঠোরতার পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে মানুষের মনে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। তাই প্রয়োজন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন সব বিষয়ে অন্তর্ভুক্তি যা কি না শিশু বয়স থেকেই মানুষকে মননশীল ও মানবিক হতে শিক্ষা দেবে। সমাজে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, হতাশা, মানুষকে করে তোলে অস্থির।
এই অস্থিরতার বশবর্তী হয়ে মানুষ অনেক অপরাধমূলক কর্মকা-ে সহজেই জড়িয়ে পড়ে। তাই সমাজ থেকে এসব অস্থিরতা দূর করতে পারলে অপরাধ অনেক কমে আসত। এছাড়াও দেখা যায় যে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্য এবং মানুষকে নিরাপদে রাখা যাদের দায়িত্ব তারাও হরহামেশাই নারীর প্রতি প্রদর্শন করছে অশ্রদ্ধা। পুলিশী হেফাজতে নারীর প্রতি অবমাননার ঘটনা নতুন কিছু নয়। অনেক নারী কোন বিপদে পড়লেও সহসা পুলিশের সহায়তা নিতে থানায় যেতে চায় না। সব বয়সী নারীরই অপমান আর অবজ্ঞার শিকার হয় নিজ ঘরে নিজের প্রিয় মানুষদের কাছে। এর যেন কোন প্রতিকার নেই। মানুষের মধ্যকার বিবেকবোধ জাগিয়ে তুলতে পারলেই কেবল বন্ধ করা সম্ভব নারীর প্রতি সহিংসতা, আরও জাগিয়ে তোলা সম্ভব নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। এ ছাড়া নারীর ওপর পাশবিকতা রোধ তখনই সম্ভব, যখন নারী সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে। নারীকে যদি পুরুষের সমান অধিকার সম্পন্ন মানুষ হিসাবে সমাজে স্বীকৃতি দেয়া যায় তবেই নারীর ওপর নির্যাতন কমতে পারে।
অপরাজিতা ডেস্ক

No comments

Powered by Blogger.