চারুশিল্প- ছন্নছাড়া লাল মিয়ার বাঁধন by জাফরিন গুলশান

তিনি বোহিমিয়ান। তিনি একই সঙ্গে রাধা ও কৃষ্ণ। তিনি অসাম্প্রদায়িক। তিনি একজন তকমা সৃষ্টিকারী বাঁশিওয়ালা। কিন্তু সব ছাড়িয়ে লাল মিয়া ওরফে শেখ মোহাম্মদ সুলতান হলেন একজন শিল্পী। চিত্রশিল্পী। এস এম সুলতানের জন্মদিন আজ। ১০ আগস্ট, ১৯২৩ সালে যশোর জেলার নড়াইলের মাছুমদিয়া গ্রামে। দরিদ্র কৃষক বাবা শেখ মেসের


আলী। কৃষিকাজের অবসরে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। ছেলেবেলায় জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের দাতব্য পৃষ্ঠপোষকতায় হাইস্কুলে লেখাপড়া শুরু করলেও মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা না দিয়েই তিনি ১৯৩৮ সালে কলকাতায় যান। শুরু হলো সুলতানের ছন্নছাড়া জীবনের পথচলা। এ দেশের বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, লেখকদের বিভিন্ন লেখাপত্রই মূলত নবীন প্রজন্মের কাছে সুলতানকে তাত্ত্বিকভাবে চেনার উপায়। কিন্তু সুলতানের চিত্রকলার রস আস্বাদন ও বিশ্লেষণ সব তত্ত্বকথার ঊর্ধ্বে দর্শক, শিল্পকর্ম এবং শিল্পীর সরাসরি বিষয়।
কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সুপারিশে। শিল্প সমঝদার ও সমালোচক শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশাল লাইব্রেরির তত্ত্বাবধায়ক হলেন এবং প্রচুর বই পড়তে শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। আর্ট কলেজের শিক্ষাও অসমাপ্ত রইল। এ পর্যায়ে তিনি আসলে পৃথিবীর পাঠশালায় ভর্তি হলেন।
ছবি এঁকে পয়সা রোজগার করতেন। কাশ্মীর, পাকিস্তান হয়ে ইউরোপে গিয়েছেন। ছবি এঁকেছেন সব সময়ই। কারণ, বিভিন্ন বইপত্র থেকে সুলতানের জীবনকালপঞ্জিতে আমরা দেখি দেশে আসার আগেই তিনি বিভিন্ন স্থানে চিত্রকলা প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। যেমন—১৯৪৬ সালে ভারতের সিমলায় প্রথম একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। ১৯৪৮ সালে লাহোরে একক চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন ফিরোজ খান নূন। ১৯৪৯ সালে করাচিতে আরেকটি চিত্র প্রদর্শনী হয় এবং তা উদ্বোধন করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহ। ১৯৫০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। লন্ডনের হ্যামস্টিডের ভিক্টোরিয়া এমব্যাঙ্কমেন্টে আয়োজিত এক দলগত প্রদর্শনীতে বিখ্যাত পশ্চিমা শিল্পী পাবলো পিকাসো, দালি, ক্লি প্রমুখের সঙ্গে আমাদের সুলতানও অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু মুশকিল হলো, সুলতান নিজের শিল্পকর্মের ব্যাপারে সব সময় উদাসীন ছিলেন। কোনো বাঁধন যেন তাঁকে বাঁধতে না পারে। নিজের খেয়াল খুশিমতো চলতেন বলে সুলতানের শিল্পী হয়ে ওঠার বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রমধারাবাহিক প্রমাণ আমরা দেখতে পাই না। ছাত্রজীবন কিংবা বিভিন্ন স্থানে একক প্রদর্শনীগুলোর চিত্রকর্ম দেখার সুযোগ বঞ্চিত আমরা। তাই নির্ভর করতে হয় সেই সময়ে প্রকাশিত কিছুসংখ্যক পত্রিকার পুরোনো কপির ওপর। এবং একটা দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পীরা জানতেই পারেনি সুলতানের নাম।
তাই মনে আফসোস নিয়ে চোখ দেখতে থাকে পঞ্চাশ-পরবর্তী তাঁর চিত্রকর্মগুলোকে। সাধক, নিসর্গ-১, ২, ৩ পারাপার, কলসি কাঁখে রমণী, মা ও শিশু, নায়র, প্রথম বৃক্ষরোপণ, নিসর্গ ও ঠেলাগাড়ি, শাপলা তোলা, চিত্রা নদীর তীরে হত্যাযজ্ঞ, চর দখল, যাত্রা, খেত দখল, ধানমাড়াই, ধান ঝাড়া, আমার গ্রাম অবসর সময়ে, গ্রামের দুপুর, ধান কাটা, জমি কর্ষণ ইত্যাদি সুলতানের চিত্রসন্তান।
শিল্পী এস এম সুলতান কৃষককে সভ্যতার নির্মাতা হিসেবে এনেছেন। কর্মময়, কঠিন পরিশ্রমী পেশিবহুল পুরুষ। খুব বেশি অভিব্যক্তিময় নয় চেহারাগুলো। রমণীরা কর্মঠ, হূষ্ট-পুষ্ট। গরুগুলো যত্নের। বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রকৃতি ছাপিয়ে মানুষ ধরেছেন সুলতান কৃষক ভজেছেন। মজেছেন এমন এক জীবনে, যে জীবন শুধু শিল্পের।
দেশে ফেরার পর সুলতান ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে একক প্রদর্শনী করেন। তাঁকে নিয়ে হইচই শুরু হয় শিল্পী ও বোদ্ধা মহলে। ১৯৮৭ সালে ঢাকায় জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে একক প্রদর্শনী হয়। বিভিন্ন লেখা থেকে জানতে পাই, সে সময় তিনি ক্রেজে পরিণত হয়েছিলেন। ফলে বর্তমানের অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীই তাঁর অনুরাগী হয়ে সুলতানের সঙ্গে ঘুরতেন। সুলতান গাঁজা খেতেন। লম্বা জোব্বা পরতেন। কোঁকড়ানো ঝাঁকড়ানো চুল। মাঝেমধ্যে পায়ে ঘুঙুর দিয়ে রাধা সেজে নাচতেন। তিনি ভালো ইংরেজি ও উর্দু বলতেন। গান এবং অভিনয় করতে জানতেন।
একেকটি সফল একক প্রদর্শনী তাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। অনেক শিল্পীই তাঁকে অগ্রাহ্য করতেন কিছুটা হিংসা-দ্বেষে। কারণ, সুলতান তবুও কখনো কোনো মোহে নিজেকে জড়াননি। নাম-খ্যাতি-টাকা কোনো কিছুই নয়। চাইলেই সমাজে উচ্চবিত্ত শ্রেণীতে বিরাজ করতে পারতেন। হয়তো বা তিনি সমাজের শ্রেণীশোষণ এবং আত্মসংকটের বিপরীতের জবাব।
নড়াইলে সুলতান এক চারুশিল্প ও নন্দনতাত্ত্বিক বিপ্লব করেছেন। তিনি নন্দনকানন প্রাইমারি স্কুল, নন্দনকানন হাইস্কুল এবং নন্দকানন আর্টস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৩ সালে যশোরে একাডেমি অব ফাইন আর্টস প্রতিষ্ঠা করেন।
চারুকলার অবদানের জন্য ১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৮৫ সালে চারুশিল্পী সংসদ প্রদত্ত চারুশিল্পী সংসদ সম্মান লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে সর্বোচ্চ বেসামরিক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ পান। ১৯৮৪ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের শিল্পকলা একাডেমীর ‘রেসিডেন্ট আর্টিস্ট’-এর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।
বাংলাদেশের জাতীয় চিত্রশালা, জাতীয় জাদুঘর, এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা, নড়াইলসহ দেশে এবং বিদেশে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তাঁর কাজ সংগৃহীত হয়েছে।
১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর তিনি পরলোকগমন করেন।

No comments

Powered by Blogger.