সংগ্রামী নারী by রহিমা আক্তার

বাংলাদেশ বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু ধর্মের এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশ ৪৫টির বেশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। যাদের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী জাতি থেকে পৃথক। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। এই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এক মহীয়সী নারী হলেন প্রতিভা সাংমা।


আজ থেকে ৬২ বছর আগে পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন তিনি। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এই নারী শিক্ষার আলো দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিয়েছেন লাগাতার ৪০ বছর। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সারা জীবন কুমারীই থেকে গেছেন। জীবনের অপূর্ণতার কোন হিসাব তিনি করতে শিখেননি। তিনি হেসে বলেন, জীবনের প্রথমটা যা আশা করেছিলাম, শেষ বয়সে এসে তাই করতে পেরেছি। বর্তমানে তিনি মধুপুর উপজেলায় বসবাস করেন। মধুপুর উপজেলা থেকে ১২-১৩ কিলোমিটার দূরে ইদিলপুরে তার বাড়ি। এই বয়সেও প্রতি মুহূর্তে শিক্ষার কথা, আলোর কথা, পথের কথা, পথ প্রদর্শকের কথাই তার মুখে। প্রত্যন্ত গ্রামে থেকেও প্রতি মুহূর্তে চান দেশ ও দশের কথা জানতে, অন্যের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে। চার ভাইবোনের মাঝে প্রতিভা সাংমা দ্বিতীয়। বাবা সনাতন সাংমা চাননি মেয়ে লেখাপড়া করে শিক্ষিত হোক। বাবার ওপর অনেকটা জেদ ধরেই পড়ালেখা শুরু করেন। বাবা যে কোন সময়ে বিয়ে দিয়ে দিতে পারে এমন ভয়ে ঠিকমতো বাড়িতে আসতেন না। হালুয়াঘাটে আত্মীয়ের বাসায় আর স্কুলের হোস্টেলেই বেশি থাকতেন। জুনিয়র ছাত্রদের প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। ১৯৩২ সালের ২২ ডিসেম্বর জন্ম তার। প্রথমে প্রাথমিক বিদ্যালয় এরপর ময়মনসিংহ হালুয়াঘাট উপজেলার সেন্ট মেরি মিশনারি হাইস্কুলে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ময়মনসিংহ শহরের বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে ১৭ বছর বয়সে এসএসসি পাস করেন। ১৯৫৭-৫৮ সালের দিকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৫২ সালে ময়মনসিংহের হলিফ্যামিলি হাইস্কুলে এবং পরে হালুয়াঘাট উপজেলার সেন্ট মেরি স্টেশনারি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৩ সালে গার্লস গাইডের নেত্রী হিসেবে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য পাকিস্তানে পেশোয়ারে যান। স্বাধীনতার পর মধুপুর উপজেলা সদরের একটি গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দেন। পাশাপাশি স্থানীয় আরও অনেক স্কুলেও শিক্ষকতা করেন। একটানা ৪০ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৯১ সালে তিনি চাকরি জীবন থেকে অবসর নেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। খ্রীস্টান মিশন ও আদিবাসী গারো নেতাদের সহযোগিতায় মধুপুর পাহাড়ী অঞ্চলে বেশ কয়েকটি মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন।
৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নারীদের সাথে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরাও স্বেচ্ছায় যুদ্ধে নেমেছিলেন। সেই সব নারীদের মাঝে সন্ধ্যা রানী সাংমা একজন যোদ্ধা। পাকিস্তানী বাহিনীর নির্যাতন, অত্যাচার হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসযজ্ঞের কথা মনে হলে এখনও শিউরে উঠেন সন্ধ্যা রানী। ১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের জয়রামকুড়া খ্রীস্টান মিশনারি হাসপাতালের নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হন তিনি। হাসপাতালটির চিকিৎসক হিসেবে ছিলেন ডা. প্রেমাংকুর রায়। ১৯৭১ সালে মার্চের শুরুতেই বিভিন্ন জায়গায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। তখন তিনি ২য় বর্ষের ছাত্রী। যুদ্ধ শুরু হলো। পাকবাহিনী ময়মনসিংহ হয়ে হালুয়াঘাটের দিকে এগোতে শুরু করলে সন্ধ্যা রানী খবর পেয়ে ভেরোনিকা সিমসাং পশ্চিম বারোমারি খ্রীস্টান মিশনে চলে যাই। সেখান থেকে ঝিনাইগাতী থানার খ্রীস্টান মিশনে। সেখানে পাকিস্তানী বাহিনীর অত্যাচার শুরু হলে প্রায় ৫ হাজার সাধারণ মানুষের সাথে ভারতীয় সীমান্তের উদ্দেশে রওনা হন। মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জের শরণার্থী শিবিরে গিয়ে নাম লেখান সন্ধ্যা রানী। মুক্তিযুদ্ধে কাজ করার সুযোগ হয় এখান থেকে। ১১ নম্বর সেক্টরে ফিল্ড হাসপাতাল চালু করেন ডা. প্রেমাংকুর রায় ও ক্যাপ্টেন আঃ মান্নান। নাসিং কোর্স জানা থাকায় সন্ধ্যা রানী শুরু করেন সেই ফিল্ড হাসপাতাল সেবা দেওয়া। একই সাথে সেবা কেন্দ্রে টাইফয়েড, কলেরা, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়ার রোগের সেবা দিতে থাকেন। পর্যাপ্ত আলো ও অস্ত্র না থাকায় সাধারণ ছুরি, সুই, দড়ি কাটার কাঁচি ইত্যাদি ব্যবহার করতেন তারা। ডিসেম্বরের দিকে দেশে প্রবেশ করেন, তাদের সাথে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয় পাকিস্তানী বাহিনী। জামালপুর হাসপাতালে যখন তারা সেবার কাজে ব্যস্ত ছিলেন তখন পাকিস্তানী বাহিনী তাদের অবস্থান লক্ষ্য করে মর্টারশেল নিক্ষেপ করে। শেলটি ঠিক জায়গায় না পড়ে অন্যত্র পড়ার ফলে পুরো হাসপাতালের সবাই বেঁচে যান। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হবার পর ১১ নম্বর সেক্টরের তত্ত্বাবধানে কয়েকজন ভারতীয় সেনার সহায়তায় সন্ধ্যা রানী নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। সন্ধ্যা রানীর মতো অনেক নারীই এভাবে কাজ করেছেন দেশের জন্য। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার ৪০ বছর পরও তারা বলেন, আমরা একটা স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখতাম, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা আজও অধিকার বঞ্চিত।

No comments

Powered by Blogger.