বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৯১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ রফিকুল ইসলাম বীর বিক্রম সাহসী যোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে আখাউড়ার পতনের পর রফিকুল ইসলামসহ মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হন চান্দুরায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার অন্তর্গত চান্দুরা।


তাঁরা ছিলেন নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের অধীন মুক্তিযোদ্ধা। এক ব্যাটালিয়ন শক্তির। তাঁদের অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন এ এস এম নাসিম (বীর বিক্রম)।
মুক্তিযোদ্ধাদের এই অগ্রাভিযানে সামনে ছিল ‘সি’ (চার্লি) দল। এই দলে ছিলেন রফিকুল ইসলাম। তাঁর দলের অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া (বীর প্রতীক)। তাঁদের ওপর দায়িত্ব ছিল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শাহবাজপুর সেতু দ্রুত দখল করা।
‘সি’ দলকে অনুসরণ করে ‘এ’ (আলফা) দল। সবশেষে ছিল ‘ডি’ (ডেল্টা) দল। এই দলের সঙ্গে ছিলেন এস ফোর্সের অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম) এবং ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক। আর ‘বি’ (ব্রাভো) দল ছিল পেছনে। কাট অফ পার্টি হিসেবে তাদের ওপর দায়িত্ব ছিল অগ্রসরমাণ মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপত্তা বিধান করা।
রফিকুল ইসলাম ও তাঁর সহযোদ্ধারা ধর্মনগর-হরষপুর-পাইকপাড়া হয়ে অগ্রসর হন। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল, বিশেষত এ ও ডি দলের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব বিদ্যমান ছিল। এই দুই দল যখন চান্দুরার কাছে ইসলামপুরে পৌঁছায়, তখন বড় ধরনের এক দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে হঠাৎ উপস্থিত হয় একদল পাকিস্তানি সেনা। এ ঘটনা ছিল অভাবিত। নিমেষে সেখানে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। একটু পর সেখানে হাজির হয় আরও পাকিস্তানি সেনা।
এ সময় রফিকুল ইসলামের দল ছিল বেশ সামনে। তারা খবর পেয়ে দ্রুত সেখানে ছুটে আসে। তখন পাকিস্তানি সেনারা প্রচণ্ড গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর। আক্রমণের প্রচণ্ডতায় তাঁর দলের মুক্তিযোদ্ধারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। একটি প্লাটুন (উপদল) নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পাশের তিতাস নদীর অপর পারে চলে যায়। বাকি দুই প্লাটুনের একটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অক্ষত থাকে একটি প্লাটুন।
অক্ষত ওই প্লাটুনেই ছিলেন রফিকুল ইসলাম। তিনি ও তাঁর অল্প কয়েকজন সহযোদ্ধা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেন। তাঁদের সাহসিকতায় বেঁচে যায় কে এম সফিউল্লাহর জীবন এবং শেষ পর্যন্ত পর্যুদস্ত হয় পাকিস্তানি সেনারা। কিন্তু যুদ্ধের একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন রফিকুল ইসলাম।
সেদিন যুদ্ধে রফিকুল ইসলামসহ দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং এ এস এম নাসিমসহ ১১ জন আহত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ জন নিহত ও ১৪ জন বন্দী হয়। মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ দুই মুক্তিযোদ্ধাকে চান্দুরায় সমাহিত করেন। তাঁদের সমাধি সংরক্ষিত।
রফিকুল ইসলাম চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল জয়দেবপুরে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরের পঞ্চবটী সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন। পরে এস ফোর্সের অধীন নবগঠিত ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য রফিকুল ইসলামকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪৮।
রফিকুল ইসলামের পৈতৃক বাড়ি ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার চর খলিফা গ্রামে। সেখানে তাঁর কোনো বসতি নেই। একই উপজেলার লেজপাতা গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে (ফিরোজ আহাম্মদ) বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম সেকেন্দার আলী। মা মাসুমা খাতুন। স্ত্রী মমতাজ বেগম।
মমতাজ বেগম বলেন, ‘স্বামীর স্মৃতি বলতে আমার কাছে আছে শুধু ছেলে। আমাদের নিজস্ব বাড়িঘর নেই। বাবার বাড়িতে থাকি। একটি বাড়ির জন্য অনেক চেষ্টা করেও পাইনি। আমার স্বামী ১৯৭০ সালের আগে পাকিস্তানের লাহোরে ছিলেন। সেখান থেকে বদলি হয়ে বাংলাদেশে আসেন। তখন ছেলেসহ আমাকে বাবার বাড়িতে রেখে যান। ওই বছরই ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়। জলে ভাসতে ভাসতে জীবন বাজি রেখে ছেলের জীবন রক্ষা করি। আমাদের সবকিছু ভেসে যায়। জলোচ্ছ্বাসের পর তিনি বাড়ি এসেছিলেন। এরপর তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক দিন পর দুজন সৈনিক এসে জানালেন তাঁর শহীদ হওয়ার কথা।’
শহীদ রফিকুল ইসলামের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: প্রথম আলোর ভোলা প্রতিনিধি নেয়ামতউল্যাহ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.