পুলিশ হেফাজতে আবারও মৃত্যুঃ রক্ষক এখন ভক্ষক

রাজধানীর রমনা থানায় রিমান্ডে আনা জাকির হোসেনের মৃত্যু হয়েছে গত ৯ মার্চ। এ মৃত্যু নিয়ে থানা পুলিশ, ডিবি পুলিশ আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ঘটনাটিকে সন্দেহজনক করে তুলেছে। গোয়েন্দা ও থানা পুলিশের হেফাজতে থাকাকালীন নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ তুলেছেন নিহতের স্ত্রী ও স্বজনরা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে গ্রেফতারকৃতদের মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান ঘটনায় দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি যে উদ্বেগজনক, সেটা প্রমাণ করলেও সরকারের কিন্তু মাথা ব্যথা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

৪ মার্চ বাসা থেকে ৫৪ ধারায় জাকির হোসেনকে গ্রেফতার করে মহানগর ডিবি পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ ও তাকে নিয়ে বিভিন্ন অভিযানের পর ৮ মার্চ রাত ৯টায় ডিবির কাছ থেকে থানায় আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রমনা থানার ওসি। উভয় সংস্থাই আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে আনার কথা বলেছে। থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়লে জাকিরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তার মৃত্যু হয়েছে—এটা পুলিশের বক্তব্য। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত অবস্থায় জাকিরকে নিয়ে আসার কথা উল্লেখ করে—জরুরি বিভাগের নথিতে এমনটাই লেখা আছে। অন্যদিকে ডিবি কর্তৃপক্ষ থানা পুলিশের বক্তব্যের বিরোধিতা করে জাকিরকে রিমান্ড শেষে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানোর কথা বলেছেন। সেখান থেকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর জাকিরের মৃত্যুর ব্যাপারে ডিবির অজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে। আর নিহতের স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনরা জাকিরকে তাদের হেফাজতে হত্যা ছাড়াও তাকে গ্রেফতারের সময় বাড়ির লোকজনকে অমানবিক নির্যাতন করার অভিযোগ তুলেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। বাবাকে ধরে নিয়ে যেতে দেখে জাকিরের দুই শিশুপুত্র তাকে জড়িয়ে ধরলে তাদেরও লাথি মেরে ও পিটিয়ে একজনের পায়ের হাড় ভেঙে দেয়া ও অন্যজনের মাথায় পিস্তল ঠেকানো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তার স্বজনরা। গ্রেফতার থাকা অবস্থায় পরিবারের লোকজন জাকিরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগও পায়নি। মৃত্যুর পরও কোনো খবর পাঠায়নি পুলিশ। টিভির খবর দেখেই তারা ছুটে যান হাসপাতালে। নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে মহানগর পুলিশ কমিশনার জাকির হোসেনকে হার্টের রোগী বলেছেন। হাসপাতালে ভর্তির পরই হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়েছে, একথাও বলেছেন তিনি। এর আগে জানুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে গ্রেফতার হওয়া জাসাস নেতা আমিনুল ইসলাম মিঠু শাহবাগ থানা হেফাজতে মারা যান। তার স্ত্রীও একইভাবে পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতন করে স্বামীকে হত্যার অভিযোগ এনেছিলেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন মৃত্যুর কোনো সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি বলেই পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে বলাটা খুব অসঙ্গত হবে না।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রিপোর্টে গত বছর বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর হেফাজতে ৩৫ জনের মৃত্যুর কথা জানা যায়। এ বছরের তিন মাসেই ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি প্রমাণ করে। অথচ এমন মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনাই সরকারি বাহিনীর সংবিধান ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুস্পষ্ট উদাহরণ। এ বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনাও খুবই স্পষ্ট। ১৯৯৮ সালে ৫৪ ধারায় ডিবির হাতে আটক ছাত্র রুবেলের মৃত্যুর পর দায়েরকৃত রিটের শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল দেয়া হাইকোর্ট বিভাগের রায় কার্যকর হলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়তো বন্ধ হতো। কিন্তু কোনো সরকারই হাইকোর্টের রায় মান্য করার প্রয়োজন বোধ করেনি। বর্তমান সরকারের কাছে যারা ভিন্ন কিছু আশা করেছিলেন, এর মধ্যেই তারা হতাশা চেপে রাখতে পারছেন না।
মহাজোট সরকারের সর্বগ্রাসী দলীয়করণের বাইরে থেকে পুলিশের পক্ষে নিরপেক্ষ ও আইনসম্মতভাবে দায়িত্ব পালন যে কতটা অসম্ভব সেটা আজ দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। রক্ষকের ভূমিকা থেকে ভক্ষকে রূপান্তরের এমন মোক্ষম সময় এদেশে খুব কমই দেখা গেছে। পুলিশের মতো সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা অব্যাহত থাকলে তাদের পক্ষপাতমূলক ও সংবিধানবিরোধী ভূমিকা আরও বাড়বে, এমন আশঙ্কা মোটেই কাল্পনিক নয়। পুলিশ হেফাজতে ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর ঘটনা সবাইকে এমনটাই ভাবতে বাধ্য করছে।

No comments

Powered by Blogger.